ফিচার

শীতলক্ষ্যার তীরে গ্রামীণ মেলা

মাঘ মাসের চতুর্থ দিনে কালীগঞ্জবাসীর কাঙ্ক্ষিত দিনটি আসে। এ সময় গাজীপুরের কালীগঞ্জের জনপদ উৎসবের আমেজে রঙিন হয়ে ওঠে। দোকানি এ সময় মেলার মাঠে পসরা সাজিয়ে বসে। ভোর হতেই শিশু-কিশোররা শুরু করে ছোটাছুটি। প্রায় দেড়শ’ বছরের পুরনো কালীগঞ্জ উপজেলার শীতলক্ষ্যা তীরে বকুল তলার এ গ্রামীণ মেলা। শুরুতে মেলাটি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জন্য হলেও বর্তমানে তা সব ধর্মের মানুষের উৎসবে পরিণত হয়েছে।  সকালের কুয়াশা কাটতেই মেলা প্রাঙ্গন মুখরিত হয়ে ওঠে নানান বয়সী মানুষের পদচারণায়। শিশুরা বড়দের কাছে বায়না ধরে টমটম গাড়ি, চড়কি, নানা রঙের পুতুল ও বেলুন কিনে দেয়ার জন্য। পাশাপাশি বড়রা কিনছে দৈনন্দিন ব্যবহার্য কাঠ-বাঁশ-বেতের তৈরি আসবাবপত্র ও মাছ ধরার সরঞ্জাম। মেয়েরা কিনছে মাটির হাড়ি, পিঠা তৈরির সাঝ, পিড়ি, মালসা, জলচৌকি ও রান্নার তৈজসপত্রসহ আরো কত কী!১৫ দিনব্যাপী চলবে এ মেলা। তিলা, কদমা, নিমকি, শখের মিঠাই, চানাচুর, মাসের বোরা, খই, বাতাসা ও হরেক রকম খাবারের ঘ্রাণে ভারি হয় মেলার প্রান্তর। পুতুল নাচ, নাগরদোলা, ঘূর্ণি বিদেশ, বেলুন-বন্দুক নিশানায় মেতে ওঠে নানা বয়সী শিশু-কিশোরের দল। মেলা হবে আর চটপটি-ফুচকা হবে না, তা কি হয়? আলু-ডাবলির সঙ্গে তেঁতুলের পানি মেশানো ঝাল-টক চটপটি নস্টালজিক বয়স্কদের জিভেও পানি আসে। তাই মেলায় চটপটি-ফুচকা ছাড়া কল্পনাও করা যায় না। মেলায় আসে কুমারদের মাটির গড়া স্বপ্ন। তারা মাটি ছেনে তৈরি করেন দেশি-বিদেশি ফলের রঙিন ব্যাংক, সাহেব-মেম, বউ পুতুল, গরু, ছাগল, হাতি, বাঘ, সিংহ, ঘোড়া, কুমির, হাঁস, মুরগি, মাছ, পেখম তোলা ময়ূর এবং পাখি। যার উপস্থিতি চিরায়ত গ্রামবাংলার কুমারপাড়ার শৈল্পিক জীবনের সংগ্রামী অস্তিত্বের জানান দেয়। কথা হয় মেলায় আগত শিশু দর্শনার্থী উপজেলার সৈয়দ আহমেদ কিন্ডার গার্টেন স্কুলের প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী রাশেদ্বীন সরকার রূপণের (৮) সঙ্গে। রূপন জানায়, তার স্কুলের পাশেই মেলা বসে। এজন্য সে প্রতিদিন স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে মেলা উপভোগ করে। মেলা থেকে তার বাবা তাকে গাড়ি ও বেলুন কিনে দিয়েছে। কালীগঞ্জ পৌর এলাকা ভাদার্ত্তী গ্রামের গৃহবধূ রোজীনা বেগম (২৫) এসেছেন সংসারের প্রয়োজনীয় কিছু তৈজসপত্র কিনতে। তিনি জানান, প্রতিবছর এই মেলা থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস ক্রয় করেন। তাই আজকেও এসেছেন। দাম একটু বেশি হলেও অনেক জিনিস একসঙ্গে একই জায়গায় পাওয়া যায়। মায়ের সঙ্গে এসেছে শিশু রাফিয়া ফাওজি রজত (৩)। মাত্র কথা বলা শিখেছে। তাই ভাঙা ভাঙা শব্দে রাফিয়া জানায়, মায়ের সঙ্গে মেলায় এসেছে বড় পুতুল কিনতে।   