দেশজুড়ে রেশমের উৎপাদন বাড়ছে। প্রতি বছরই বাড়ছে রেশম চাষের আওতা। কিন্তু দীর্ঘদিন বন্ধ রয়েছে সরকারি দুটি রেশম কারখানা। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় কিছু কারখানা চালু থাকলেও সেগুলোতেও নেই ব্যাপক উৎপাদনে যাওয়ার সুযোগ। ফলে দেশে রেশম শিল্প সম্প্রসারণ পড়েছে চ্যালেঞ্জের মুখে।রেশম উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, নগরীর শিরোইল বাস টার্মিনাল এলাকায় ১৯৬১ সালে সাড়ে ১৫ বিঘা জমির ওপর স্থাপন করা হয় রেশম কারখানা। লোকসানের কারণে ২০০২ সালে কারখানাটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ওই সময় কারখানায় কর্মরত ৫৮১ শ্রমিক বেকার হয়ে যান। পাশাপাশি রেশমকে ঘিরে আরও প্রায় ৫০ হাজার পলুচাষি বেকার হয়ে পড়েন। সেসময় আন্দোলন করেও কারখানাটি চালু করতে পারেনি নগরবাসী। হতাশা থেকে এ অঞ্চলের পলুচাষিরাও চাষ কমিয়ে দেন। ১৯৭৪ সালে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের জন্য ঠাকুরগাঁওয়ে এক দশমিক ১১ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত রেশম কারখানাটিও একই কারণে একই সময়ে বন্ধ হয়ে যায়।২০০৭ সালে রাজশাহী রেশম কারখানা প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের অধীনে চলে যায়। সেসময় তারা দু`দফা বিক্রি এবং লিজ দেওয়ার চেষ্টা করেও নেওয়ার লোক পায়নি। ২০১১ সালের ১৮ আগস্ট অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত রাজশাহী রেশম কারখানা পরিদর্শন করে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) মাধ্যমে কারখানাটি চালু করার বিষয়ে মত দেন। তবে প্রাইভেটাইজেশন কমিশন কারখানাটি ফিরিয়ে দিতে রাজি হয়নি। ২০১৩ সালের মার্চ মাসে রেশম বোর্ড, রেশম গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ সিল্ক ফাউন্ডেশনকে একত্রীকরণ করে `বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ড` গঠন করা হয়। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় কারখানাটি ফেরত চাইলে মন্ত্রণালয় এবং প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের মধ্যে আবারও রশি টানাটানি শুরু হয়। ফলে থমকে যায় সেই উদ্যোগও। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দীর্ঘদিন রেশম কারখানা দুটি বন্ধ থাকায় মূল্যবান মেশিনপত্র ও যন্ত্রপাতিগুলোর উৎপাদন কার্যক্ষমতা হারিয়েছে। এছাড়া রেশম কারখানা দুটি বন্ধ থাকার সত্ত্বেও বিদ্যুৎ বিল, পৌরকর, খাজনা, পরিস্কার-পরিচ্ছন্নকরণ, নিরাপত্তা ইত্যাদি খাতে বছরে প্রায় ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা খরচ হচ্ছে। কিন্তু সরকারিভাবে এ খরচ মেটানোর জন্য কোনো বরাদ্দ দেয়া হয় না।এদিকে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, রেশম বোর্ডের আওতায় দেশজুড়ে রেশম বীজাগার বা নার্সারি রয়েছে ১০টি। এসব নার্সারিতে চলছে পলুপালন ও তুঁতচাষ। রোগমুক্ত ডিম উৎপাদন হচ্ছে এর মধ্যে সাতটি নার্সারিতে। এছাড়া দুটিতে বীজগুটি উৎপাদন ও একটিতে মাতৃজাত ব্যবস্থাপনা চলছে। তবে সবকটিতেই কাজ চলছে সীমিত পরিসরে। দেশে প্রান্তিক পর্যায়ে রেশম চাষ ছড়িয়ে দিতে কাজ করছে রেশম উন্নয়ন বোর্ড। এরই অংশ হিসেবে বাস্তবায়তি হচ্ছে ‘বাংলাদেশে রেশম শিল্পের সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের জন্য সমন্বিত পরিকল্পনা’ শীর্ষক একটি প্রকল্প। ২০১৩-২০১৪ অর্থ বছরে শুরু হওয়ায় এ প্রকল্প শেষ হবে ২০১৬-২০১৭ অর্থ বছরেই। এ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ কোটি ৮০ লাখ টাকা। সময় ফুরিয়ে এলেও এখনো প্রকল্পের অনেক কাজই বাকি।