গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশ ও আশপাশের দেশগুলোতে ২৫ বার ভূমিকম্প হয়েছে। এর মধ্যে গত বছর হয়েছে চার বার। সর্বশেষ চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি একই দিন দুটি ভূমিকম্প হয়। অবস্থানগত কারণে এগুলো ততটা শক্তিশালী না হলেও শক্তিশালী ভূমিকম্পের পূর্বাভাস বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।বিগত সময়ে বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি রাজ্য এবং বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। এসব ভূমিকম্প খুব বেশি শক্তিশালী না হলেও দেশের জন্য মোটেও স্বস্তিদায়ক নয়। এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. সিরাজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিগত বছরগুলোর তুলনায় দেখা গেছে এখন ঘন ঘন ভূমিকম্প হচ্ছে। ছোট ছোট ভূমিকম্প বড় ধরনের ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেয়’।বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডে দেশকে ভূমিকম্প ঝুঁকিতে ৮টি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য এলাকা। ঢাকা হচ্ছে দ্বিতীয় ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। আর তৃতীয় ঝুঁকিপ্রবণ এলাকা হচ্ছে খুলনা, রবিশাল ও সিলেট অঞ্চল।এ প্রসঙ্গে সিরাজুল ইসলাম বলেন, ভূগর্ভের যেসব স্থানে টেকটোনিক প্লেট রয়েছে সেগুলো ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। প্লেটগুলোর মধ্যে সংঘর্ষের ফলে এ ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর মধ্যে এই টেকটোনিক প্লেটপ্রবণ দেশ হচ্ছে মিয়ানমার, ভারত ও ইন্দোনেশিয়া। বিগত সময়ে দেখা গেছে, এই দেশগুলোতেই বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছে। এর কারণ হচ্ছে টেকটোনিক প্লেটের এক একটির সঙ্গে অপরটির ধাক্কা। যে জায়গাগুলোতে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে, সেগুলোকে সাবসনিক জোন বলা হয়। তিনি জানান, ওইসব স্থানে ভূমিকম্প অনুভূত হলে বাংলাদেশেও ভূমিকম্প অনুভূত হয়। তাছাড়া দেশে দুটি সাবসনিক জোন রয়েছে। ২০১৫ সালের এপ্রিল ও মে মাসে নেপালে সংঘটিত ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। গত বছরের ৪ জানুয়ারি মনিপুরের ইম্ফলে সংঘটিত হয় ৬ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প। গত পাঁচ বছর আগে সিকিমে ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এ ছাড়া গত পাঁচ বছরে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সিকিমে একটি, আসামে ছয়টি, মেঘালয়ে একটি, পশ্চিমবাংলায় তিনটি, মিজোরামে দুটি এবং মিয়ানমারে একটি ভূমিকম্প হয়। ভূমিকম্পগুলোর সবই ৫ দশমিক ৭ মাত্রার চেয়ে কম হলেও তা বাংলাদেশে অনুভূত হয়েছে।বাংলাদেশে ২০১৫ সালের ৯ জানুয়ারি ভৈরবে ৩ দশমিক ৮ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়েছে। তার মাত্র ছয়দিন পর রাঙামাটিতে ৪ দশমিক ২ মাত্রার আরও একটি ভূমিকম্প হয়।১৭ এপ্রিল রংপুরের চিলমারীতে ৪ দশমিক ২ মাত্রার একটি এবং খুলনার শরণখোলায় ৪ দশমিক ২ মাত্রায় আরও একটি ভূমিকম্প হয়। আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে, গেল বছর একই মাসে তিনটি ভূমিকম্প হয়েছে। ওই বছরের ১৯ অক্টোবর ঢাকা থেকে ১৫৬ কিলোমিটার দূরে সুনামগঞ্জের ভারত ও বাংলাদেশ সীমান্তে ৪ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। একই বছরের ২৩ আগস্ট ঢাকা থেকে ২৬২ কিলোমিটার দূরে রংপুরে ৪ দশমিক ৪ মাত্রার আরও একটি ভূমিকম্প হয়েছে। এর তিনদিন পর ২৬ আগস্ট ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকা বান্দরবানে ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এর মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ৮ । ১৫ নভেম্বর ৪ দশমিক ৬ মাত্রার আরও একটি ভূমিকম্প হয়। এটি দেশের সিলেট অঞ্চলে আঘাত হানে।