শুধু লেগে থাকা নয় আঠার মতো লেগে থাকার নামই বিজয়। আপনি কেন আঠার মতো লেগে থাকবেন সেটা এখানে অবশ্যই বিবেচনার একটি বিষয়। শৈশব ও কৈশোরের সময়টা যাদের গ্রামে কেটেছে তাদের নিশ্চয়ই মনে পড়ে যাচ্ছে জীবনের আঠাকেন্দ্রিক কিছু আনন্দদায়ক মুহূর্তের কথা। কী সুখেরই না ছিল বাবলার আঠা, পেপলট্রি ফলের আঠা, আম গাছের আঠা কিংবা গাব গাছের আঠা দিয়ে খেলার সেই দিনগুলো! আম গাছের আঠার কাজ কিন্তু গাব গাছের আঠা করতে পারে না। তাই আঠা চেনাটা জরুরি। আর যৌবনের প্রেমতো নিজেই কাঁঠালের আঠা। বোঝেন তাহলে এক আঠা থেকেই কতকিছু শেখার আছে! এজন্যই বলে শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। আরো খুশির খবর দিলেন মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী। পাঠ্যবইয়ের ভুল ঢাকতে এবার মাঠে নামছে আঠা। জনসাধারণ আশা প্রকাশ করছেন, ভুল-ভ্রান্তির মতো কয়েকদিন পর আঠা দিয়ে নিখিল বঙ্গের পাঁঠাও ঢাকা যাবে। কানে কানে বলে রাখি কিছু কিছু আঠা ছাড়ানো কিন্তু বেশ জটিল। ছোটবেলায় আঠা দিয়ে খেলা শুরুর আগে প্রথমে আমাদের আঠা ছাড়ানোর নিয়মটা কিন্তু শিখতে হয়েছে। আশাকরি মন্ত্রী মহোদয় নিয়মটা নিশ্চয়ই জানেন। আঠা প্রসঙ্গ থাক। কয়েকদিন পরে যখন স্কুলে স্কুলে আঠা পৌঁছে যাবে তখন সবাই আঠার জীবন, প্রকৃতি ও ব্যবহারবিধি এমনিতেই জেনে যাবেন। ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের কথা বলি। বছরের প্রথমদিন পাঠ্যবই বিতরণের পর থেকেই শুরু হয়েছে নানাজনের নানামুখী ক্রিয়া আর প্রতিক্রিয়াযুক্ত ঠেলাঠেলি। কেউ ঠেলছেন, কেউ ঠেলা খাচ্ছেন আবার কেউ ঠেলাঠেলির মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমার মতো ভাবছেন এ কোন মফিজের পাল্লায় পড়লাম! আদতে কেউই কিন্তু আমরা মফিজের পাল্লায় পড়িনি, নিজেরাই প্রতিনিয়ত সমষ্টিবদ্ধভাবে মফিজ হচ্ছি। কেউ মফিজ হওয়ার পর জেনে বুঝে চুপ করে থাকে। কেউ আবার বুঝেই উঠতে পারেন না যে তিনি একজন মফিজ। দুই দলের মাঝখানে পড়ে আমি মফিজ কোথায় যাই! আমার কন্যা মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল ও কলেজের এবারের দ্বিতীয় শ্রেণি পাস শিক্ষার্থী। তৃতীয় শ্রেণিতে ওঠার গর্বে পারলে সে কয়েকদিন মাটির উপর দিয়ে হাঁটে! দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় শ্রেণিতে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তার মাসিক বেতন একলাফে বেড়ে গেল ২৫০ টাকা। আগে মাসিক বেতন ১২০০ টাকা দিতে হতো আর এখন দিতে হবে ১৪৫০ টাকা। স্কুল কর্তৃপক্ষ বার্ষিক পরীক্ষার শেষদিন প্রত্যেক শিক্ষার্থীর হাতে একটা করে নোটিশ ধরিয়ে দিয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের বেতন বাড়ার কারণে তারাও তাদের শিক্ষকদের বেতন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আর এ কারণে নতুন শ্রেণিতে প্রতিটা শিক্ষার্থীর কাছ থেকে অতিরিক্ত বেতন নেয়া হবে। প্রিপারেটরি স্কুল ও কলেজের প্রতিটা শ্রেণিতে (সকাল-দিবা শাখা মিলে) শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৬০০ জন। স্কুল কর্তৃপক্ষ শুধু তৃতীয় শ্রেণি থেকেই প্রতি মাসে অতিরিক্ত আদায় করবে দেড় লাখ টাকা। প্লে-গ্রুপ থেকে কলেজ অব্দি এই বাটপারির আর্থিক পরিমাণ তাহলে কত হবে! এছাড়াও পুনঃভর্তির সময়ে উন্নয়ন ভাতা, অমুক ভাতা আর তমুক ভাতার জন্য আমাকে পরিশোধ করতে হয়েছে এককালীন ৮০০০ টাকা। খোঁজ নিলে দেখা যাবে রাজধানীর প্রতিটা স্কুলেই এমন বাটপারির ঘটনা