বিশেষ প্রতিবেদন

প্রগতি লাইফে কমিশন নৈরাজ্য

রাজস্ব ফাঁকি, কমিশনে অনিয়ম, হিসাবে গরমিল, সম্মেলনের নামে আর্থিক অনিয়ম, পরিচালকদের অনৈতিক সুবিধা, এজেন্ট ও এমপ্লয়ার অব এজেন্ট প্রশিক্ষণ ব্যয়ে অনিয়মসহ নানাবিধ অনিয়মে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ রয়েছে  জীবন বীমা কোম্পানি প্রগতি লাইফের বিরুদ্ধে। এসব অনিয়মের কারণে কোম্পানির আর্থিক অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন গ্রাহকরা। এতে একদিকে হচ্ছে আইন লঙ্ঘন, অন্যদিকে মানি লন্ডারিংয়ের আশঙ্কা। প্রতিষ্ঠানটির এসব অনিয়মের তথ্য নিয়ে জাগো নিউজের সাত পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে প্রথম পর্ব।প্রিমিয়াম আয়ের ওপর থেকে কমিশন প্রদানে নৈরাজ্য বিরাজ করছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্সে। বীমা আইনের কোনো তোয়াক্কা না করেই প্রতিষ্ঠানটি এজেন্টদের মাত্রাতিরিক্ত কমিশন দিচ্ছে। আবার এ কমিশনের বড় অংশই দেয়া হচ্ছে ভুয়া (অনুমোদনহীন) এজেন্টদের।এভাবে কয়েক কোটি টাকার অনিয়ম করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এতে কোম্পানির জীবন বীমা তহবিলে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন গ্রাহকরা।প্রগতি লাইফের ২০১২, ২০১৩ ও ২০১৪ সালের আর্থিক বিষয়ের ওপর করা এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে। নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান মেসার্স নূরুল ফারুক হাসান অ্যান্ড কোং চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস নিরীক্ষাটি করেছে। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গ্রুপ বীমা, আইপিএল, পিবি অ্যান্ড বিআইবিডি, তাকাফুল এবং আইডিপিএস এই পাঁচটি প্রজেক্টে ২০১২, ২০১৩ ও ২০১৪ সালে ৮৩ কোটি ৬৭ লাখ টাকা কমিশন ও রিলিজ বাবদ খরচ করেছে প্রগতি লাইফ। এর মধ্যে ২০১২ সালে ৪৫ কোটি ৯৫ লাখ টাকা, ২০১৩ সালে ১৪ কোটি ১৮ লাখ এবং ২০১৪ সালে ২৩ কোটি ৫৪ লাখ টাকা খরচ করা হয়েছে।প্রতিষ্ঠানটির কমিশন এবং সুপারভাইজরি পদে এ রিলিজ দেয়ার ক্ষেত্রে কোনো ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়নি। একেক সময় একেক প্রজেক্টে একেক রকম কমিশন ও রিলিজ দেয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে বীমা আইন লঙ্ঘন করে নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত কমিশন ও রিলিজ দেয়া হয়েছে।আইন অনুযায়ী কমিশন ও রিলিজসহ অন্যান্য খরচ মিলিয়ে প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয়ের সর্ব্বোচ্চ ৯০ শতাংশ খরচ করা যায়। কিন্তু প্রগতি লাইফ কমিশন ও রিলিজ বাবদ ২০১২ সালে আইপিএল প্রজেক্টে ১২৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ এবং পিবি অ্যান্ড পিআইবিডি প্রজেক্টে ৯৬ শতাংশ খরচ করে।  নিরীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয়ের ওপর এজেন্টদের আইপিএল প্রজেক্টে ৪৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ, পিবি অ্যান্ড বিআইবিডি প্রজেক্টে ৩৪, তাকাফুল প্রজেক্টে ৩২, আইডিপিএস প্রজেক্টে ২২ দশমিক ৩১ এবং গ্রুপ বীমায় ১৪ দশমিক ১৮ শতাংশ কমিশন দেয়া হয়।পরের বছর ২০১৩ সালে বর্ষ প্রিমিয়াম আয়ের ওপর আইপিএল প্রজেক্টে ৪০ দশমিক ৩৩ শতাংশ, পিবি অ্যান্ড বিআইবিডি প্রজেক্টে ২৮, তাকাফুল প্রজেক্টে ৪৯, আইডিপিএস প্রজেক্টে ২২ এবং গ্রুপ বীমায় ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ কমিশন দেয়া হয়।আর ২০১৪ সালে আইপিএল প্রজেক্টে ৩২ দশমিক ৪২ শতাংশ, পিবি অ্যান্ড বিআইবিডি প্রজেক্টে ২৬, তাকাফুল প্রজেক্টে ২৮, আইডিপিএস প্রজেক্টে ৩৪ এবং গ্রুপ বীমায় ৬ দশমিক ২১ শতাংশ কমিশন দেয়া হয়।

