দেখতে দেখতে সময় বয়ে যাচ্ছে। তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ শেষে এখন টি-টোয়েন্টি সিরিজও প্রায় শেষের পথে। কিন্তু নিউজিল্যান্ড সফরে ‘জয়’ এখনো সোনার হরিণ। সুযোগ তৈরি হচ্ছে। সম্ভাবনাও উঁকিঝুঁকি মারছে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সাফল্যের দেখা মিলছে না। একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছেন টাইগাররা। অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা প্রায় প্রতিদিন স্বদেশি প্রচারমাধ্যমের সামনে আসছেন, আর বলছেন, ‘চেষ্টা চলছে। সম্ভাবনা ও সুযোগ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু তা কাজে লাগিয়ে সাফল্যের ফসল ঘরে তোলা যাচ্ছে না। কিছু কিছু ভুল ত্রুটি থেকেই যাচ্ছে। আমরা টিম পারফরম্যান্স করতে পারছি না।’বিচ্ছিন্ন পারফরম্যান্স হচ্ছে। কিন্তু পুরো দল হিসেবে খেলা সম্ভব হচ্ছে না। আজও হারের পর প্রায় একই কথা টাইগার অধিনায়কের মুখে। টি-টোয়েন্টি সিরিজেও অধিনায়কের আশা পূরণ হবে কিনা সন্দেহ। ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিং- তিন বিভাগ এক সঙ্গে জ্বলে উঠবে কবে? এ সফরে কি আদৌ টিম পারফরম্যান্সের দেখা মিলবে?যত দিন গড়াচ্ছে, ততই প্রশ্ন জোরালো হচ্ছে। টিম পারফরম্যান্স বহদূরে, যারা চালিকাশক্তি, যাদের পারফরম্যান্স সারা বছর টিম বাংলাদেশের প্রাণশক্তি, সেই তামিম, সাকিব আল হাসান ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ কেমন যেন নিষ্প্রভ। সমালোচকদের ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়, এই তিন স্তম্ভ এখন পর্যন্ত প্রত্যাশা মেটাতে পারেননি। তামিম বিপিএলে যা খেলেছেন, তার ছিটেফোঁটাও খেলতে পারছেন না নিউজিল্যান্ডে এসে। সাকিবও তথৈবচ। মাহমুদউল্লাহ প্রথম টি-টোয়েন্টি ম্যাচ বাদ দিলে পুরো সফরে অনুজ্জ্বল। একজন পেসার নিজেকে মেলে ধরতে পারছেন না। অধিনায়ক মাশরাফি তার মেধা, বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। প্রতিপক্ষ শিবিরে কাঁপন ধরাতে না পারলেও মাশরাফি এখনো অনেক বড় নির্ভরতা। তার বুদ্ধিদীপ্ত বোলিংটা এখনো দলের অন্যতম সেরা সম্পদ। কিন্তু কঠিন সত্য হলো, মাশরাফি স্বর্ণ সময় পেছনে ফেলে এসেছেন। এখন আর তার কাছ থেকে বিধ্বংসী স্পেল প্রতি ম্যাচে তিন-চার উইকেট আশা করা কঠিন। কিন্তু নিউজিল্যান্ডের গতি ও বাউন্সি পিচে যাদের তেতে ওঠার কথা, সেই রুবেল-তাসকিনরা অজানা কারণে নিষ্পৃহ। নিজেকে মেলে ধরার আদর্শ জায়গায় এসে এই সব দ্রুত গতির বোলাররা উল্টো নিজেদের খুঁজে ফিরছেন। পুরো সিরিজে পেসারদের একটি বারুদ মাখা স্পেল চোখে পড়েনি। অথচ ২০০১ সালে নিউজিল্যান্ড সফরে প্রথমবার এসে কি ভয়ঙ্কর বোলিংটাই না করেছিলেন মাশরাফি। তখনকার ১৯ বছরের তেজদীপ্ত যুবা বল করতেন ১৪০ কিলোমিটার গতিতে। তার বাউন্সারে বেসামাল ছিলেন কিউই ব্যাটসম্যানরা। এক ট্যুর ম্যাচে মাশরাফির বাউন্সারে বেসামাল এক কিউই ব্যাটসম্যানের চোখে আঘাত পেয়ে ভুগেছেন অনেকদিন। আর এখন সেই মাশরাফির উত্তরসূরীদের খুঁজে পাওয়া যায় না। মোস্তাফিজ সবে অপারেশনের ধকল কাটিয়ে মাঠে ফিরেছেন। তাকে কিছু সময় দিতেই হবে। তাসকিন-রুবেলও সে অর্থে প্রত্যাশা পূরণ করতে পাররছেন না। অনুকূল কন্ডিশনে কোথায় উজ্জ্বীবিত থাকবেন? ১৩৫ থেকে ১৪০ কিলোমিটার গতিতে বল করবেন। বাউন্সার