১৫ আগষ্ট। জাতীয় শোক দিবস। এই দিনে ১৯৭৫ সালে ধানমন্ডির ৭২ নম্বরে ঘটেছিল ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকান্ড। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্য ও ঐ সময় ৭২ নম্বরে থাকা সকল আত্মীয়-স্বজনও রেহায় পায়নি বুলেট থেকে। বঙ্গবন্ধুর ছেলে ছোট শিশু রাসেলকেও খুনীরা হত্যা করে সেইদিন। রক্তে রঞ্জিত হয় বাড়ির মেঝে ও সিড়িপথ।জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি আ: হামিদ এডভোকেট এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন।রাষ্ট্রপতির বাণী :
Advertisement
“১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস। ১৯৭৫ সালের এ দিনে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শাহাদত বরণ করেন। আজ বঙ্গবন্ধুর ৩৯তম শাহাদত বার্ষিকী। আমি এ দিনে শোকাহত চিত্তে গভীর শ্রদ্ধা জানাই মহান স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের শহিদ সদস্যদের স্মৃতির প্রতি। জাতীয় শোক দিবসে আমি পরম করুণাময় আল্লাহর দরবারে সে-দিনের সকল শহিদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।১৫ আগস্ট ১৯৭৫ বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক বেদনাবিধুর ও কলঙ্কজনক অধ্যায়। দেশের স্বাধীনতাবিরোধী ষড়যন্ত্রকারীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে ঘাতকচক্রের হাতে ধানম-ির নিজ বাসভবনে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান শহিদ হন। একই সাথে শহিদ হন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব, পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশুপুত্র শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, সহোদর শেখ নাসের, কৃষকনেতা আবদুর রব সেরনিয়াবাত, যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মণি ও তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, বেবী সেরনিয়াবাত, সুকান্ত বাবু, আরিফ, আব্দুল নঈম খান রিন্টু। এ ঘটনা কেবল বাঙালির ইতিহাসে নয়, পৃথিবীর ইতিহাসেও বিরল। হত্যাকারীদের উদ্দেশ্য ছিল শুধু একজন রাষ্ট্রনায়ককে হত্যা করা নয়, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে মুছে ফেলা এবং পরাজিত শক্তিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা।আমাদের জাতীয় ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর অবদান অপরিসীম। তাঁরই নেতৃত্বে বাঙালি জাতি অর্জন করে বহু কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ’৫৮-এর সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ’৬৬-এর ৬-দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং ’৭০-এর সাধারণ নির্বাচনসহ এ দেশের গণমানুষের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণে প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে তিনি জাতিকে নেতৃত্ব দেন। এ জন্য তাঁকে বহুবার কারাবরণসহ অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়। দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে এদেশের জনগণকে বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করে এই মহান নেতা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঘোষণা করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম নেয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। মূলত, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ। তাই ঘাতকচক্র জাতির পিতাকে হত্যা করলেও তাঁর আদর্শ ও নীতিকে নিঃশেষ করতে পারেনি। এ দেশ ও জনগণ যতদিন থাকবে ততদিন জাতির পিতার নাম এদেশের লাখো-কোটি বাঙালির অন্তরে চির অমলিন, অক্ষয় হয়ে থাকবে।দীর্ঘ ৩৫ বছর পরে হলেও ২০১০ সালে জাতির পিতা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিষ্ঠুরতম হত্যাকা-ের বিচার বাংলার মাটিতে সম্পন্ন হয়েছে। জাতি আজ অনেকটা কলঙ্কমুক্ত। যেসব মৃত্যুদ-প্রাপ্ত ঘাতক আজো বিদেশে পালিয়ে রয়েছে তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের রায় কার্যকর করতে সর্বোচ্চ তৎপরতা চালাতে হবে। জাতি জানবে হত্যাকারীদের ঠাঁই পৃথিবীর কোথাও নেই।জাতির পিতার সারাজীবনের স্বপ্ন ছিল ‘সোনার বাংলা’ গড়ার। আমাদের দায়িত্ব হবে বঙ্গবন্ধুর অসম্পূর্ণ কাজকে সম্পূর্ণ করে দেশকে একটি সুখী ও সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করে জাতির পিতার সেই স্বপ্ন পূরণ করা। তাহলেই তাঁর আত্মা শান্তি পাবে এবং আমরা এই মহান নেতার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে পারব।আসুন, জাতীয় শোক দিবসে আমরা জাতির পিতাকে হারানোর শোককে শক্তিতে রূপান্তর করি এবং দেশ গঠনে আত্মনিয়োগ করি।খোদা হাফেজ, বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।”প্রধানমন্ত্রীর বাণী :
