ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর। বর্তমানে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিষয়ে অধ্যাপনা করছেন। শ্রমবাজার, কর্মসংস্থান, কর্মমুখী শিক্ষাসহ অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ-এর। বলেন, গণতন্ত্র, সুশাসন এবং জবাবদিহিতা ছাড়া উন্নয়ন গণমানুষের কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। দীর্ঘ আলোচনায় উঠে আসে ইসলামী ব্যাংকের পর্ষদে পরিবর্তনের বিষয়টিও। তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথম পর্ব। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু ও শফিকুল ইসলাম।জাগো নিউজ : বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘সিডার’ গবেষণা প্রতিবেদনে সম্প্রতি দেখিয়েছে, আয় বাড়লেও মানুষের প্রকৃত মজুরি কমছে। আপনার বিশ্লেষণ কি? ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : মূল্যস্ফীতি যে হারে বাড়ছে সেই তুলনায় মানুষের মজুরি বাড়েনি। মজুরি যা বেড়েছে, তা মূল্যস্ফীতির তুলনায় কম। এ কারণেই প্রকৃত মজুরি কমছে। গার্মেন্ট শ্রমিকদের বেতন বাড়ানো হলো চার বছর আগে। কিন্তু প্রতি বছরই মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলছে। ধারাবাহিকভাবে মূল্যস্ফীতি বাড়ার কারণেই মানুষের প্রকৃত মজুরি কমে গেছে।জাগো নিউজ : মজুরির এ বিষয়টি কৃষি এবং শিল্প খাতের তুলনা করে কী বলবেন? সালেহউদ্দিন আহমেদ : আমার ধারণা কৃষিক্ষেত্রে মজুরি কিছুটা বেড়েছে। এর একটি কারণ হচ্ছে কৃষিতে শ্রমিক কমে যাওয়া। কৃষিজমি কমে যাচ্ছে। কৃষির সঙ্গে আরও ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। গ্রাম থেকে শ্রমিককে এক প্রকার জোর করে শহরে পাঠানো হচ্ছে। শহরে আসলে কিছু না কিছু করা যায়। এতে মৌসুমে কৃষিতে শ্রমিক সংকট দেখা দেয়। যারা কৃষিতে শ্রম দেন তাদের মজুরি তখন কিছুটা বেড়ে যায়। জাগো নিউজ : তাহলে এটি তো মজুরির প্রকৃত বৃদ্ধি বলা যায় না। সালেহউদ্দিন আহমেদ : না। এটিকে প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধি বলা যাবে না। আবার গ্রামের অনেকেই এখন কৃষিতে শ্রম দিতে চান না। বাড়ির পাশেই ছোট দোকান দিয়ে ব্যবসা করছেন। কৃষিতে শ্রম কঠিন। অন্য কাজে শ্রম অনেকটাই সহজ। তাই মানুষ কৃষি শ্রম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। সুতরাং বিশেষ পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে কৃষি শ্রমে মজুরি বাড়লেও তাকে প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধি বলা যাবে না।জাগো নিউজ : মূল্যস্ফীতি এবং প্রকৃত মজুরির এই অসামঞ্জস্যতার তো একটি সামাজিক প্রভাবও আছে? সালেহউদ্দিন আহমেদ : অবশ্যই। এ ব্যবধান মানুষের জীবনযাত্রায় সরাসরি প্রভাব ফেলে। একজন মেহনতি গরিব মানুষের ন্যূনতম ক্রয়ক্ষমতা থাকতে হয়। কিন্তু মূল্যস্ফীতির কারণে সে ক্ষমতা যদি কমে যায় তাহলে সমাজে অবশ্যই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।সাধারণ মানুষ তখন তার বেসিক বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেয়া ছাড়া উপায় দেখে না। খাদ্য নিরাপত্তাই তখন তার মৌলিক বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। বিনোদন, ভ্রমণ বা শখের বিষয়গুলো সংকীর্ণ করে ফেলতে হয়। বলা হচ্ছে, আয় বাড়ছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের আয় বাড়ছে কিনা, সেটাই বড় কথা। আয় বাড়লেও সম্পত্তি বাড়ছে না। মানুষের যে আয় বাড়ছে, তা থেকে উদ্বৃত্ত থাকছে না। যা থাকছে, তা দিয়ে সম্পত্তি বাড়ানো যাচ্ছে না। জমি বা বাড়ি কেনা সাধারণের নাগালের বাইরে চলে গেছে। জাগো নিউজ : কিন্তু সমাজ তো এগিয়ে যাচ্ছে?