প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, উৎপাদিত রেশম গুটি বাজারজাতকরণে সহায়তা প্রদান ও গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংসহানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে এ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। ওই প্রকল্পের আওতায় দেশে ২০টি রেশম পল্লী স্থাপন করা হবে। এছাড়া ১০ লাখ তুঁতচারা উৎপাদন ও রোপণ, ১২ লাখ রেশম কীটের রোগমুক্ত ডিম উৎপাদন হবে। এতে ৪ হাজার ৭৫০ জন নুতন রেশম চাষি যুক্ত হবেন। পুরো প্রকল্পে ২ হাজার ৫৩০ জন রেশম চাষিকে রেশমের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রশিক্ষণ, তুঁতচাষ ও পলুপালনে আর্থিক সহায়তা ও সরঞ্জামাদি দেয়া হবে।তবে প্রকল্পের শেষ বছরে এসে স্থাপন হয়েছে ১০টি রেশম পল্লী। প্রতিটি পল্লীতে গড়ে ৭০ জন করে চাষিকে রেশম চাষে যুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া ৩০০ বক্ল তৈরি হয়েছে। প্রতিটি ব্লকে ৫ জন চাষিকে দেয়া হয়েছে ২০০টি করে তুঁতচারা। আর দুটি আশ্রয়ন প্রকল্প চাষি সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটিতে ২৫ জন করে চাষি সম্পৃক্ত হয়েছেন। তবে রেশম গুটি উৎপাদনে যেতে আরো অন্তত দু`বছর অপেক্ষা করতে হবে। চলমান ওই প্রকল্পে ১০ লাখ তুঁতচারা উৎপাদন ও রোপণ করার কথা। এতে ১২ লাখ রেশম কীটের রোগমুক্ত ডিম উৎপাদন হবে। এ কর্মযজ্ঞে ৪ হাজার ৭৫০ জন নুতন রেশম চাষি যুক্ত হবেন। পুরো প্রকল্পে ২ হাজার ৫৩০ জন রেশম চাষিকে রেশমের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রশিক্ষণ, তুঁতচাষ ও পলুপালনে আর্থিক সহায়তা ও সরঞ্জামাদি দেয়ার কথা।২০১৬ সালের নভেম্বর মাসের প্রতিবেদনে রেশম বোর্ড জানায়, গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ‘বাংলাদেশে রেশম শিল্পের সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের জন্য সমন্বিত পরিকল্পে মোট ব্যয় হয়েছে ২২৪ কোটি ১৪ লাখ টাকা। যা মোট বরাদ্দের ২৪ দশমিক ৯০ শতাংশ। গত নভেম্বরে বরাদ্দ এসেছে ৯ কোটি টাকা। পার্বত্য চট্রগ্রামের জেলাসমুহে রেশম চাষ সম্প্রসারণ প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ২৫ শতাংশ। যা টাকার অংকে ৮ কোটি ২৫ লাখ। আর্থিক বিষয়ে রয়েছে ৬১৩টি অডিট আপত্তি। নানান অনিয়মে জড়িয়ে পড়ায় কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে হয়েছে ১৪টি বিভাগীয় মামলা।এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেশম বোর্ডের উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ বিভাগের সদস্য সেরাজুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে ১০টি আদর্শ রেশম পল্লী, ৩০০টি ব্লক ও দুটি আবাসন প্রকল্পের প্রতিটিই প্রায় ২০ শতাংশের উপরে উৎপাদন শুরু হয়েছে। এর আগের বছর উৎপাদন ছিল ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। আগামী বছর তা দ্বিগুন হয়ে যাবে। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় চালু কারখানাগুলো রেশম গুটি ও সূতা সংগ্রহ করায় আপাতত সমস্য হচ্ছে না। তবে উৎপাদন আরো বাড়লে সমস্য বাড়বে। সরকারি দুটি রেশম কারখানা বন্ধ থাকায় চ্যালেঞ্জ থেকেই যাচ্ছে। অন্যদিকে, বোর্ডের সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক আতিকুর রহমান বলেন, সময়মত অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ায় কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নেই পর্যাপ্ত জনবল।এ ব্যাপারে বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক আনিস-উল-হক ভূঁইয়া বলেন, সরকার নতুন করে বন্ধ কারখানাগুলো চালুর বিষয়ে ভাবছে। বন্ধ রেশম কারখানা চালুর নীতিগত সিদ্ধান্ত থাকলেও কবে তা বাস্তবায়ন হচ্ছে সেটিই দেখার বিষয়। এছাড়া সম্প্রতি জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলেও জানান তিনি। এফএ/এমএস
Advertisement