বিশেষ প্রতিবেদন

দুই মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতায় পাঠ্যবইয়ে ভুল

একের পর এক প্রাথমিক পর্যায়ের পাঠ্যবইয়ে নানা ভুল-ত্রুটি ধরা পড়ছে। ভুলে ভরা এসব বই শিক্ষার্থীদের জন্য কতটা উপযোগী এটি নিয়ে এখন বিতর্ক উঠেছে। ইতোমধ্যে অভিযুক্ত একাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তবে এসবের অন্তরালে শিক্ষা ও প্রাথমিক গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতার বড় কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এসব বইয়ের কারিকুলাম অনুমোদন দেয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। আর ভুল সংশোধনের দায়িত্ব নিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শুধু তাই নয়, ভুল ধরা ও সংশোধন করতে উদ্যাগী শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে তিন সদস্য কমিটি করা হয়। সর্বোপরি মঙ্গলবার শিক্ষামন্ত্রী নিজ দায়িত্বে প্রাথমিকের বই সংশোধনের আশ্বাস দেন। অন্যদিকে গণশিক্ষামন্ত্রী চুপ। নেই কোনো তদন্ত কমিটি, বিবৃতি। অর্থাৎ যার কাজ তার করার খবর নেই, অন্যজনের ঘুম নেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্প্রতি পাঠ্যপুস্তকে ভুল ধরার পর দুই মন্ত্রণালয়ের চরম দায়িত্বহীনতা ও সমন্বয়হীনতার বিষয়টি সামনে এসেছে। সম্প্রতি প্রাথমিক অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত হওয়ায় জেএসসি পরীক্ষার দায় পড়ে প্রাথমিক মন্ত্রণালয়ের ওপর। কিন্তু পরীক্ষার ১০ দিন আগে পরীক্ষা না নেয়ার কথা জানায় তারা। এ নিয়ে দুই মন্ত্রণালয়ের মধ্যে চরম বিরোধ দেখা দেয়। পরে শিক্ষামন্ত্রী নিজে সংবাদ সম্মেলন করে জেএসসি পরীক্ষা নেয়ার দায়িত্ব নেন। এবার পাঠ্যবইয়ের ভুলের বিষয়টি নিয়ে সেই রকম অবস্থা চলছে। কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন পাঠ্যবইয়ে ভুলের দায়িত্ব কেউ নিতে চায়নি। বিষয়টি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিজ দায়িত্বে ভুল সংশোধন এবং পরিমার্জনের দায়িত্ব নেয়। এরই অংশ হিসেবে সংবাদ সম্মেলন করেছেন শিক্ষামন্ত্রী।প্রাথমিক মন্ত্রণালয় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে (এনসিটিবি) তাদের কোনো অভিজ্ঞসম্পন্ন লোক নেই, আধিপত্য নেই- এই অজুহাতে দায়িত্ব এড়াতে চান। অর্থাৎ একে অন্যের ওপর দোষ চাপানো নিয়ে ব্যস্ত। এ অবস্থায় এই ভুলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের শাস্তি হওয়া না হওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রাথমিক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, আমরা কারিকুলাম তৈরি করে দেই। কিন্তু ছাপানোর পুরো দায়িত্ব এনসিটিবির। সেখানে কোনো লাইন বাদ পড়লো, কোনো শব্দ যোগ বাদ পড়লো বা বানান ভুল হলো এর পুরো দায়িত্ব এনসিটিবির। তারা কোনো ভুল করলে তাদের শাস্তি দেয়ার দায়িত্ব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। কারণ এ প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন। এখানে সব কর্মকর্তার পোস্টিং দেন তারা। তাদের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই আমাদের। এ অবস্থায় পাঠ্যবইয়ে যে ভুল ধরা পড়েছে, তার দায়-দায়িত্ব এনসিটিবিকে নিতে হবে। এদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তার দোষারোপ করছে প্রাথমিক মন্ত্রণালয়কে। তাদের অভিযোগ, কারিকুলার অনুমোদন করেই দায়িত্ব শেষ করতে চায় তারা। এরপর প্রুফ দেখাসহ নানা কাজ থাকে যেগুলোতে কোনো ধরনের সহযোগিতা প্রাথমিক মন্ত্রণালয় করে না। এ ব্যাপারে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. গিয়াস উদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রতি বছর এনসিটিবিতে যে পরিমাণে বই ছাপা হয়, তার প্রায় অর্ধেক প্রাথমিক পর্যায়ের। কিন্তু এনসিটিবিতে আমাদের বিষয় বিশেষজ্ঞ লোক নেই। তিনি বলেন, এনসিটিবির প্রাথমিক শাখার ২৪টি পদের মধ্যে ২০টি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দখলে। অর্থাৎ যোগ্য লোক থাকার পরও সেখানে যেতে পারছেন শুধু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিরোধিতা কারণে। এ অবস্থায় দায়ভার আমরা কেন নেবো? তবে বইয়ের যেসব ভুল ধরা পড়েছে তাতে আমরা বিব্রত। এনসিটিবি সূত্রে জানা যায়, মাধ্যমিক ও প্রাথমিক দুটি সম্পাদনা শাখায় রয়েছে। প্রাথমিক উইং ২৪টি পদের বিপরীতে মাত্র চারজন কর্মকর্তার জায়গা হয়েছে। বাকি পদগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দখলে। প্রাথমিক স্তরের বইয়ের সম্পাদনের জন্য কাউকে দেয়ার সুপারিশ করলে সেটাও বাতিল হয়।উদাহরণ দিয়ে তারা বলেন, ঝিনাইদহের পিটিআই সুপার সালমা নার্গিস (বর্তমানে রিচিং আউট অব স্কুল চিলড্রেন প্রকল্পের উপ-পরিচালক) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাঠ্যক্রমের ওপর ডক্টরেট করেছেন। তাকে এনসিটিবির প্রাথমিক উইং নিয়োগ দিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দেয়ার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতামত চাইলে তারা তা নাকচ করে দেয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের মতো করে অযোগ্য লোকদের এখানে বসিয়েছে শুধু তাদের (কর্মকর্তাদের) ঢাকায় থাকার জন্য। এনসিটিবিতে প্রাথমিক মন্ত্রণালয় শুধু নিধিরাম সর্দার। অন্যদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় দেরিতে পাণ্ডুলিপি জমা দেয়ায় তা যাচাই-বাছাই না করেই ছাপাখানায় পাঠাতে বাধ্য হয়েছেন তারা। দেরিতে পাণ্ডুলিপি দেয়ার ব্যাখ্যা দিয়ে গিয়াস উদ্দিন বলেন, প্রাথমিকের বই ছাপানোর সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও কিছু জটিলতা হয়েছে। এজন্য পাণ্ডুলিপি জমা দিতে একটু দেরি হয়েছে। এ বিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, যা বলার মন্ত্রী বলছেন। আর কিছু জানার থাকলে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন।এমএইচএম/জেএইচ/পিআর

Advertisement