Advertisement

কমিশনের মতো রিলিজও একেক বছর একেক প্রজেক্টে একেক হারে দেয়া হয়

সাল

আইপিএল

Advertisement

পিবি অ্যান্ড পিআইবিডি

তাকাফুল

আইডিপিএস

২০১২

Advertisement

৮১ শতাংশ

৬২ শতাংশ

৪০ শতাংশ

৪৭ শতাংশ

২০১৩

২৭ শতাংশ

৩৪ শতাংশ

৫১ শতাংশ

২৭ শতাংশ

২০১৪

২৭ শতাংশ

৩৯ শতাংশ

৩৩ শতাংশ

২৪ শতাংশ

 বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) বলছে, বীমা আইন ২০১০ এর ৫৮ ধরার ৩ (ক) অনুযায়ী প্রথম বর্ষ ব্যবসার ওপর এজেন্টদের সর্বোচ্চ ৩৫ শতাংশ কমিশন দেয়া যাবে। কিন্তু প্রগতি লাইফ নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত কমিশন দিয়ে আইনের এ ধারা লঙ্ঘন করেছে।এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি এক প্রজেক্টে কমিশন বেশি এবং অন্য প্রজেক্টে কমিশন কম দিয়ে সমতা বিধান করেছে। তবে একচ্যুয়ারি বীমা পরিকল্পনা তৈরির সময় বীমা আইন অনুযায়ী পরিকল্পের টেবিল ও টার্মের ভিত্তিতে কমিশনসহ ব্যবস্থাপনা ব্যয় হিসাব করে প্রিমিয়াম নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি একচ্যুয়ারির নির্ধারণ করা প্রিমিয়াম হারের থেকে বেশি ব্যয় করেছে।আইডিআরএ’র অভিমত, জীবন বীমা ব্যবসার প্রকৃতি অনুযায়ী প্রগতি লাইফের ব্যবসায় মাঠ পর্যায়ে আদর্শিক সাংগঠনিক কাঠামো নেই। ফলে এজেন্ট এবং এমপ্লয়ার অব এজেন্টের আদর্শিক অনুপাত অনুসরণ না করে শুধু সাংগঠনিক কাঠামো সরল রেখার মডেলে প্রথম বর্ষ ব্যবসা সংগ্রহ করা হয়েছে। এতে সুপারভাইজররা বেশি আর্থিকভাবে লাভবান হন।নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, প্রগতি লাইফ গ্রুপ বীমা সংগ্রহের ওপর ২০১২ সালে ৮ কোটি ২৭ লাখ টাকা, ২০১৩ সালে ৫ কোটি ৪২ লাখ এবং ২০১৪ সালে ৩ কোটি ৮ লাখ টাকা কমিশন খাতে না দেখিয়ে ব্যাংক চার্জ হিসেবে দেখিয়েছে।আইডিআরএ বলছে, এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি বীমা আইন ২০১০ এর ৫৮ ধারা লঙ্ঘন করেছে। এমন ব্যয়ের কারণে জীবন বীমা তহবিলে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে এবং বীমা গ্রাহকদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।নিরীক্ষা প্রতিবেদনে আরো উঠে এসেছে, ২০১২ সালে ১০ হাজার ৭৪৯ জন, ২০১৩ সালে ১ হাজার ১৩৯ এবং ২০১৪ সালে ৯৪১ জন ভুয়া (লাইসেন্স ব্যতীত) এজেন্টকে ব্যবসা সংগ্রহের ওপর কমিশন দেয়া হয়। অথচ বীমা আইন অনুযায়ী বীমা এজেন্ট ছাড়া অন্য কাউকে কমিশন বা অন্য কোনো পারিশ্রমিক বা পারিতোষিক দেয়া যাবে না।