কালীগঞ্জ বাজারের স্থানীয় ব্যবসায়ী মো. রফিজ উদ্দিন (৭৫) জানান, তার জ্ঞান হওয়ার পর থেকে কালীগঞ্জের বকুল তলার গ্রামীণ মেলা দেখে আসছেন। কিন্তু তারও আগে দাদা এবং বাবার কাছে এই মেলার কথা শুনেছেন। শুরুতে এই মেলাটি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জন্য হলেও বর্তমানে তা সব ধর্মের মানুষের আনন্দের-উৎসব। প্রথমে এক দিনব্যাপী হলেও পরে তিন, সাত দিনব্যাপী এবং সভ্যতার ক্রমবিকাশে এখন ১৫ দিনব্যাপী হয়ে থাকে। এর একটি অংশ ফার্নিচার মেলা থাকে মাসব্যাপী।  তিনি আরো জানান, বর্তমানে এখানে আর কোনো গ্রাম নেই। স্থানীয় নানা কল-কারখানা গ্রামীণ পরিবেশ নষ্ট করে ফেলেছে। তবে মেলায় বিক্রি হোক আর না হোক; বছরের পুরনো ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতেই প্রতি বছর এ মেলার আয়োজন করে থাকেন স্থানীয় কিছু সংস্কৃতিমনা মানুষ। ঢাকার মিরপুর থেকে মেলায় খেলনার দোকান নিয়ে এসেছেন মো. আব্দুল্লাহ (৪০)। তিনি জানান, ১০ বছর যাবৎ তিনি এই মেলায় দোকান নিয়ে আসছেন। বেচা-কেনা যাই হোক স্থানীয় মানুষের সঙ্গে অন্যরকম একটা সম্পর্ক হয়েছে। গাজীপুরের সালনা থেকে এম ডি রিমন (২৬) এবারই প্রথম খেলনার দোকান নিয়ে এসেছেন। কিন্তু মেলায় এসে এখানকার গ্রামীণ পরিবেশ তার খুব ভালো লেগেছে। তাই তিনি চেষ্টা করবেন প্রতিবছরই আসার।মেলায় মুন্সীগঞ্জের বিক্রমপুর থেকে ক্রোকারিজের দোকান নিয়ে এসেছেন পঞ্চাশোর্ধ মো. আমিনুল ইসলাম। তিনি জানান, প্রায় দুই যুগ ধরে তিনি এই মেলায় আসেন। তাছাড়া প্রায় এক যুগ ধরে তিনি একই জায়গায় দোকান নিয়ে বসেন। এখানকার মানুষের সাথে ভালো একটা সম্পর্ক হওয়ায় এই দিনটির জন্য তিনি মুখিয়ে থাকেন। আসলেই চেনা-জানা সবার সঙ্গে দেখা হয়।মেলায় কসমেটিক্স দোকানি রহুল আমিন (৪৫) জানান, তার দোকানে মহিলা গ্রাহকের ভিড় প্রচুর। তাই বিক্রিও ভালো। তিনি মনে করছেন, এই ধারা অব্যাহত থাকলে ভালো লাভের মুখ দেখতে পারবেন। মেলার আয়োজক আলী আল মারুফ অনিক জানান, মেলায় স্বল্প খরচে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ব্যবসায়ীদের স্টলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। রয়েছে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা। কালীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. আলম চাঁদ জানান, মেলায় যাতে কোনো প্রকার জুয়া বা অসামাজিক কার্যক্রম এবং আইন-শৃঙ্খলার অবনতি না হয় সে জন্য সাদা পোশাকে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।এসইউ/পিআর

Advertisement