ছুড়বেন। ইয়র্কারে উইকেট উপড়ে নেবেন। তা না এ দুই দ্রুত গতির বোলারও যেন ভালো করার উদ্যম হারিয়ে ফেলেছেন। একটা এক্সপ্রেস ডেলিভারি চোখে পড়েনি এখনো। এতো গেল পেসার কথা, এবার আসা যাক ব্যাটসম্যানদের প্রসঙ্গে। সাব্বির রহমান রুম্মন আশা জাগাচ্ছেন। কিন্তু ঠিক একটা পর্যায়ে গিয়ে হতাশায় ডুবিয়ে ফিরে আসছেন। সৌম্য এতদিন নিজেকে খুঁজে ফিরে অবশেষে রানের মুখ দেখলেন। তরুণ মোসাদ্দেকও একটা জায়গায় এসে আটকে গেছেন। অন্যতম বড় নির্ভরতা মুশফিকুর রহীম হ্যামস্ট্রিং ইনজুরির কারণে বাইরে। তিন মূল স্তম্ভ সাকিব, তামিম ও মাহমুদউল্লাহ নিজেদের সেরাটা দিতে পারছেন না। আর এই কারণেই মাশরাফি বাহিনী কেমন যেন ফ্যাকাশে। বিবর্ণ। মুখে সবাই টিম পারফরম্যান্সের কথা বলছেন। কিন্তু জায়গামতো তারা নিজেরাই তা করতে পারছেন না। টিম পারফরমেন্স ততক্ষণ হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত প্রতিটি সদস্যের অবদান না থাকবে। শুনতে খারাপ লাগলেও নির্জলা সত্য, এখন পর্যন্ত এ সফরে একজন পারফরমারও ধারাবাহিকভাবে ভালো করতে পারেননি। এমন কাউকে দেখা যাচ্ছে না, যিনি একাই জ্বালিয়ে রাখছেন সম্ভাবনার প্রদীপ। টিম পারফরম্যান্স অনেক দূরে, একজন ব্যাটসম্যান, একজন পেসার আর একজন স্পিনার যদি মোটামুটি ধারাবাহিকভাবে ভালো করতেন তাহলেও যা হচ্ছে তার চেয়ে উজ্জ্বল কিছু হতো। কিন্তু কিছুই হচ্ছে না। একটি করে জুটি জমে উঠছে। ভক্ত-সমর্থকরা আশার জাল বুনছেন। একটা সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে। তারপর একটা পর্যায়ে গিয়ে জুটি ভেঙ্গে যাওয়া। ঠিক তারপর বালির বাঁধের মতো সব ভেঙ্গে পড়া। পুরো সিরিজে এই পর্বই চলছে। আজও তা-ই হলো। শুরুতে মাশরাফি, সাকিব আল মোসাদ্দেকের কার্যকর বোলিংয়ে ব্যাকফুটে কিউইরা। কোথায় চেপে বসা টাইগাররা আরও উজ্জ্বীবিত হয়ে ব্ল্যাক-ক্যাপসদের টুটি চেপে ধরবেন। তা না উল্টো নিজেরাই আলগা বোলিং, বাজে ফিল্ডিং করে পেছনে চলে গেলেন। একই অবস্থা ব্যাটিংয়েও। ইমরুল কায়েস ক্রিজে গিয়েই স্লোগ সুইপ আর সাইড শট খেলতে চেষ্টা করছেন। সেটাই কাল হচ্ছে। দল ভুগছে। কিন্তু সেখান থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা নেই। সাব্বির বারবার বলছেন, ‘আমি লম্বা ইনিংস খেলতে মুখিয়ে আছি।’ কিন্তু জায়গামতো একটা পর্যায়ে গিয়ে ফিরে আসছেন। শেষ কথা হলো, তামিম, সাকিব ও মাহমুদউল্লাহকে জ্বলে উঠতে হবে। তামিম ইকবালের ব্যাট থেকে লম্বা ইনিংস আসা জরুরি। তামিম ভালো খেলা মানেই দল চাঙ্গা হওয়া। সব্যসাচী সাকিবের সেই চেনা রুপটা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। সেটা ফিরে আসা জরুরি। আর খুব দরকার বিশ্বকাপের সেই মাহমুউল্লাহকে। টিম পারফরম্যান্স আপনা-আপনি ভালো হয়ে যাবে। হোক তা টি-টোয়েন্টি ফরম্যাট, তামিম ৪০ /৪৫ বলে ৬০-৬৫ রানের ইনিংস খেলে দিন। সাকিব ও মাহমুদউল্লাহর ব্যাট কথা বলুক, আপনা-আপনি ব্যাটিংয়ের দৈণ্য দশা কেটে যাবে। আর ব্যাটিং ভালো হলে বোলিং দুর্বলতাও কেটে যাবে। ইতিহাস ও পরিসংখ্যান তা-ই জানাচ্ছে। যখন বাংলাদেশের ব্যাটি ভালো হয়, ব্যাটসম্যানরা ছন্দে ও ফর্মে থাকেন- তখন সব ভালো হয়। আর ব্যাটিং খারাপ হলে সব যেন কোথায় হারিয়ে যায়! এই যেমন এখন দেখা মিলছে না সেই গত বিশ্বকাপ ও তার পরের সময়ের বাংলাদেশের।এনইউ/পিআর
Advertisement