ফিচার

বিস্ময়মানব বেয়ার গ্রিলস

এডওয়ার্ড মাইকেল বেয়ার গ্রিলস নামের কাউকে চেনেন আপনি? মানুষটি প্রতিদিনই অসম্ভবকে সম্ভব করে চলেন। এবার হয়তো একটু আন্দাজ করতে পারছেন। হ্যাঁ যার কথা বলছি, লম্বা-চওড়া নামের অধিকারী এই মানুষটি আপনার কাছে বিয়ার গ্রিলস  নামে পরিচিত। চিফ স্কাউট, অভিযাত্রী, লেখক, প্রেরণাদায়ক বক্তা, টেলিভিশন উপস্থাপক- এমন বিশেষ কয়েকটি গুণের অধিকারী হলেও তিনি ডিসকভারির জনপ্রিয় শো ‘ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড’র অসাধারণ উপস্থাপক ও সাহসী অভিযাত্রী হিসেবে বিশ্বখ্যাত। শুধু টিভির পর্দায় নয়, তার ব্যক্তিগত জীবনও হার মানায় রোমাঞ্চকে। এই বিস্ময়মানবকে নিয়ে জাগো নিউজের আজকের আয়োজন। বিস্তারিত জানাচ্ছেন মাহবুবর রহমান সুমনপরিচিতিবেয়ার গ্রিলস ১৯৭৪ সালের ৭ জুন নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা স্যার মাইকেল গ্রিলস ছিলেন কনজারভেটিভ পার্টির রাজনীতিবিদ এবং মা লেডি গ্রিলস। ২০০১ সালে বেয়ারের বাবা প্রয়াত হন। অন্যদিকে বেয়ার গ্রিলসের বড় বোন লারা ফসেট একজন টেনিস কোচ। লারাই বেয়ার গ্রিলসের বয়স যখন মাত্র এক সপ্তাহ তখন তার ‘বেয়ার’ নামটি দেন। বেয়ার গ্রিলস আয়ারল্যান্ডে বেড়ে ওঠেন চার বছর পর্যন্ত। এরপর তিনি তার পরিবারের সঙ্গে বেমব্রিজ অঞ্চলে চলে যান। বেয়ার গ্রিলস ২০০০ সালে সারা গ্রিলসকে বিয়ে করেন। তাদের তিন পুত্রসন্তান- জেস, মার্মাডিউক এবং হাক্লবেরি।কিশোর বেয়ার গ্রিলসছেলেবেলা থেকেই বেয়ার গ্রিলস ছিলেন ডানপিটে। বাবার কাছ থেকে নৌকা চালানো আর পাহাড়ে চড়া শিখেছেন একেবারে ছোটবেলায়। যখন তার বয়স আট তখনই তিনি কাব স্কাউট হন। সেই সময়েই বেয়ারের বাবা তাকে মাউন্ট এভারেস্টের একটি ছবি দেন। তখন থেকেই তিনি স্বপ্ন দেখতেন এভারেস্ট জয়ের। আর এই স্বপ্ন থেকেই অ্যাডভেঞ্চারের বীজ বপন হয় বেয়ার গ্রিলসের কচি মনে। কিশোর বয়সেই স্কাই ডাইভিং এবং মার্শাল আর্ট শিখে ফেলেছিলেন তিনি। এছাড়া কিশোর বয়সে যোগ ও নিনজৎসু চর্চা শুরু করেন। তিনি তার বাবাকে তার আইডল মনে করেন।পড়াশোনা ও প্রশিক্ষণইটন হাউস, লুগ্রোভ স্কুল এবং ইটন কলেজে পড়াশোনা করেছেন। ইটন কলেজের ছাত্রাবস্থায় তিনি সেখানকার প্রথম পর্বতারোহণ ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। স্কুলজীবন শেষ হওয়ার পর বেয়ার গ্রিলস ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার উৎসাহ প্রকাশ করেন। সেই সময়ে তিনি সিকিম অঞ্চলে হিমালয়ে হাইকিং করেন। পরে অবশ্য তিনি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং ইউনাইটেড কিংডম স্পেশাল ফোর্স রিজার্ভে কাজ করেন। স্পেশাল এয়ার সার্ভিসে তিনি ১৯৯৬ পর্যন্ত তিন বছর কাজ করেন। মানবসেবায় অবদান রাখার জন্য ২০০৪ সালে গ্রিলসকে সম্মানসূচক পদ লেফটেন্যান্ট কমান্ডারে পদোন্নতি দেয়া হয়। সেনাবাহিনীতে থাকাকালীন তিনি বিভিন্ন পরিবেশে বেঁচে থাকার কলাকৌশলগুলো রপ্ত করেন। ২০০৫ সালে ২৪,৫০০ ফুট উঁচুতে প্যারাসুটে উঠে ডিনার করার অবিশ্বাস্য রেকর্ডটাও বেয়ার করেছেন। তার মতো স্কাই ডাইভার পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া কঠিন। এছাড়া ২০০৯ সালে ৩৫ বছর বয়সে পৃথিবীর সর্বকনিষ্ঠ চিফ স্কাউট হিসেবে স্কাউট অ্যাসোসিয়েশনে নিযুক্ত হন। বেয়ার গ্রিলস ইংরেজি, স্প্যানিশ এবং ফরাসি ভাষা জানেন। অন্যদিকে বেয়ার কারাতে ব্ল্যাক বেল্ট প্রাপ্ত। ধর্মে তিনি একজন খ্রিস্টান এবং ধর্মবিশ্বাসকে তার জীবনের ‘মেরুদণ্ড’ মনে করেন।