এছাড়া চলতি বছরের প্রথম সপ্তাহেই গত ৩ জানুয়ারি পরপর দুটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। প্রথমটি বিকেলে ভারতের ত্রিপুরা থেকে উৎপত্তি হয়ে সারাদেশে অনুভূত হয়েছে। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৫। এটি ঢাকা থেকে ১৭৬ কিলোমিটার দূরে ভারতের ত্রিপুরায় উৎপত্তি হয়।একই দিন রাত ১২টা ৫২ মিনিটে আরও একটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়, যার মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ১। এটির উৎপত্তিস্থল মিয়ানমারের মাওলাইক এলাকা থেকে ৩৮ কিলোমিটার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে। ভূপৃষ্ঠ থেকে উৎপত্তিস্থলের গভীরতা ছিল ৯৩ দশমিক ২ কিলোমিটার।এছাড়া গত চার বছর আগে সিলেটে ৪ দশমিক ২ ও পাঁচ বছর আগে ঢাকার দোহারে ৪ দশমিক ৫ মাত্রার আরও একটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত দুই বছরের সার্বিক পর্যবেক্ষণ থেকে দেখা গেছে, দেশে ঘন ঘন ভূমিকম্প হচ্ছে। ছোট ছোট এই ভূমিকম্পগুলো যদিও বড় ধরনের কোনো বিপর্যয় ডেকে আনেনি তবে এটি তার সতর্কবার্তা দিচ্ছে। যেকোনো সময় বড় ধরনের বিপর্যয় হতে পারে।বুয়েটের প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, গত ৯০ বছরের মধ্যে আমাদের দেশে বড় ধরনের কোনো ভূমিকম্প হয়নি। আমরা বলি অতীতে হয়েছে বর্তমানেও হতে পারে। তবে পার্শ্ববর্তী দেশে যে ভূমিকম্প হচ্ছে সেগুলো আমাদের জন্য ঝুঁকি না, সতর্কবার্তা। এদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় আগাম সতর্কবার্তা চালুর পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যরা। একই সঙ্গে ওই সতর্কবার্তা বেজে ওঠার সময় বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ লাইন স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ করার প্রযুক্তি স্থাপনেরও কথা বলেছেন তারা।গত বছরের জানুয়ারিতে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসএসসিসি)মেয়রের নেতৃত্বে ২৬ সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত কমিটির প্রথম সভায় বিশেষজ্ঞরা এ আহ্বান জানান।সভায় বক্তারা বলেন, উন্নত দেশে ভূমিকম্প ও সুনামিসহ যেকোনো দুর্যোগ মুহূর্তে স্বয়ংক্রিয় সতর্কবার্তার ব্যবস্থা রয়েছে। দুর্যোগ আসার মাত্র ১৫ সেকেন্ড আগে ওই যন্ত্রটি সতর্কবার্তা দিতে থাকে। আর বার্তা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ সরবরাহ বন্ধে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র স্থাপন করতে হবে। তবেই যেকোনো আপদকালে বিদ্যুৎ বা গ্যাসের লাইন বিস্ফোরণের কারণে বড় ধরনের ক্ষতি হবে না। এ যন্ত্রটি স্থাপন করতে খরচ হবে মাত্র এক কোটি টাকা।বক্তাদের এমন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মেয়র সাঈদ খোকন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদিত প্রকল্পে বিষয়টি সংযুক্ত করার নির্দেশ দেন। কিন্তু দীর্ঘ এক বছর অতিবাহিত হলেও এটি এখনও স্থাপন করা হয়নি।সিটি কর্পোরেশন সূত্র জানিয়েছে, ভূমিকম্প মোকাবেলার জন্য ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনকে ১৭৩ মিলিয়ন ডলার অর্থ দেবে বিশ্বব্যাংক। ভূমিকম্প বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন ও ট্রেনিং) মেজর একেএম শাকিল নেওয়াজের এক প্রেজেন্টেশনে দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকার ৭৬ ভাগ সড়ক চিকন।এতে বড় ধরনের কোনো দুর্যোগ বা ভূমিকম্প আঘাত হানলে এক হাজার ১১২ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হবে।এমএসএস/ওআর/এমএস
Advertisement