জাতীয় বাজেটের আকার প্রতিবছর বাড়লেও বাস্তবায়নের হার ক্রমান্বয়ে কমছে। প্রতি অর্থবছরের শুরুতে যে বাজেট ঘোষণা করা হয় বাস্তবে তা ব্যয় হচ্ছে না। প্রতিবছর বরাদ্দ বাড়লেও আগের চেয়ে আনুপাতিক হারে ব্যয় কম হচ্ছে। ফলে বাজেটের প্রাক্কলন এবং প্রকৃত ব্যয়ের পার্থক্য ক্রমশ বাড়ছে। তাই বড় বাজেট ঘোষণা করে সরকার বাহবা পেলেও এর বাস্তবায়ন না হওয়ায় সরকারের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নেও হতাশাজনক চিত্র দেখা গেছে। বাজেট নিয়ে ধারাবাহিক তিন পর্বের আজ থাকছে প্রথম পর্ব। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) ব্যয় হয়েছে মাত্র ৪১ হাজার ৯০৮ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের মাত্র ১২ দশমিক ৩ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৩৭ হাজার ১২১ কোটি টাকা, যা ছিল মোট বাজেটের ১২ দশমিক ৬ শতাংশ। এর আগের অর্থবছরের একই সময়ে ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৩৬ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ। অর্থমন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। এদিকে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, আগামী অর্থবছরের বাজেট হবে ৩ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে তিনি জানান, বর্তমান সরকারের শেষ মেয়াদে ৫ লাখ কোটি টাকার বাজেট দেবেন তিনি। এ পরিস্থিতিতে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাজেটের আকারের চেয়ে প্রকৃত ব্যয়ই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ প্রকৃত খরচই অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলে। তাদের মতে, বড় বাজেট দিলেই হবে না। দেখতে হবে, আমাদের অর্থনীতির তা ধারণ করার মতো ক্ষমতা আছে কি না। তা না হলে বাজেটের কাঙ্ক্ষিত সুফল সাধারণ জনগণ পাবেন না। সূত্র জানায়, চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের মোট বাজেটের আকার ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। আর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সরকারের ব্যয়ের পরিকল্পনা ছিল ২ লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে নির্ধারণ করা হয় ২ লাখ ৬৪ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা। সেই হিসাবে সংশোধিত বাজেটের তুলনায় নতুন বাজেটের ব্যয় লক্ষ্যমাত্রা ২৯ শতাংশ বেশি।সূত্র জানায়, গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সংশোধিত ২ লাখ ৬৪ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকার বাজেটের মধ্যে শেষ পর্যন্ত অনুন্নয়ন-উন্নয়ন মিলে প্রকৃত ব্যয় হয় মোট ২ লাখ ২৫ হাজার ৬০ কোটি টাকা। নিট ব্যয় বরাদ্দের চেয়ে ৩৯ হাজার কোটি টাকা বা ১৫ শতাংশ কম। গত অর্থবছর মূল বাজেটের আকার ছিল ২ লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা। সহজভাবে বললে বুঝায়, ১০০ টাকা বাজেটের মধ্যে সরকার মোট ব্যয় করতে পেরেছে ৮৫ টাকা। যেখানে পাঁচ বছর আগে ১০০ টাকার মধ্যে ব্যয় হতো ৯৩ টাকা। গত পাঁচ বছরে বাজেটের আকার বাড়লেও হতাশাজনকভাবে কমে গেছে বাস্তবায়নের সক্ষমতা। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, পাঁচ বছর আগে ২০১১-১২ অর্থবছরে বাজেটে ব্যয়ের লক্ষ্য ছিল ১ লাখ ৬৩ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে মোট ব্যয় হয় ১ লাখ ৫২ হাজার ৬৬৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রাক্কলনের চেয়ে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা বা ৭ শতাংশ কম খরচ হয়। পাঁচ বছর পর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মোট ২ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকার বাজেটের মধ্যে শেষ পর্যন্ত নিট ব্যয় দাঁড়ায় ২ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ লক্ষ্যের চেয়ে ৩৯ হাজার কোটি টাকা বা ১৫ শতাংশ কম খরচ হয়েছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে অনুন্নয়ন-উন্নয়নসহ মোট ১ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দের মধ্যে নিট ব্যয় হয় ১ লাখ ৭৪ হাজার কোটি টাকা (৯২ শতাংশ)। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ২ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ১ লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা (৮৭ শতাংশ) ব্যয় হয়। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ২ লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ব্যয় দাঁড়ায় ২ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকা (৮৬ শতাংশ)। এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাজেট ঘোষণার সময় ব্যয়ের যে প্রাক্কলন করা হয়, বছর শেষে তার চেয়ে অনেক কম খরচ হয় । প্রতিবছরই এ প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সম্প্রতি বরাদ্দের চেয়ে প্রকৃত ব্যয়ের পার্থক্য বেশি হচ্ছে। বেশির ভাগ লক্ষ্য অর্জিত হয় না। ফলে বাজেট এখন ‘কাগুজে’ পরিণত হয়েছে।’ বাজেট বাস্তবায়নের সক্ষমতা আগের চেয়ে কমে গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বাস্তবায়নযোগ্য বাজেট দেয়ার কথা বলা হলেও কখনোই আমলে নিচ্ছে না সরকার।’ বড় বাজেটের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব কাজ করে এ মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘এতে করে সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়া যায়। কিন্তু লক্ষ্যপূরণ না হলে বাজেটের কাঙ্ক্ষিত সুফল মেলবে না।’ এমইউএইচ/জেএইচ/জেডএ/এমএস
Advertisement