বাতিল বেয়ার গ্রিলসকেবল টিভির পর্দায় নয়, বাস্তব জীবনেও প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি প্রমাণ করেছেন অদম্য ইচ্ছা থাকলে জয় করা সম্ভব যেকোন প্রতিকূলতাকেই। বর্তমানের দুনিয়া কাঁপানো দুঃসাহসী বেয়ার গ্রিলসকে এক সময় বাতিলের খাতায় ফেলে দেয়া হয়েছিল! এমনকি ধারণা করা হয়েছিল- চিরতরে হাঁটার ক্ষমতাই হারিয়ে ফেলবেন তিনি। ১৯৯৬ সালে জাম্বিয়ায় একটি প্যারাসুট দুর্ঘটনার সম্মুখীন হন তিনি। দুর্ঘটনায় তার মেরুদণ্ডের তিনটি হাড় ভেঙে যায়। তখন তার পিঠের হাড় এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যে ডাক্তাররা বলেই দিয়েছিলেন, তার সুস্থ হওয়ার তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই। ফলে বাধ্যতামূলকভাবেই সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিতে হয় তাকে। পরবর্তী বারো মাস গ্রিলস সামরিক বাহিনীর সব কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকেন ঠিকই কিন্তু হার মানেননি। মেডিকেল সায়েন্স আর সবাইকে অবাক করে দিয়ে কয়েক মাসের মধ্যেই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠলেন।সর্বকনিষ্ঠ এভারেস্টজয়ী১৯৯৬ সালের সেই প্যারাসুট দুর্ঘটনার পর প্রায় এক বছরের বেশি সময় বেয়ার সব কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকেন। সুস্থ হয়ে ওঠার পর তখনই শৈশবের লালিত স্বপ্ন মাউন্ট এভারেস্ট জয় করার নেশা চেপে বসে মনে। অদম্য বেয়ার তার দুর্ঘটনার ১৮ মাসের মধ্যেই মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় চড়েন। মাউন্ট এভারেস্ট জয় করতে তার সময় লেগেছিল মাত্র ৯০ দিন। ১৯৯৮ সালের ১৬ মে মাত্র ২৩ বছর বয়সে শৈশবের লালিত স্বপ্ন মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেন তিনি। এভারেস্ট জয়ের মাধ্যমে মাত্র ২৩ বছর বয়সে তিনি গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে ব্রিটিশ হিসেবে এভারেস্ট জয়ের রেকর্ড গড়েন। যদিও তার ওই রেকর্ড চার বার ভাঙা হয়। বাবার কাছ থেকে পাওয়া বেয়ারের যে শুধু এভারেস্ট জয় করার কৃতিত্ব রয়েছে তা কিন্তু নয়। ডেমন্ড হিলারির পর সবচেয়ে কম বয়সে ব্রিটেনের হয়ে হিমালয়ের সবচেয়ে দুর্গম শৃঙ্গ ‘আমা ডাবলান’ পিক জয়েরও রেকর্ড রয়েছে বেয়ারের। বেয়ার তার আত্মজীবনী ‘ম্যাড সোয়ে অ্যান্ড টিয়ারস’- এ লিখেছেন- ২৬ মে ১৯৯৮ সালের সকালটা তার জীবনের সেরা সকাল। তিনি সেদিন পৃথিবীর সূর্য ওঠা দেখেছিলেন এভারেস্টের চূড়ায় দাঁড়িয়ে। বেয়ার এভারেস্ট রওয়ানা হওয়ার সময় তার বাবার দেয়া এভারেস্টের বড় পোস্টারটা সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। বিজ্ঞাপন থেকে রাজত্ববেয়ারের মাউন্ট এভারেস্ট জয়ের ঘটনা নিয়ে একটি ডিওডোরেন্ট কোম্পানি তাকে নিয়ে বিজ্ঞাপন