জামালপুরে আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা। কম মজুরি কিন্তু, কাজ বেশি করিয়ে নিতে পারায় জামালপুরের অধিকাংশ মোটর গ্যারেজ, ওয়ার্কসপ আর হোটেলগুলোতে শিশু শ্রমিক দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করাচ্ছে মুনাফা লোভী মালিকেরা। আর চরম ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে আসা এসব শিশুরা শিকার হচ্ছে মজুরি বৈষম্যের।মনির হোসেন, বয়স পাঁচ কি ছয়? পেশায় মোটর মেকানিক। জন্মের পর বাবাকে দেখছে কিনা মনে নেই মনিরের। বাবা চলে গেছে অন্য কোথাও, আর মা বিয়ে করেছেন আরেকটি। এখন মনিরের অভিভাবক বলতে নানা-নানীই। এই বয়সে বইখাতা হাতে নিয়ে স্কুলে যাবার কথা থাকলেও, দুমুঠো ভাতের আশায় ঝুঁকিপূর্ণ গাড়ি মেরামতের কাজ করছে মনির। শহরের বেলটিয়া এলাকার মনির তার কচি হাতে লোহার লিবার ঘুরিয়ে গাড়ির চাকা মেরামত আর কলকব্জা ঘেটে সারাদিন শেষে দৈনিক মজুরির দশটি টাকা তুলে দেয় তার নানা-নানীর হাতে। শুধু মনির হোসেনই নয়, ফার্নিচার দোকানের শ্রমিক আনন্দ, চা স্টলের শ্রমিক দুইভাই জনি ও যুবরাজ, মোটরসাইকেল গ্যারেজের শ্রমিক মুক্তারুজ্জামান, ওয়ার্কসপ শ্রমিক রতন সবার গল্প কমবেশি একই রকম।জামালপুর জেলার প্রায় অর্ধলক্ষাধিক শিশু মোটর গ্যারেজ, ওয়ার্কসপ, ওয়েল্ডিং সপ, ফার্নিচার দোকান, হোটেল, চায়ের দোকান, বিড়ি কারখানা, ইটভাটা ছাড়াও কৃষি কাজের মতো ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় জড়িত। শুধুমাত্র জামালপুর পৌরসভার মধ্যেই প্রায় সাড়ে তিন হাজার শিশু বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ পেশার সাথে জড়িত। আর এসব ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় জড়িত শিশু শ্রমিকরা কেউ এসেছে সংসারের অভাবের তাড়নায় আবার কেউ পারিবারিক কলহের শিকার।ঝুঁকিপূর্ণ কাজ জেনেও অভাবের সংসারে দু’পয়সা উপার্জনের আশায় বাবা-মা তাদের শিশুদের কলকারখানায় পাঠালেও কাজ করতে আসা এসব শিশুরা শিকার হচ্ছে চরম মজুরি বৈষম্যের। মোটর গ্যারেজ, চায়ের দোকান, লোহা ঝালাইয়ের মতো কঠিন কাজে ৮ ঘণ্টারও বেশি সময় শ্রম দিয়ে ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে কোমলমতি শিশুরা। প্রাপ্ত বয়স্ক শ্রমিকদের যেখানে দৈনিক ৪শ থেকে ৫শ টাকা মজুরি দেওয়া হচ্ছে, সেখানে কাজ শেখানোর অজুহাতে মুনাফা লোভী মালিকরা শিশু শ্রমিকদের মজুরি দিচ্ছে মাত্র ১০ থেকে ৫০ টাকা করে।শহরের চাপাতলাঘাট এলাকার ফার্নিচার দোকানের শ্রমিক আট বছরের আনন্দ জানায়, বাবা এক সময় সেলুনে চুল কাটার কাজ করতো, নেশায় জড়িয়ে পড়ায় সেই কাজ ছেড়ে দেয়। তারপর থেকেই সংসারে শুধুই অভাব। তাই দুমুঠো ভাতের আশায় দৈনিক বিশ টাকা মজুরিতে ফার্নিচারের দোকানে কাজ করছে আনন্দ। চায়ের দোকানের শ্রমিক দুই ভাই জনি ও যুবরাজ জানায়, দৈনিক বিশ টাকা মজুরিতে চায়ের দোকানে কাজ করছে তারা। বাবা পেশায় ভ্যানচালক, একার রোজগারে সংসার চলেনা। বাবাই চায়ের দোকানে কাজে রেখে গেছেন তাদের। তাই সংসারে অভাব দূর করতে সারাদিন কাজ করে দুই ভাইয়ের মজুরির চল্লিশ টাকা দিন শেষে তুলে দেয় বাবার হাতে।জেলার সাত উপজেলায় প্রতিদিন হাজার হাজার শিশু শ্রমিক প্রকাশ্যে বিভিন্ন মোটর গ্যারেজ, ওয়ার্কসপ, ঝালাইয়ের দোকানে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে গেলেও, শিশু শ্রম বন্ধে সরকারি ভাবে কার্যকর প্রদক্ষেপ নিতে দেখা যায়না। জামালপুরে শিশু শ্রম বন্ধে বহুদিন আগে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি কমিটি গঠন করা হয়, কিন্তু সেই কমিটি মাঠে কোনো কর্মকাণ্ড না করলেও প্রতিবছর বিভিন্ন দিবসে সভা-সেমিনার আর ভাষণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের কম মজুরি দিয়ে কাজ বেশি করিয়ে নিতে পারায় মুনাফা লোভী মালিকরা তাদের প্রতিষ্ঠানে বেশি বেশি শিশুদের শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দিচ্ছে। ফলে জামালপুরে দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে বেড়েই চলেছে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা।এ ব্যাপারে জামালপুর জেলা শিশু সুরক্ষা নেটওয়ার্কের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর সেলিম জানান, দারিদ্রতা এবং বছর বছর নদী ভাঙন জামালপুরের প্রধান সমস্যা। যে কারণে অভাবের তাড়নায় বাবা-মায়েরা তাদের শিশুদের বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে পাঠাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে দারিদ্র নিরসনের পাশাপাশি স্কুলগুলোতে খাদ্য কর্মসূচির মাধ্যমে শিক্ষার ব্যবস্থা চালু করা হলে শিশু শ্রম বন্ধ করা সম্ভব হবে বলে জানান তিনি।জামালপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আনোয়ার হোসেন জানান, শিশুশ্রম বন্ধের পাশাপাশি তাদের পূর্ণবাসনের পরিকল্পনা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে এ সংক্রান্ত একটি প্রকল্প অনুমোদন চাওয়া হয়েছে, প্রকল্প অনুমোদন পাওয়া গেলে শিশুশ্রম বন্ধের পাশাপাশি শিশু শ্রমিকদের পূর্ণবাসনে কাজ শুরু করা হবে।এমএএস/আরআই
Advertisement