বিশেষ প্রতিবেদন

এক নদী বাঁচাতে ৪ নদী ধ্বংস

বিষাক্ত আবর্জনা ও ট্যানারির বর্জ্যের কারণে ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গা নদী মৃত প্রায়। দূষণ থেকে বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতে হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্পকে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত হয় সাভারে। যেখানে এখনো পরিকল্পিত ডাম্পিং স্টেশনই গড়ে ওঠেনি। সরকারি তদারকি ও নজরদারির অভাব এবং নিয়ম অমান্য করে সেখানেও শুরু হয়েছে নদী দূষণ।ট্যানারির বর্জ্য পরিশোধন না করে সরাসরি ও আংশিক পরিশোধিত বর্জ্যের ড্রেনেজের লাইন সংযুক্ত করা হয়েছে নদীর জলধারায়। এ কারণে ধলেশ্বরী, কালিগঙ্গা, বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদী একই সঙ্গে দূষিত হবে। কারণ এই চারটি নদী একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত।পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, এক নদী বাঁচাতে ট্যানারি স্থানান্তর করা হয়েছে। কিন্তু সেখানেও যদি তদারকি না হয়, নিয়ম না মানা হয় তবে তা আরও মারাত্মক ক্ষতির কারণ হবে। ৪ নদীকে ধ্বংস করবে। ট্যানারি স্থানান্তরের জন্য পরিকল্পিতভাবে শিল্প নগরায়ন গড়ার কোনো বিকল্প নেই।পরিবেশবাদী সংগঠকরা বলছেন, পরিবেশ নীতির বিষয়গুলো তোয়াক্কা না করায় দূষিত হচ্ছে ৪টি নদীর পানি। শুরুতেই যদি নদী দূষণের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে মানা না হয়, তাহলে গাজীপুরের যেখানে ট্যানারি স্থানান্তর হচ্ছে সেখানকার বর্জ্য দিয়েও নদী দূষণ হবে।সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বুড়িগঙ্গার ৬০ শতাংশ দূষণ হচ্ছে শিল্প কারখানার বর্জ্যের কারণে। বুড়িগঙ্গা নদী দূষণের বড় দায় ট্যানারি শিল্পের। সরকার নানা চাপে ও পরিস্থিতি অনুধাবন করে ট্যানারি শিল্প স্থানান্তরের ঘোষণা দিয়েছে। সে লক্ষ্যেই সাভারের হেমায়েতপুরের হরিণধরা গ্রামের ধলেশ্বরী নদীর পাশে ১১৯ একর জমিতে গড়ে তোলা হয় বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক)।ঘোষণা অনুযায়ী, গত ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ট্যানারি শিল্প স্থানান্তর করার কথা থাকলেও মাত্র ৩৪ কারখানা স্থানান্তর করা হয়। নতুন করে এক মাসের সময় বেঁধে দেয়া হয়। এই সময়ের মধ্যে ট্যানারি শিল্প স্থানান্তর করতে হবে ব্যবসায়ীদের।সাভারের চামড়া শিল্পাঞ্চল সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, চামড়া শিল্পনগরী প্রকল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ কম্পোনেন্ট হিসেবে নির্মাণ হওয়ার কথা কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি)। কিন্তু সিইটিপি-এর অনেক অপরিহার্য অংশ এখনো নির্মাণ করা হয়নি।চামড়া বর্জ্য শোধনের জন্য ডাম্পিং স্টেশন নির্মাণ আবশ্যক। তাও সম্পন্ন হয়নি। কিন্তু এর মধ্যে সব ট্যানারি সেখানে স্থানান্তরের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। নির্দেশনা মেনে গেছেও ৩৪টি শিল্প প্রতিষ্ঠান। ইতোমধ্যে স্থানান্তর হওয়া ৩৪টি কারখানার বর্জ্যই ভারি হয়ে ওঠেছে স্থানীয় বাতাস। দুর্গন্ধে আশপাশে যাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে বিক্ষুব্ধ স্থানীয়রাও। এখন ডাম্পিং স্টেশনের কাজ শুরু করলেও নির্মিত হতে সময় লাগবে কমপক্ষে এক বছর।