পনেরই আগস্ট জাতীয় শোক দিবস। ১৯৭৫ সালের এই দিনে মানব ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাকা-ের শিকার হন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।ঘৃণ্য ঘাতকরা এই দিনে বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব, তিন পুত্র ক্যাপ্টেন শেখ কামাল, লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল এবং ১০ বছরের শিশু স্কুলছাত্র শেখ রাসেল, দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর সহোদর শেখ নাসের, কৃষকনেতা আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মণি ও তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, বেবী সেরনিয়াবাত, সুকান্ত বাবু, আরিফ, আব্দুল নঈম খান রিন্টুসহ পরিবারের ১৮ জন সদস্যকেও হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর সামরিক সচিব কর্নেল জামিলও নিহত হন। ঘাতকদের কামানের গোলার আঘাতে মোহাম্মদপুরে একটি পরিবারের বেশ কয়েকজন হতাহত হন এ দিন।জাতীয় শোক দিবসে আমি মহান আল্লাহ্তায়ালার দরবারে জাতির পিতাসহ সে-দিনের সকল শহিদের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি।জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদর্শী, সাহসী এবং ঐন্দ্রজালিক নেতৃত্বে বাঙালি জাতি পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য। বাঙালি পেয়েছে স্বাধীন রাষ্ট্র, নিজস্ব পতাকা ও জাতীয় সংগীত।যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে বঙ্গবন্ধু যখন সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে সোনার বাংলা গড়ার সংগ্রামে নিয়োজিত, তখনই স্বাধীনতাবিরোধী-যুদ্ধাপরাধী ঘাতকচক্র জাতির পিতাকে হত্যা করে। এর মধ্যদিয়ে তারা বাঙালির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও অগ্রযাত্রাকে স্তব্ধ করার অপপ্রয়াস চালায়। অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামোকে ভেঙে ফেলাই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য।পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর থেকেই এই জঘন্য হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত স্বাধীনতাবিরোধী চক্র হত্যা, ক্যু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু করে। ইনডেমনিটি অর্ডিনেন্স জারি করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ বন্ধ করে দেয়।জিয়াউর রহমান অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে। মার্শাল ল’ জারির মাধ্যমে গণতন্ত্রকে হত্যা করে। সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের পুরস্কৃত করে। দূতাবাসে চাকুরি দেয়। স্বাধীনতাবিরোধী-যুদ্ধাপরাধীদের নাগরিকত্ব দেয়। রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদার করে। রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে পুনর্বাসিত করে। পরবর্তী বিএনপি-জামাত সরকারও একই পথ অনুসরণ করে।বিএনপি-জামাত জোট এবং পরবর্তী তত্ত্ববধায়ক সরকারের খুন, হত্যা, দুর্নীতি ও দুঃশাসনের অবসান ঘটিয়ে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে জনগণ ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করে। নির্বাচনি ইশতেহার অনুয়ায়ী গত পাঁচ বছর আমরা দেশের উন্নয়নে ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছি। বিএনপি-জামাত জোটের রেখে যাওয়া অর্থনৈতিক অচলাবস্থা এবং বিশ্বমন্দা কাটিয়ে দেশকে দৃঢ় অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়েছি। বিএনপি-জামাত জোটের অরাজকতা উপেক্ষা করে দেশের জনগণ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে পুনরায় আমাদের বিজয়ী করে। আমরা জনগণের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে “রূপকল্প ২০২১” ও “রূপকল্প ২০৪১” বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি।আমরা সপরিবারে জাতির পিতা হত্যার বিচারের রায় কার্যকর করেছি। জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার সম্পন্ন হয়েছে। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী-মানবতাবিরোধীদের বিচারের রায় কার্যকর হওয়া শুরু হয়েছে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাকারীদের বিচারের কাজ চলছে। আমরা গণতন্ত্র, সংবিধান ও আইনের শাসনকে সমুন্নত রেখেছি। কোনো ষড়যন্ত্রই আমাদের সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা থেকে বিচ্যুত করতে পারবে না।ঘাতকচক্র বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেও তাঁর স্বপ্ন ও আদর্শের মৃত্যু ঘটাতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর ত্যাগ ও তিতিক্ষার দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনাদর্শ বাঙালি জাতির অন্তরে প্রোথিত হয়ে আছে।আসুন, আমরা জাতির পিতাকে হারানোর শোককে শক্তিতে পরিণত করে তাঁর স্বপ্ন সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করি। দারিদ্র্যমুক্ত, শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার এ সংগ্রামে আমাদের অবশ্যই জয়ী হতে হবে।জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধুবাংলাদেশ চিরজীবী হোক।”
Advertisement