সালেহউদ্দিন আহমেদ : এক অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সমাজ এগিয়ে যাচ্ছে। উন্নয়ন হচ্ছে। সরকারও উন্নয়নের নানা ফিরিস্তি দিচ্ছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়ছে, এটি বলা যাচ্ছে না। যে উন্নয়ন হচ্ছে, তাতে সাধারণ মানুষের সম্পদ বাড়ছে না।জাগো নিউজ : উন্নয়ন তো রাষ্ট্র-সমাজকে ঘিরেই? সালেহউদ্দিন আহমেদ : রাষ্ট্রের সবাই তো ক্ষমতার কাছে থাকতে পারে না। অনেকেই উন্নয়নের তলানিতেও অবস্থান করার সুযোগ পায় না। যারা উপর তলার মানুষ, উন্নয়নের সুবিধা মূলত তারাই পাচ্ছে। যারা রাষ্ট্র, সমাজের ক্ষমতার কাছে থাকছেন, তাদের জীবনমান পশ্চিমা দুনিয়ার সঙ্গে তুলনা করতে পারেন। তাদের সম্পদও বাড়ছে পশ্চিমাদের মতোই। কথিত উন্নয়নে ধনী-গরিবের ব্যবধান বাড়ছে। উন্নয়নে সমতার চিন্তা মিলছে না। চিন্তা নেই বলেই সমতার ভিত্তিতে উন্নয়নে আমরা যাচ্ছি না।প্রবৃদ্ধি বাড়ানোই যেন উন্নয়নের মাপকাঠি হয়ে গেছে। সামষ্টিক অর্থনীতির নানা দিক অন্যান্য দেশের থেকে ভালো। কিন্তু এ উন্নয়নের সুফল তলানির মানুষেরা পাচ্ছে না। অর্থাৎ সমতার ভিত্তিতে সুবিধা বণ্টন নিয়ে কেউ চিন্তা করে না।জাগো নিউজ : এই সুবিধা বণ্টনে আপনার পরামর্শ কী? সালেহউদ্দিন আহমেদ : সবাই একই কাতারে আসবে, তা ভাবার সুযোগ নেই। কিন্তু অন্তত ব্যবধানটা কমানোর চেষ্টা করা যেতে পারে। একজন কোটিপতির সঙ্গে দিনমজুর কোনোদিনই পাল্লা দিতে পারবেন না। কিন্তু একজন মানুষ হিসেবে দিনমজুর তার ন্যায্য অধিকার প্রত্যাশা করতেই পারেন। সাধারণ মানুষ এখন এই প্রত্যাশাও করতে পারছে না। মানুষের মৌলিক অধিকার পূরণে রাষ্ট্রকেই দায়িত্ব নিতে হয়। জাগো নিউজ : কিন্তু মানুষের আয়-ব্যয় নিয়েই তো প্রবৃদ্ধি বাড়ছে? সালেহউদ্দিন আহমেদ : প্রবৃদ্ধির হিসাব নিয়ে প্রশ্ন আছে। কোন খাত থেকে প্রবৃদ্ধির হিসাব ধরা হয়, তা ভাবতে হবে। প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো গুরুত্ব পায়, তাতে গণমানুষের অংশগ্রহণ থাকছে না।হরতাল-অবরোধের কারণে পরিবহন ব্যয় বেড়ে গেছে, আর এই বাড়তি ব্যয়কেই প্রবৃদ্ধি অর্জন হিসেবে বিবেচনা করছে। পরিবহন ব্যয় বাড়লেই এর সুবিধা উৎপাদক বা তৃণমূল মানুষেরা পাবে, তা তো বলা যাবে না। টেবিলে বসে আপনি অনেক কিছুই হিসাব করতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। আমাদের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে পুঁজিনির্ভর, শ্রমনির্ভর নয়। আর এ কারণেই বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে। জাগো নিউজ : জিডিপি বাড়ছে কিন্তু বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে না। এ নিয়ে কী বলবেন? সালেহউদ্দিন আহমেদ : বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ ছাড়া কাঙ্ক্ষিত জিডিপি অর্জিত হবে না। সরকার বড় বড় প্রকল্প করছে। মানুষের হাতে টাকা যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। কিন্তু উৎপাদন তো বাড়ছে না। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ না বাড়লে কম সময়ে উৎপাদন বাড়বে না। সুতরাং কীভাবে জিডিপি ৭ দশমিক ২ হবে তা আমার বোধগম্য নয়। যদিও সরকার বিশেষ খাত ধরে হিসাব মেটাতেও পারে। জাগো নিউজ : তার মানে কাঙ্ক্ষিত জিডিপি অর্জনের অন্তরায় বেসরকারি বিনিয়োগ না বাড়া? সালেহউদ্দিন আহমেদ : বেসরকারি বিনিয়োগ ২২ কি ২৩ শতাংশে আটকে গেছে। ৭ দশমিক ২ শতাশ জিডিপি পেতে হলে বেসরকারি বিনিয়োগ ৩০ শতাংশ পার করতে হবে।এএসএস/এসআই/এআরএস/আরআইপি
Advertisement