২০১৬ সাল শেষ হলো, কিন্তু পৃথিবীর কোথাও থেকে কোনো সুখবর শোনা গেলো না। বছরটি একটি বিষমাখানো তীরের মতো আমাদের বিদ্ধ করেছে অনবরত। এতে বছরের কোনো দোষ নেই, দোষ মানুষের নিজেরই। জীব হিসেবে নিজেকে শ্রেষ্ঠ দাবি করা সত্ত্বেও নিজেরই সৃষ্টির প্রতি মানুষের যে এতো অবহেলা, তা রীতিমতো বিস্ময় জাগায়। পৃথিবীকে মানুষ ঢেলে সাজিয়েছে, বুদ্ধি দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে কিন্তু এসবই যেন ক্ষণস্থায়ী, নিজের জীবনের ক্ষণস্থায়িত্ব টের পেয়েই বুঝি বা মানুষ নিজেরই হাতে তৈরি এ সভ্যতার পেছনে লেগেছে, যেন তাকে ধ্বংস করে যেতে না পারলে কোনো সুখ নেই। অনেক দর্শনই অবশ্য বলে যে, ধ্বংসই অনিবার্য, সৃষ্টি নয়; ধ্বংস না হলে সৃষ্টি হতে পারে না কিছুই, তাই সুদীর্ঘকাল ধরে নির্মিত সভ্যতাকে একেবারে ধ্বংস করা গেলে, তবেই তার ওপর দাঁড়াবে নতুন সভ্যতা, যা উত্তর আধুনিকতাকেও হার মানাবে হয়তো। কিন্তু সভ্যতার কোনো নিরিখেই কি বাংলাদেশকে আমরা ঠিক ততোটা সভ্য বলতে পারি, যতোটা সভ্য হলে পৃথিবীর চোখে সর্বজনীনভাবে কোনো দেশ বা জাতিকে সভ্য বলা যায়? অনেকেই হয়তো আমার এই বক্তব্যে বিরক্ত হবেন, আমাকে গালাগালও দিতে পারেন, আসুন তবে একটু ব্যাখ্যা করি, কেন আমরা এখনও ঠিক সভ্য হয়ে উঠতে পারিনি সে বিষয়টি। ২০১৬ সাল শুরু হয়েছিল আশাবাদ দিয়ে, কারণ এর আগে দেশের রাজনীতি বলি, সমাজনীতি বলি কি ব্যবসা-বাণিজ্য বলি, প্রতিটি ক্ষেত্রেই অপরাজনীতির ছায়া পড়েছিল এসবের ওপর। দেশ একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল, এসব পাশ কাটিয়ে। ফলে ২০১৬ সালকে মনে করা হয়েছিল যে, হয়তো একটা নতুন জায়গা করে নিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ, কারণ রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা থেকে বাংলাদেশ হয়তো বেরুতে শুরু করেছে। বছরের প্রথম ছ’মাস আসলে সেরকম কোনো বড় অঘটন ঘটেনি। কিন্তু পহেলা জুলাই ঢাকার গুলশানস্থ হোলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে যে নারকীয় তাণ্ডব এদেশের জঙ্গিরা ঘটিয়েছে তাতে এদেশ কখনোই কি এই জঙ্গিবাদের অভিঘাত থেকে মুক্ত হতে পারবে কিনা, তা নিয়ে আমার ঘোরতর সন্দেহ রয়েছে।
Advertisement
ধন্যবাদ দিতেই হয় আমাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে, যারা অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে দেশের ভেতর জন্ম নেয়া, বেড়ে ওঠা ও রাজনৈতিক শক্তির দ্বারা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রতিপালিত হওয়া জঙ্গিবাদকে উন্মোচন করতে, বিস্তার ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে, কিন্তু পুরোপুরি দমন করতে পারেনি। তাই বছরের শেষে এসে আমরা দেখতে পেয়েছি যে, নারী ও শিশুরাও এই জঙ্গিদের দ্বারা ব্যবহৃত হচ্ছে। আমার মনে হয় ২০১৭ সালের পুরোটাই আমরা দেখতে পাবো এই প্রবণতা উত্তরোত্তর বাড়ছে, কারণ আগেই বলেছি, এদেশে জঙ্গিবাদ আসলে রাজনৈতিক শক্তির প্ররোচনায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের হাতিয়ার মাত্র। এই নরোম পলিমাটির মানুষ আর যাই হোক ধর্মের নামে খুন-খারাবিতে ঢালাও ভাবে যুক্ত হবে, সেটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। তারা ধ্বংসের মাঝেও সৌন্দর্য খোঁজে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিদের হাতে নির্মমভাবে আহত/নিহত/ধর্ষিত হয়েও বাঙালি একথা একটু জোর দিয়েই বলে যে, পাঠান সেনারা পাঞ্জাবিদের চেয়ে ভালো ছিল, যদিও পাঠান সেনার বিষয়টিতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে দু’একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটেছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়, সার্বিকভাবে পাঠানরা বাঙালিদের পাঞ্জাবিদের হাত থেকে বাঁচিয়েছে এমন কোনো নজির নেই। উদাহরণ হিসেবে একথা এজন্যই বললাম যে, বাঙালি মন ভয়ঙ্কর নেতিবাচকতার মাঝেও একটু ইতিবাচক উদাহরণ পেলে বর্তে যায়, সেটা প্রমাণ করতে। ২০১৬ সাল জুড়ে এই জঙ্গিবাদই সারা দেশে চাপাতি হাতে, অস্ত্র হাতে দাপিয়ে বেড়িয়েছে। একের পর এক বিদেশি, ধর্মযাজক, রাজনীতিবিদকে হত্যা করা হয়েছে। সর্বশেষ, বছরের শেষ দিন এসে খুন হয়েছেন আওয়ামী লীগের একজন সংসদ সদস্য। নিঃসন্দেহে এই খুন ২০১৬ সালকে আরো বিষাক্ত করে দিয়েছে আমাদের জন্য কারণ নতুন বছরে আমাদেরকে এই খুনের ধারাবাহিকতাকে টেনে আনতে হচ্ছে আমাদের বাধ্য হয়েই। কোনো একটি দেশে সংসদ সদস্যকে নিজের বাড়িতে এসে খুন করে যাওয়াটা একটি ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার জন্য যথেষ্ট, কারণ একজন সংসদ সদস্যেরই যেখানে জীবনের নিরাপত্তা নেই সেখানে একজন সাধারণ মানুষ তার জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবেন কী প্রকারে? কিন্তু একটু গভীরে ভেবে দেখলেই বোঝা যায় যে, নিহত সংসদ সদস্য আর কোনো রাজনৈতিক দল নয়, আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য। বাংলাদেশে আর কোনো রাজনৈতিক দলের সংসদ সদস্য কিংবা নেতৃত্ব এই খুনের শিকার হন না, বা হতে দেখা যায় না, আমরা দীর্ঘকাল ধরে দেখে আসছি যে, বাংলাদেশে কেবল আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব (এমনকি দলটির প্রতিষ্ঠাতা নেতৃত্ব, বর্তমান নেতৃত্বও এই খুনিদের হাত থেকে রেহাই পাননি বা পাচ্ছেন না), সংসদ সদস্য নির্মম খুনের শিকার হয়ে থাকেন। স্বাধীনতার পর পরই এদেশে যেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য খুনের হিড়িক পড়েছিল এবং সেটি এখনও অব্যাহত রয়েছে। পক্ষান্তরে অন্য যে কোনো রাজনৈতিক দলের দিকে তাকান, ইতিহাস কী বলে? ক’জন রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা সংসদ সদস্য খুঁজে পাবেন যারা খুন হয়েছেন? এখানেই বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে জটিল সমীকরণ, সিটিং এমপিদের প্রাণের বিনিময়ে এদেশে আওয়ামী লীগকে রাজনীতি করার মূল্য দিতে হয়, সেটা বাহাত্তর-তিয়াত্তর-চুয়াত্তর হোক কি ২০১৬ সাল হোক; জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নিহত হতে হয়, শেখ হাসিনাকে একাধিকবার আততায়ীর হত্যাচেষ্টা বিনষ্ট করে বেঁচে থাকতে হয়। প্রশ্ন তোলা কি জরুরি নয়, কেন কেবল আওয়ামী লীগকেই এই মূল্য দিতে হয়? কেন বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টিকে এদেশে রাজনীতি করেও এরকম কোনো ভয়ঙ্কর ঘটনার মুখোমুখি হতে হয় না? জানি, এরকম প্রশ্ন কেউ তুলবেন না, কারণ, তারা একেই ‘নর্ম’ মনে করে থাকেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এদেশে একা আওয়ামী লীগ একদিকে আরেকদিকে সকল রাজনৈতিক দলের অবস্থান। এতো জটিল, কুটিল ও ভয়াবহ বৈরিতা নিয়ে এই দলটি এখনও কী করে টিকে আছে সে প্রশ্ন উত্থাপন করা যেতেই পারে। অপরদিকে এ কথাও বলাটা জরুরি যে, এতোকিছুর পরেও এই দলটিই এখনও পর্যন্ত দেশের জন্য যা কিছু করেছে তা বাকি সবগুলো দলের অর্জনকেও ম্লান করে দেয়- এই সত্য স্বীকার করার সৎসাহসও হয়তো আমাদের অনেকেরই নেই। কিন্তু তাতে সত্য বদলাবে না। এখন আমরা যদি ২০১৬ সালের শেষ দিনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যকে হত্যার ঘটনাটি নিয়ে একটুখানি ভাবি তাহলে কি এ প্রশ্নটাই সবার আগে মাথায় আসে না যে, ২০১৭ সাল কি আবারও ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের বছর হতে চলেছে? যেমনটি হয়েছিল ২০১৪ ও ২০১৫ সাল? আগুন-বোমা দিয়ে এদেশকে অচল করে দেওয়ার যে জঘন্য কর্মকাণ্ড আমরা সে সময় প্রত্যক্ষ করেছি তা কোনো সভ্য দেশেই সম্ভব ছিল না। কিন্তু এদেশে হয়েছে, আগেই বলেছি যে, পৃথিবীর সভ্যতার মাত্রার সঙ্গে বাংলাদেশের সভ্যতার সূচকে কোনো মিল নেই। নাহলে এমপি লিটন হত্যাকাণ্ডে যখন পুলিশ জামায়াতে ইসলামীর স্থানীয় নেতৃত্বকে সন্দেহের আওতায় এনে ঘটনার তত্ত্ব তালাশ শুরু করেছে তখন জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক বিছানার সঙ্গী বিএনপি নেতৃত্ব সরকারের সমালোচনা শুরু করেছে ঢালাওভাবে, যে সমালোচনার কোনো ব্যাকরণতো নেই-ই, এমনকি মৃতের প্রতি যে সম্মান প্রদর্শনের আন্তর্জাতিক রীতি রয়েছে, অনেক ক্ষেত্রেই সেটিও মানা হচ্ছে না।বিষয়টি এ কারণেই উদ্বেগজনক যে, আওয়ামী লীগের জনসভায় দলটির প্রধান নেতৃত্বের ওপর গ্রেনেড হামলার পর যেমন বিএনপি’র পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল আওয়ামী লীগ নিজেই তাদের ওপর গ্রেনেড মেরেছে কিংবা শেখ হাসিনা নিজে তার ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড বয়ে নিয়ে গিয়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন তেমনই এমপি লিটন হত্যাকাণ্ডেও তারা একইরকম কথাবার্তা বলছেন। বৃদ্ধ বয়সে ভারমুক্ত হওয়া বিএনপি মহাসচিবও এই হত্যাকাণ্ডকে কেবলমাত্র দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হিসেবে দেখেন, তিনি আর কোনো কারণ দেখেন না এমপি লিটনকে তার নিজের বাড়িতে এসে হত্যা করে হত্যাকারীদের পালিয়ে যাওয়ার পেছনে। কী ভয়ঙ্কর এই রাজনীতি। আগেই বলেছি যে, এদেশে জঙ্গিবাদ যেমন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত, রাজনৈতিক ভাবে প্ররোচিত এবং মদদপুষ্ট তেমনই রাজনৈতিক বিশেষ করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বদের হত্যা করা কিংবা তাদেরকে হত্যার উদ্দেশ্যে পরিচালিত হামলাসমূহও তাই, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দ্বারা পরিচালিত ও প্রমোট করা প্রকল্প। দুঃখজনক সত্য হচ্ছে, ২০১৭ সাল ভর আমাদের এইসব প্রকল্প বাস্তবায়নের অপচেষ্টা দেখে যেতে হবে, কারণ তাদের হাতে এর আর কোনো বিকল্প নেই, রাজনৈতিক ভাবে যখন রাজনীতিকে মোকাবিলা করা সম্ভব হয় না, তখন রাজনৈতিক নেতৃত্বকে খুন করার রাজনীতি শুরু করতে হয়। জেনারেল জিয়াউর রহমান এই পথেই রাজনীতিতে এসেছিল, তারপর নিজে খুন হয়ে তার ধারাবাহিকতা তুলে দিয়েছিল জেনারেল এরশাদের হাতে, আর জেনারেল এরশাদ বিএনপি নামক প্ল্যাটফরমটির হাতে দিয়েছিল সেই খুনের লিগেসি, কারণ বিএনপি এক জেনারেলের ঔরসে সেনানিবাসে জন্ম নেওয়া রাজনৈতিক দল, জামায়াত ইসলামী নামক উগ্রবাদী ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল যার ‘স্পার্ম ডোনার’ পিতা। এদেশে হত্যার রাজনীতির ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করুন, এর ব্যত্যয় পাওয়া যাবে না। কোনো পাঠক যদি এর ব্যতিক্রম পান, দয়া করে লিখুন, আমি আমার বক্তব্য সংশোধন করতে দ্বিধা করবো না। ২০১৭ সালের প্রথম লেখাটিতে আমি এতোটা নেতিবাচক হতে চাইনি। কিন্তু শুরুতেই যে বলেছিলাম, নিজের তৈরি সভ্যতা ধ্বংসে মানুষ নিজেই মেতে উঠেছে, চারদিকে তার প্রমাণ দেখে সত্যিই আতঙ্কিত বোধ করছি আমি। তারপরও সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা। ঢাকা, ৩ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার ২০১৬লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট। masuda.bhatti@gmail.comএইচআর/জেআইএম