লবন পানি শোধণের কাজও শুরু হয়নি। এ অবস্থায় ৩টি কারখানার চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ শুরু হয়েছে। যা নিয়মিত বর্জ্য উৎপাদন ও নিঃসরণ করছে। এ সমস্ত বর্জ্য অপরিশোধিত অথবা আংশিক পরিশোধিত অবস্থায় পার্শ্ববর্তী ধলেশ্বরীতে ফেলা হচ্ছে। অনেক কারখানার ড্রেনেজ লাইন সরাসরি ধলেশ্বরী নদীর জলাধারেও লাগানো হয়েছে। যা চুইয়ে চুইয়ে মূল নদীতে মিশছে।বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এর যুগ্ম সম্পাদক শরীফ জামিল জাগো নিউজকে বলেন, নিঃসন্দেহে ট্যানারি শিল্প বাংলাদেশের রফতানিযোগ্য প্রধান শিল্প। কিন্তু এ জন্য পরিবেশকে ব্যাপক খেসারত দিতে হয়। তাই পরিকল্পিত শিল্প এলাকায় চামড়া শিল্প গড়ে তোলার জন্য আন্দোলন চলছে দীর্ঘদিন থেকে।তিনি বলেন, ট্যানারি যেখানেই স্থানান্তর করেন না কেনো, তা হতে হবে পরিকল্পিত। ট্যানারির বর্জ্য যদি পরিশোধিত না হয়ে নদীতেই যায় তাহলে স্থানান্তর করে লাভ কি? কিন্তু বাস্তবিক অর্থে সেটাই দেখছি সাভারে। বুড়িগঙ্গা নদী বাঁচাতে গিয়ে আমরা ট্যানারি স্থানান্তর করে নিয়ে আসছি সাভারে। সেখানেও যদি পরিবেশ রক্ষার বিয়ষগুলো না মেনে শিল্প গড়ে উঠে তবে সেখানেই নদী দূষণ হবে। সবচেয়ে ক্ষতির বিষয়টি হচ্ছে। এখানে এক নদীর বদলে ৪ নদী, ধলেশ্বরী, কালিগঙ্গা, বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ একই সঙ্গে দূষিত হবে। কারণ ধলেশ্বরীর সঙ্গে অন্য নদীর সম্পর্ক রয়েছে।বিশিষ্ট লেখক গবেষক ও বাপার সহ-সভাপতি সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ট্যানারি নিয়ে অনেক সংবাদ প্রতিবাদ ও আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজটি হয়নি। আমরা নদী বাঁচাতে চাইবো কিন্তু নিয়ম মানবো না, নজরদারি রাখবো না তা কি করে হয়? সরকারেই ঘোষণা দিয়েছে সাভারে যাবে ট্যানারি। সেখানে নিয়ম মেনে ও সঠিক সময়ে সব কিছু হচ্ছে কিনা তা দেখা সরকারেরই দায়িত্ব।গ্রিন ফয়েস এর সমন্বয়ক আলমগীর কবির বলেন, আমরা দীর্ঘদিন থেকে সরকারকে ট্যানারি স্থানান্তরের কর্মকাণ্ডে একটি বিষদ পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা কঠোরভাবে বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়ে আসছি। কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তা আমলে নেয়নি বলেই আজ নতুন করে দূষিত হচ্ছে ৪টি নদী।রিভারাইন পিপল এর মহাসচিব শেখ রোকন বলেন, সরকার কি ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে, সরকার আদৌ নিজেদের করা ঘোষণা সম্পর্কে ও কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল কিনা তা স্পষ্ট হওয়া জরুরি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) এবং মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. শহীদ আক্তার হোসাইন জাগো নিউজকে বলেন, বাকি কারখানা স্থানান্তর করার আগে অবশ্যই পরিকল্পনা অনুযায়ী সব ধরনের অবকাঠানো নির্মাণ কাজ শেষ করতে হবে। নইলে বিপর্যয় আরও বেশি হতে পারে।পরিবেশবাদী সংগঠন বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, সরকার ট্যানারি স্থানান্তরে যেভাবে কাজ করছে তাতে মনে হয়, পরিবেশ আইন, নদী দূষণ আইন কোনো কিছুই কারখানার মালিকদের জন্য প্রযোজ্য নয়।জেইউ/এআরএস/জেআইএম

Advertisement