বিশেষ প্রতিবেদন

শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতিতে বিধি লঙ্ঘনের হিড়িক

চাকরি বিধি ও জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে গত ৬ বছরে প্রায় এক হাজার বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাকে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। মাদরাসা বোর্ডের চেয়ারম্যান একেএম ছায়েফ উল্যাহকে ২০১২ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে তিন বছরে তিন দফায় পদোন্নতি দিয়ে অধ্যাপক করা হয়েছে। অন্যদিকে ১৪তম বিসিএসের ইতিহাস বিষয়ে মেধা তালিকায় ৪র্থ স্থান অর্জনকারী রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের বর্তমান সচিব আনারুল হক যোগত্য থাকার পরও অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাচ্ছেন না দশ বছর ধরে। তিনি ২০০১ সালে সহকারী অধ্যাপক এবং ২০০৫ সালে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পান। ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জনসহ সব বিভাগীয় পরীক্ষায় পাস করে অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য যোগ্য হলেও ১০ বছর ধরে পদোন্নতি বঞ্চিত তিনি। শুধু আনারুল হক নন, তার মতো আরো শতাধিক যোগ্য শিক্ষক পদোন্নতি বঞ্চিত। আবার যাদের পদোন্নতি দেয়া হয়েছে তাদের অনেকে বিভাগীয় পদোন্নতি পরীক্ষায় ফেল করেছেন। কারো আবার চাকরিই স্থায়ী হয়নি। তবুও অধ্যাপক হয়েছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) একটি সিন্ডিকেট মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে কলকাঠি নাড়ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।এদিকে অবৈধভাবে পদোন্নতি হওয়ায় বঞ্চিত হয়েছেন পদোন্নতি-যোগ্য প্রায় দেড় হাজার কর্মকর্তা। আর পদোন্নতিপ্রাপ্ত অধ্যাপকদের বাড়িতে বেতন দিতে সরকারকে গুণতে হচ্ছে কোটি কোটি টাকা।এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ জাগো নিউজকে বলেন, এই পদোন্নতির সাচিবিক কাজটি করেছে মাউশি। তারা যেভাবে উপস্থাপন করেছেন, সে অনুযায়ীই পদোন্নতির সিদ্বান্ত হয়েছে। যদি কোনো অনিয়ম বা বেআইনি কাজ হয়, তাহলে খোঁজ-খবর নিয়ে দায়ীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।২০০৬ সাল থেকে ২০১৬ সালের অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জ্যেষ্ঠতা তালিকা, ফিট লিস্ট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত ২৯ সেপ্টেম্বর ও ২৩ অক্টোবর দুই দফায় ৫৮৭ জন পদোন্নতিপ্রাপ্ত অধ্যাপকের মধ্যে ১৫৪ জন বিভাগীয় পদোন্নতি পরীক্ষায় ফেল করেন। ২০১৪ সালের ১৪ অক্টোবর পদোন্নতিপ্রাপ্ত ৩৬৭ জন অধ্যাপকের মধ্যে ২ শতাধিক ফেল করা ও ১৪৮ জন পদোন্নতির অযোগ্য। শর্ত পূরণ না করায় তাদের চাকরিও স্থায়ী হয়নি।বিভাগীয় পরীক্ষায় ফেল করা বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার এবং আত্তীকৃত ১৪৮ জন শিক্ষক পদোন্নতির দাবি করে মামলা করেন। আদালত তাদের প্রমার্জন (ক্ষমা) করে সহকারী অধ্যাপক পর্যন্ত পদোন্নতির আদেশ দিয়েছিলেন। অথচ তাদের  ২০১৪ সালে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। ২০০৯ সালে আইন লঙ্ঘন করে সহযোগী অধ্যাপক পদে যাদের পদোন্নতি দেয়া হয়েছিল ২০১০ সালে অধ্যাপক পদে তাদের পদোন্নতি দেয়া হয়। এসব অধ্যাপকই নাম করা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ, শিক্ষা প্রশাসন ও প্রকল্পের শীর্ষ পদে কর্মরত।  বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস রিক্রুটমেন্ট রুলস (বিএসআর) অনুযায়ী, ক্যাডার পদে প্রবেশের পর বিভাগীয় পরীক্ষার মাধ্যমে চাকরি স্থায়ীকরণ হয়। পদোন্নতির ক্ষেত্রেও প্রধান শর্ত চাকরি স্থায়ীকরণ। ৬৪৩ জনকে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেয়ার পর ২০১৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ভূতাপেক্ষভাবে চাকরি স্থায়ীকরণ করা হয়। অথচ ২০০৫ ও ২০০৬ সালে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতিপ্রাপ্তরা পরের বছরই অধ্যাপক পদে পদোন্নতির যোগ্য হয়েছেন। অথচ এদের ৪৪৮ জন পদোন্নতি বঞ্চিত। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক বলেন, বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তাদের সার্ভিসে যোগদানের পর বিভাগীয় পরীক্ষায় পাসের মাধ্যমে চাকরি স্থায়ী হবে। পরবর্তী বেতন স্কেলে পদোন্নতির ক্ষেত্রেও পরীক্ষায় পাস করতে হবে। এসব যোগ্যতা ছাড়া কিভাবে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে তা শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলতে পারবে।  প্রসঙ্গত, বিএসআর-এর ১৯৮১ এর ৫, ৬ ও ৭ বিধি অনুযায়ী সকল ক্যাডারের প্রারম্ভিক পদে নিয়োগ প্রাপ্তদের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ, বিভাগীয় পরীক্ষায় পাস ও শিক্ষানবীশকাল শেষ করে চাকরি স্থায়ীকরণ বাধ্যতামূলক। পদোন্নতির জন্য পরীক্ষায় পাসও বাধ্যতামূলক। যারা এসব যোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ হবেন তাদের চাকির মেয়াদ ১৫ বছর পূর্ণ হলে পরীক্ষা প্রমার্জন সাপেক্ষে পদোন্নতি প্রাপ্ত হবেন। এছাড়াও আইনে বলা রয়েছে, সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক হতে ৩ বছর এবং অধ্যাপক হতে আরো ২ বছর দায়িত্ব পালন করতে হবে। বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মো. আইকে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার বলেন, অন্যান্য ক্যাডারের পদোন্নতির ক্ষেত্রে ‘কেস টু কেস’ যাচাই-বাছাই করে পদোন্নতি দেয়া হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়েরও উচিৎ ছিল প্রত্যেকের ব্যক্তিগত তথ্য যাচাই-বাছাই করে পদোন্নতি দেয়া। কিন্তু মন্ত্রণালয় যাচাই-বাছাই না করেই ঢালাওভাবে পদোন্নতি দিয়েছে। এতে আমাদের অনেক শিক্ষক পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বারবার অভিযোগ করেও কোনো লাভ হয়নি। তারা উল্টো সমাধান না করে মামলার পরামর্শ দিয়েছেন।এমএইচ/এআরএস/এনএফ/এমএস

Advertisement