শ্রাবণ মাসের রাত। ঝুম ঝুম বৃষ্টি পড়ছে। কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতেই চারিদিকে বেশ পানি জমে গেছে। বৃষ্টির পানির সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে লুবনার চোখের জল। রাত এগারোটা বাজে। এই প্রবল বৃষ্টিতে এতো রাতে কেউ বাইরে নেই। লুবনা মনে মনে চাইছে কেউ যেন না থাকে। এই অন্ধকার নির্জন রাত আর অঝোর ধারার বৃষ্টিতে সে লুকিয়ে রাখতে চায় তার সব কষ্ট। গভীর রাতে একা একা একটি যুবতী মেয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে আর উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটছে এটা দেখলে যেকোন মানুষ প্রশ্ন করবে, ভুরু কুঁচকে তাকাবে। এই মুহূর্তে কোন তৃতীয় ব্যক্তির কথা ভাবতে তার একদম ইচ্ছে করছে না। তাই আজ রাতের এই নিকষ কালো আঁধারটুকু তার জন্য যেন এক টুকরো আশীর্বাদ। সে নিশ্চিন্তে তার মনের গহীনে জমে থাকা কষ্টের স্মৃতিতে সাঁতার কাটতে পারছে। ‘আসলেই কী এরই মধ্যে পাঁচ বছর চলে গেছে? তার সাথে শাহিনের বিয়ের পাঁচ বছর হয়ে গেছে? হ্যাঁ, তাই তো।’ বাবা-মায়ের পছন্দেই বিয়ে। প্রথম দেখায় শাহিনকে মোটামুটি ভালোই লেগেছিল। আসলে লুবনা এতো লাজুক, নিজে থেকে খুব বেশি কিছু বলতে পারেনি সেদিন। শাহিনের কথার উত্তরেই যেটুকু বলেছে। কণ্ঠটা খুব সুন্দর, ঠিক যতোটুকু ভরাট হলে রাগী মনে হয় না, আবার বেশ পুরুষালী লাগে সেরকম। খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারে না, তবে বেশ প্রাণবন্ত। একধরনের সারল্যমাখা ছেলেমানুষি আচরণ। দেখতে খুব সুন্দর না হলেও আকর্ষণীয়। খুব বেশি সুন্দর ছেলে ভালো লাগে না লুবনার, একটু মেয়েলী লাগে। জানতে ইচ্ছা করছিল ও কবিতা আবৃত্তি করে নাকি? বিয়ের পর আবিষ্কার করলো, আবৃত্তি না করলেও শাহিন দারুণ রবীন্দ্র সংগীত গায়। বিয়ের কয়েকদিন পরে ওকে একদিন ‘বধূ কোন আলো লাগলো চোখে’ গানটা গাইতে শুনে লুবনার চোখে পানি চলে এসেছিল। যে মানুষ এতো সুন্দর গান করে, সে নিশ্চয়ই ভীষণ রোমান্টিক। ঠিক এরকম একজন মানুষই তো চেয়েছিল লুবনা। নিজেকে তার অনেক ভাগ্যবতী মনে হয়। বিয়ের আগে লুবনা খুব একটা সাজতো না। মা-বাবা খুব একটা পছন্দ করতেন না। বিয়ের পর এই অপূর্ণ সাধটা কেন জানি মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। অনেক আগে থেকেই তার কিছু অদ্ভুত পাগলামি ধরনের কল্পনা আছে। বিয়ের পরে গভীর রাতে সে খুব সাজগোজ করবে। চোখ ভরে কাজল, লিপস্টিক, লাল টিপ কিছুই বাদ যাবে না। কোন দিন খুব আধুনিক সাজ, কোনদিন একেবারে বাঙালি সাজ। তার বর বিছানায় শুয়ে শুয়ে গান শুনবে। আর সে পিছন ফিরে সাজবে। ‘লাইট নেভাও, ঘুম পাচ্ছে খুব। সেই সকালে উঠতে হবে।’ মানুষটা সেকথা বলতে বলতেই লুবনা ঘুরে দাঁড়াবে। সে তখন মাঝপথে কথা থামিয়ে হা করে তাকিয়ে থাকবে। মাঝরাত পর্যন্ত গল্প করবে তারা। এলোমেলো সব গল্প। কোন বইটা খুব ভালো লেগেছে, কোন গানের দু’টো লাইন সারাদিন মাথায় ঘুর ঘুর করেছে। ওর যে হা করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগে সেই গল্প। সে গল্পের শেষ হবে না ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসলেও। বাস্তবে তার কিছুই হলো না। রাতের বেলা শাহিন মগ্ন হয়ে টিভি দেখে। লুবনা