বীমা আইনে এজেন্টের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, এজেন্ট বলতে বোঝাবে বীমা আইন ২০১০ এর ২(২৯) ধারার অধীনে নিবন্ধিত কোনো ব্যক্তি, যিনি কমিশন বা অন্য পারিশ্রমিক গ্রহণে সম্মত হয়ে বীমা পলিসি সচল, নবায়ন বা পুনরুজ্জীবিত করাসহ বীমা ব্যবসা আহরণ ও সংগ্রহ করেন।আইডিআরএ বলছে, লাইসেন্স ব্যতীত এজেন্টকে ব্যবসা সংগ্রহের ওপর কমিশন দিয়ে প্রগতি লাইফ বীমা আইন ২০১০ এর ২(২৯), ৫৮ এবং ১২৪ ধরা লঙ্ঘন করেছে।প্রথম বর্ষ প্রিমিয়ামের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি নবায়ন প্রিমিয়ামের ওপর কমিশন দেয়ার ক্ষেত্রেও অনিয়ম করেছে। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, নবায়ন প্রিমিয়ামের ওপর ২০১২ সালে তাকাফুল প্রজেক্টে সর্বোচ্চ ১৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ এবং সব প্রজেক্টে গড়ে ১১ দশমিক ৭৮ শতাংশ কমিশন দেয় প্রগতি লাইফ।পরের বছর ২০১৩ সালে তাকাফুল প্রজেক্টে ১৬ দশমিক ৩৫ শতাংশ এবং সব প্রজেক্টে গড়ে ৯ দশমিক ৬২ শতাংশ কমিশন দেয়া হয়। ২০১৪ সালে তাকাফুল প্রজেক্টে ১৫ দশমিক ৩৭ এবং সব প্রজেক্টে গড়ে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ কমিশন দেয়া হয়।আইডিআরএ বলছে, এভাবে কমিশন দিয়ে প্রগতি লাইফ বীমা আইন ২০১০ এর ৫৮(৩) ধারা লঙ্ঘন করেছে। আইনের এ ধারায় নবায়ন প্রিমিয়ামের ওপর কমিশন দেয়ার বিষয়ে বলা হয়েছে, সব প্রজেক্টে একই নিয়ম অনুসরণ করতে হবে।এছাড়া আইডিআরএ’র নির্দেশনা অনুযায়ী নবায়ন প্রিমিয়াম আয়ের ওপর কোনো অবস্থাতেই ১৫ শতাংশের বেশি কমিশন দেয়া যাবে না। অথচ প্রগতি লাইফ ২০১২, ২০১৩ ও ২০১৪ তিন বছরই তাকাফুল প্রজেক্টে ১৫ শতাংশের বেশি কমিশন দিয়েছে।এসব অনিয়মের বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে প্রগতি লাইফের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জালালুল আজিম জাগো নিউজকে বলেন, নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের তথ্য সঠিক নয়। ৩ লেয়ারে ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন হওয়ার কথা, আমাদের তার থেকে কম আছে। কমিশন নিয়ে কোনো অনিয়ম করা হয়নি। অনিয়মের যেসব কথা বলা হয়েছে তা নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভুল।এমএএস/জেডএ/এনএফ/আরআইপি