তৈরি করলে তিনি সর্বপ্রথম টিভিতে আসেন। বেয়ার গ্রিলস নিজেও সম্ভবত ভাবেননি যে টেলিভিশনই তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবে। এভারেস্ট জয়ের পর একটি ডিওডোরেন্টের বিজ্ঞাপনে প্রথমবারের মতো ছোটপর্দায় নিজেকে তুলে ধরেন বেয়ার। এরপর অ্যাডভেঞ্চার শো দিয়ে রাতারাতি উঠে আসেন খ্যাতির শীর্ষে। দুঃসাহসী, দুর্ধর্ষ অভিযাত্রী বলতে এ সময়ে যদি কারো নাম উচ্চারণ করতে হয়, তাহলে সবার আগেই চলে আসে বেয়ার গ্রিলসের কথা। পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক, দুর্গম জায়গায় প্রতিকূল পরিবেশে কীভাবে টিকে থাকতে হয় তা তিনি আমাদের দেখান নিজের জীবন বিপন্ন করে। বেয়ার গ্রিলসের এ খ্যাতির পুরোটাই কিন্তু টেলিভিশনের কল্যাণে। তার প্রথম টিভি শো ছিল চ্যানেল ফোর-এ। নাম ছিল ‘এসকেপ টু দ্য লিজিয়ন’। তার খ্যাতিমান টেলিভিশন শো’র মধ্যে রয়েছে- এসকেপ টু দ্য লিজিয়ন, বর্ন সারভাইভাল/ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড, ওর্স্ট কেস সিনারিও। এছাড়াও বেয়ার গ্রিলসের অন্য শোগুলোর মধ্যে রয়েছে- বেয়ারস ওয়াইল্ড উইকেন্ড, গেট আউট এলাইভ উইথ বেয়ার গ্রিলস, এসকেপ ফ্রম হেল, দ্য আইল্যান্ড, মিশন সারভাইব, সারভাইবর গেমস প্রভৃতি অন্যতম। তবে নিজের শো ছাড়াও খ্যাতিমান হয়ে ওঠা বেয়ারকে আরো কিছু ক্ষেত্রে টিভিতে দেখা গেছে। এর মধ্যে ইংল্যান্ডের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে নির্মিত সেনাবাহিনীর মাদকবিরোধী টিভি ক্যাম্পেইন, বিশ্বখ্যাত হ্যারডস শপের বিজ্ঞাপন প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া তার অংশ নেয়া টিভি অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে ফ্রাইডে নাইট উইথ জোনাথন রোজ, অপরাহ উইনফ্রে শো, দ্য টু নাইট শো উইথ জে লেনো, দ্য লেট শো ডেভিড লেটার ম্যান ইত্যাদি। এছাড়া ‘ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড’ আমেরিকার এক নম্বর টিভি শো হিসেবে জায়গা করে নেয়। পৃথিবীর ২০০ দেশে ১.২ বিলিয়ন দর্শক এ শোটি দেখেন। অন্যদিকে গণমাধ্যমে পরিচিত হওয়ার পর ওয়ার্নার ব্রাদার্স গ্রিলসকে তাদের ‘ক্ল্যাশ অব দ্য টাইটানস’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু বেয়ার গ্রিলস সেই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেননি।লেখক বেয়ারবেয়ারের প্রথম রচিত বইয়ের নাম ‘ফেসিং আপ’। এটি যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে বেশি বিক্রিত বইয়ের তালিকায় স্থান পায়। এটি যুক্তরাষ্ট্রে ‘দ্য কিড হু ক্লাইম্বড এভারেস্ট’ নামে প্রকাশিত হয়। এভারেস্টে তার অভিযান এবং অভিজ্ঞতা নিয়ে রচিত দ্বিতীয় বই ‘ফেসিং দ্য ফ্রোজেন অশেন’ ২০০৪ সালে উইলিয়াম হিল স্পোর্টস বুক অব দ্য ইয়ার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়। শুধু তাই নয়, ১৫টি বইয়ের লেখক বেয়ার গ্রিলস। এর মধ্যে বাচ্চাদের জন্য ৪টি কল্পকাহিনির বই রয়েছে। তবে তার আত্মজীবনী বিশ্বের সেরা বেস্ট সেলারগুলোর মধ্যে একটি। তার আত্মজীবনী প্রকাশিত হয়েছে ২০১১ সালে। নাম ‘ম্যাড, সোয়েট অ্যান্ড টিয়ারস’।এসইউ/এমএস

Advertisement