ভালো ইংরেজি বোঝে না। ওর ভীষণ বোরিং লাগে। ঝিমুনি আসে। কিন্তু শাহিন কিছুতেই অন্য কোন প্রোগ্রাম দেখবে না। হাই তুলতে তুলতে অনেক চেষ্টা করেও লুবনা জেগে থাকতে পারে না, ওদের আর গল্প করা হয় না। সাজতো অনেক দূরের কথা। দিনের পর দিন লুবনা অপেক্ষা করে, একটা রাত হয়তো আসবে অন্তহীন গল্প করার রাত। একটা দিন হয়তো আসবে; যেদিন শাহিন মুগ্ধ হয়ে তাকে দেখবে, তার সৌন্দর্যের প্রশংসা করবে। সে হয়তো রূপসী নয়, তবু মিথ্যা করে হলেও তো বলতে পারে। মাঝে মাঝে রাগ হয়, কী দরকার ছিল এতো বেশি সৎ, সরল মানুষ হওয়ার? আস্তে আস্তে শাহিনের আরেকটা রূপের সঙ্গে পরিচয় হয় লুবনার। ওর প্রচণ্ড রাগ আর অসম্ভব জেদ। একবার কিছুতে ‘না’ বললে সেই ‘না’ আর কিছুতেই ‘হ্যাঁ’ হবে না। ওর মনমত কিছু না করলে মুখ ফুটে সহজে কিছু বলবে না। কিন্তু দিনের পর দিন নীরবতার দেয়াল তুলে দেবে, বরফ শীতল পাথরের দেয়াল। লুবনা সব সময় যে সাথে সাথে সেটা ধরতে পারে, তা না। যখন বুঝতে পারে, তখন হয়তো দেরি হয়ে গেছে। হাজার প্রশ্ন করেও উত্তর পাওয়া যাবে না, শুধু এই অসহ্য দূরত্বের বোঝাকে বুকে চেপে নিয়ে দিন পার করতে হবে। পাশে গিয়ে বসলেও নিশ্চুপ। সাবধানে ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলবে। অনেক সাধ্য সাধনার পরে যদি কখনো মান ভাঙে, তারপর আবার স্বাভাবিক। লুবনার তাই এক ধরনের আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটে, কখন না জানি কী ভুল হয়ে যায় আর শুরু হয়ে যায় সেই নির্বাসনের শাস্তি। এই ভয় থেকে আস্তে আস্তে নিজের মধ্যে এক ধরনের হীনম্মন্যতাও জন্ম নেয়। ‘কেন তাকেই বারবার মান ভাঙাতে হবে? কেন এতো ছোটখাটো কথায় রাগ করতে হবে? সে কী তবে শাহিনের যোগ্য নয়? মনের মত মানুষ পায়নি সে?’রামিশার জন্মের দু’মাসের মাথায় একদিন শাশুড়ির উপরে বিরক্ত হয়ে শাহিনকে একটা কথা বলে ফেলেছিল লুবনা। তার সন্তানকে সে নিজের মতো লালন-পালন করতে চায়। ডাক্তার যেভাবে বলেছে, সেভাবে নিয়ম করে। শাশুড়ি রামিশাকে চিনি মিশিয়ে দুধ দিয়ে দিয়েছেন বারবার না করার পরেও। সদ্য মাতৃত্বের ক্লান্তিতে এমনিতেই লুবনা তখন বিধ্বস্ত। তাও আবার প্রথম সন্তান। শাহিনকে একথা জানাতেই তার সেকি রুদ্রমূর্তি। ওরা তখন ঢাকায় ছিল, শ্বশুর বাড়িতে। সেই রাতে শাহিন সেই যে বেড়িয়ে গেলো, সারারাত বাড়ি ফেরেনি। একদিকে ও কোথায় গেলো সেই দুশ্চিন্তা, আরেকদিকে সকালে উঠে শ্বশুর-শাশুড়িকে কী বলবে সেই চিন্তা। লুবনা দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। সেই প্রথম, সেদিনই আসলে লুবনার একটা সিদ্ধান্ত নেয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু পরদিন সকালে শাহিন যখন ফিরে এলো, রামিশাকে বুকে নিয়ে ঠিকই সব ভুলে গেলো সে। তারপর একই ঘটনা ঘটেছে বারবার। রাগের ভয়ঙ্কর রূপও দেখেছে সে কতবার। শাহিন লুবনার গায়ে হাত তুলত না ঠিকই। তবে রাগ হলে তার মাথার ঠিক থাকতো না। আজ জিনিস ছুঁড়ে মারল তো কাল কিছু একটা ভেঙে ফেললো, পরশু আবার বাড়ি ছেড়ে চলে গেলো কয়েক ঘণ্টার জন্য। ও বাড়ি ছেড়ে গেলেই লুবনার বুক কাঁপতে থাকে অজানা আশঙ্কায়, ‘যা ভয়ঙ্কর জেদি, যদি নিজের কোন ক্ষতি করে ফেলে?’ নিজের উপরেও তীব্র ঘৃণা হতো, ‘যে মানুষটা তাকে এতো কষ্ট দিতে পারে, তার জন্যই সে দুশ্চিন্তায় অস্থির। এতো বেহায়া কেন সে?’শাহিন ঢাকার বাইরে ট্রান্সফার হয়ে এসেছে বছরখানেক হলো। এখানে লুবনার ভারি নিঃসঙ্গ দিন কাটে। এক রামিশা আছে বলেই কিছুটা ভরসা। কিছুদিন হল পাশের বাড়ির শুভ্রা ভাবির সঙ্গে বেশ খাতির হয়েছে ওর। শুভ্রা ভাবির জোরাজুরিতেই আজ বিকেলে রামিশাকে ওনার কাছে রেখে ওরা দু’জন বেরিয়েছিল চাইনিজ খাবে বলে। লুবনা ইচ্ছা করেই আগে থেকে কিছু ঠিক করেনি। থাক না আজকে কিছুটা সারপ্রাইজ। মনে মনে আশা করেছিল শাহিন নিশ্চয়ই কোথাও ঠিক করে রেখেছে আগে থেকেই। বরের উপরে এই ছোটখাটো নির্ভরতা করতে তার এক ধরনের ভালো লাগে। আজ কতোদিন পরে ওরা এরকম দু’জনে কোথাও বের হলো। লুবনা বেশ সেজেছে। আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেরই বেশ ভালো লাগছিল। শাহিন গাড়ি চালাচ্ছে। লুবনা নানা ছুতোয় এ কথায় সে কথায় ওর দৃষ্টি ফেরাতে চাইছে তার দিকে। নাহ, লাভ হলো না কোন। সে কিছু একটা নিয়ে বিরক্ত হয়ে আছে মনে হয়। লুবনার হতাশ লাগে, খুশির সুরটা একটু করে কেটে যাচ্ছে। ‘লুবনা কোথায় খেতে যাবে?’ কিছুটা বিরক্তির সুরেই জানতে চায় শাহিন। কেমন যেন নিয়মমাফিক যান্ত্রিক গলার স্বর। ‘তুমি যেখানে নিয়ে যাবে।’‘আমাকে বললে আমি কোথাও যাব না। তুমি খেতে যেতে চেয়েছ, তুমিই বল।’‘এ আবার কেমন কথা? প্লিজ, তুমি ঠিক করো না আজ, সব সময় কোথায় বেড়াতে যাব, এটা তো আমিই ঠিক করি। শুভ্রা ভাবির সঙ্গে কথা বলে এই চমৎকার প্ল্যানটা তো আমিই করলাম।’ ‘দেখ লুবনা, তোমার এইসব ন্যাকামি আমার একদম ভালো লাগে না। তুমি কি কচি খুকি যে এখনো এতো ঢং করো। যেতে চাইলে বল তাড়াতাড়ি, না হলে আমি গাড়ি ঘুরালাম।’রাগে, দুঃখে, অপমানে লুবনার চোখে পানি চলে আসলো। সে কেন বারবার এই লোকটার কাছে নিজেকে ছোট করে? কার জন্য আজ সে এতো মোহনীয় সাজে সেজে এসেছে? তারও জেদ চেপে যায়। ‘ঘুরাও গাড়ি। তোমার সাথে আর কোনদিন, কোনদিন আমি কোথাও যাব না। আমার আজ আসাটাই বিরাট ভুল হয়েছে।’‘আমার সাথে এতো জোরে চিৎকার দিয়ে তুমি কথা বলছ কোন সাহসে? নামো তুমি আমার গাড়ি থেকে।’ রাগে অন্ধ হয়ে সেই অন্ধকার রাস্তাতেই গাড়ি থামিয়ে দেয় শাহিন। লুবনা প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেলো। শাহিনকে হাতে-পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে শান্ত করতে চেষ্টা করে সে। কিন্তু কেন যেন শাহিন কিছুতেই মানছে না। ধাক্কা দিয়ে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয় ওকে। কাঁদতে কাঁদতে গাড়ির পিছনে ছুটছে লুবনা। শাহিন তাকে ফেলে চলে গেছে। ‘পারলো শাহিন এই কাজ করতে?’ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লুবনা এক সময় সম্বিত ফিরে পায়। হু হু করে কাঁদছে সে, অপমানে, ঘৃণায়। ‘নিজেকে আর কতো ছোট করবে তুমি লুবনা? ভালোবাসা নামের মরীচিকার পিছনে আর কতদিন ছুটবে?’ কাঁদতে কাঁদতে শাহিনের গাড়ি যেদিকে গেছে তার উল্টো দিকে হাঁটছে লুবনা। মনের ভিতরে ঘুরেফিরে আসছে গত পাঁচটা বছর। জোর করে রামিশার মুখটাকে দূরে ঠেলে দেয় সে। কোনো পিছুটান আজ আর তাকে ফেরাতে পারবে না। সে হাঁটছে অজানা গন্তব্যের দিকে। তবে সেটা মরীচিকা নয়।এসইউ/জেআইএম
Advertisement