ঘটছে। দেশে কতজন বৈধ উপার্জনকারী নাগরিক আছেন যারা বছরের শুরুতেই সন্তানদের ভর্তিজনিত এই অসহনশীল ব্যয়ভার বহন করতে সক্ষম! আমি সক্ষম নই, স্কুলের অধিকাংশ অভিভাবকই সক্ষম নন। সবাই মুখ বুজে সহ্য করে যাচ্ছেন কারণ প্রশ্ন তুললে স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে মুখস্ত একটা উত্তরই আসে- আপনার বাচ্চাকে স্কুল থেকে নিয়ে যান। স্কুল থেকে নিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি কোন অভিভাবকই নিতে চাননা। স্কুল থেকে বের করে সন্তানকে কোথায় ভর্তি করাবেন। সেই থোর বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোর। সবতো একই! মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর কাছে জানতে চাই, স্কুল কর্তৃপক্ষ কি চাইলেই যখন তখন শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত বেতন ভাতাদি আদায়ের ক্ষমতা রাখেন? শিক্ষার্থী কর্তৃক বেসরকারি স্কুলের বেতন-ভাতাদি আদায় প্রসঙ্গ সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত কীনা? নিয়ন্ত্রিত হলে একটি স্কুল কীভাবে হুটহাট এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে? আর যদি স্কুলের গভর্নিং বডি সিদ্ধান্ত গ্রহণে সর্বেসর্বা হন সেক্ষেত্রে স্কুলের বাণিজ্য বন্ধকরণে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর কঠোর হস্তক্ষেপ কামনা করছি। মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে অভিভাবকদের প্রতি এমন অরাজকতার বিচার প্রার্থনার সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টির ত্বরিৎ সুরাহা আশা করি। নানাবিধ যে সমস্ত প্রতিক্রিয়ার কারণে স্কুলে স্কুলে আঠা রফতানির ব্যবস্থা করা হচ্ছে পাঠ্যবইয়ের সেই ক্রিয়াগুলির একটি বোধ হয় তৃতীয় শ্রেণির বাংলা বইয়ে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা কবি কুসুম কুমারী দাসের ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতা। আমার দ্বিতীয় শ্রেণি পাশ কন্যাকে বললাম, তোমার বাংলা বইয়ে এই কবিতাটি ভুল আছে। এটা পড়া যাবে না। আমি তোমাকে আসল কবিতাটা পড়াবো। যথারীতি দ্বিতীয় শ্রেণি পাশ করা আমার গর্বিত কন্যা প্রস্তাবটি নাকচ করে দিলো। কারণ সে বিশ্বাস করে বইয়ের চেয়ে তার মা বেশি জানেনা। স্কুলগামী শিশুদের কাছে সবরকম ভুলভ্রান্তির উর্ধ্বে থাকে স্কুলের শিক্ষকগণ। শিক্ষকগণের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি- শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে তাদের অনিচ্ছাকৃত সামান্য ত্রুটিও যদি শিশুদের মা-বাবা সংশোধন করে দিতে চায় তাতে বেশিরভাগ শিশুই কিন্তু রাজি হয় না। আর পাঠ্যপুস্তকতো তাদের কাছে ধর্মীয় গ্রন্থের মতোই পবিত্র। তাদের ধারণা সেখানে ভুল থাকতেই পারেনা। আলোচনা সমালোচনায় কঠিনভাবে প্রশ্নবিদ্ধ আজ জাতীয় শিক্ষাবোর্ড। অনুগ্রহ করে কোমলমতি শিশুদের প্রতি সদয় হোন। তাদের মনোজগতে আলো ছড়ানোর ব্যবস্থা করুন। কেন এতো সমালোচনা হচ্ছে, কাদের বিরুদ্ধে হচ্ছে! শিশুর কোমলতাকে ব্যবহার করে তাদের সংকীর্ণমনা করে গড়ে তোলার দীর্ঘমেয়াদী কর্মসূচি যারা হাতে নিয়েছে তাদের সমূলে নির্মূল করুন। যথাযথ কর্তৃপক্ষের প্রতি আবেদন- উত্থিত সব সমালোচনাকে আমলে নিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণই হতে পারে শিশুদের জন্য কল্যাণের একমাত্র পথ। কল্যাণের পথে হাঁটুন। লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক।এইচআর/এমএস
Advertisement