মতামত

‘নারী’ নয়, জঙ্গি হিসেবেই সমীকরণ মেলাতে হবে

খুব সম্প্রতি রাজধানীর আশকোনায় জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের অভিযানে জঙ্গি সাবিনার শিশু সন্তানসহ ‘সুইসাইডাল ভেস্ট’ বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আত্মঘাতী হওয়ার ঘটনা এখন দেশে বিদেশে আলোচনার বিষয়। এর আগেও আজিমপুরে জঙ্গি অভিযানের সময় এক ‘নারী’ দুর্ধর্ষ  আচরণ করে এবং অন্য দুই নারী আত্মহত্যার চেষ্টা করে আলোচনায় এসেছিল। জঙ্গিবাদে নারীদের ব্যবহার করার বা জড়িয়ে পড়া এবং আত্মঘাতী হবার এই নতুন কৌশল স্বাভাবিকভাবেই নতুন উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার জন্ম দিয়েছে। তার চেয়েও উদ্বেগের বিষয় হলো একটা শ্রেণি জঙ্গিবাদ মোকাবেলার মতো গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর বিষয়ে উদ্দেশ্যমূলক তর্ক জুড়ে ইস্যুটিকে ডাইভার্ট করার চেষ্টা করে, অনবরত প্রশ্ন তুলে জঙ্গিবিরোধী যে কোনো অভিযানকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। এরাই নিবরাসদের মতো উচ্চবিত্ত জঙ্গিদের পক্ষে বিভিন্ন ছুতোয় সহানুভূতি তৈরি করার চেষ্টা করেছে, কেউ কেউ ‘ফ্রি তাহমিদ’ ইভেন্ট এও ছিলো। এই গোষ্ঠীই এখন আবার জেন্ডার বিভাজন করে ‘নারীজঙ্গি’ বলে আলাদা ক্যাটাগরি করছেন, নারীবাদ ইস্যুর সাথে গুলিয়ে ফেলছেন। এসব কিন্তু নিছক বিতর্ক বলে মনে করি না আমি, এর পেছনে স্পেসিফিক এজেন্ডা আছে এবং জেনে না জেনে পরোক্ষভাবে জঙ্গিবাদকেই পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাচ্ছেন, জঙ্গিদের স্বার্থ রক্ষা করছে এই চক্রটি। একটু বুঝিয়ে বলুন তো, ‘নারীজঙ্গি’ জঙ্গি জিনিসটা আসলে কী? সেটি কেন শুধু নারীবাদীদের ইস্যু হবে, আপনাদের ইস্যু নয় কেন? নারীকে আলাদা করে ‘নারীজঙ্গি’ বলে জঙ্গিবাদের ভয়াবহতা বোঝাতে হবে কেন? নিবরাসদের যদি পুরুষ জঙ্গি না বলে তবে, সাবিনাদের কেন ‘নারীজঙ্গি’ বলে আলাদা করতে হবে? কেন মানতে পারছেন না, মানুষের পক্ষে যা যা অপরাধ করা সম্ভব, নারীও সেসব অপরাধ করতে পারে? মানুষ শব্দটি কি কেবলই পুরুষের জন্য, আর নারী কেবল যোনিদায়গ্রস্ত ‘অবলা’ ‘দ্বীতিয় লিঙ্গ’? দুর্ধর্ষ হওয়া, সন্ত্রাসী হওয়া, খুনি হওয়া কেবল পুরুষের একচ্ছত্র মানবিক দোষ? কোনো নারী কী মাদক ব্যবসা, চোরাচালান, মানবপাচার, চু্রি-ডাকাতি বা খুন খারাবিতে জড়ায়নি? খুনি কি নারী হিসেবে আইনে বিশেষ সুবিধা পায়? হিলারির বিরুদ্ধে যখন আইএস ও আলকায়দার কাছে অস্ত্র সরবরাহের অভিযোগ ওঠে, তখন কী তাকে নারী অস্ত্রবাজ বলেছে কোনো মিডিয়া? তিনি কি নারী হিসেবে অস্ত্র সরবরাহ করেন নাকি আগ্রাসী, যুদ্ধবাজ, পুরুষতান্ত্রিক রাজনীতিবিদ হিসেবে অস্ত্র আর ধর্ম ব্যবসা জিইয়ে রাখার রাজনীতি করেন? নারী যখন যৌনপল্লীর সর্দার হয়, তখন সে কী শুধু নারী হয়েই নারীকে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করে, নাকি পুরুষতন্ত্রের বাহক হয়ে পুরুষের পার্পাস সার্ভ করার জন্য নারীকে নিপীড়ন করে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজবেন। অপরাধ জগতে পুরুষের নিরাপত্তা ও সুবিধার স্বার্থে নারীকে ব্যবহার করার ইতিহাস নতুন নয়। সুতরাং জঙ্গিবাদের ঢাল হিসেবে নারী ও শিশুকে ব্যবহার করার বিষয়ে আরো মনো-সামাজিক বিশ্লেষণ প্রয়োজন। আপাতত পাওয়া প্রাথমিক তথ্যপ্রমাণ বলছে, বাংলাদেশে ‘প্রিয়’ পুরুষের পদরেখা ধরেই জঙ্গিবাদের মতো আত্মঘাতী অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে বেশিরভাগ নারী। কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম জানান, ‘নারীরা স্বামীর কারণে বাধ্য হয়ে জঙ্গিবাদের সাথে যুক্ত হয়।অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জঙ্গি সংগঠনগুলোর পুরুষ সদস্যরা অন্য সদস্যদের আত্মীয়দের বিয়ে করছে এবং বিয়ের মাধ্যমে নারীদের সরাসরি জঙ্গিবাদে যুক্ত করছে।’ জঙ্গি সংগঠনে জড়িয়ে পড়ার পর অনেকেই তাদের বোনদেরও এ পথে নিয়ে আসছে। কারণ, সংগঠনে নারী সদস্য থাকলে স্ত্রী-সন্তানসহ যাতায়াত করা, অস্ত্র বহন করা, তথ্য সংগ্রহ করা সব ক্ষেত্রেই সুবিধা হয়। গত সেপ্টেম্বরে আজিমপুরে সন্দেহভাজন জঙ্গি আস্তানা থেকে গ্রেফতারকৃত নিহত জঙ্গি কাদেরীর স্ত্রী ফাতেমা জানিয়েছিল, জঙ্গিবাদে যুক্ত না হলে স্বামী তাকে তালাক দিতো, আত্মীয়স্বজনের কাছে লজ্জিত হওয়ার ভয়ে সে জঙ্গিবাদে যুক্ত হয়। জঙ্গি মারজানের স্ত্রী প্রিয়তিও একই রকম তথ্য জানিয়েছিল। প্রথমবারের মতো আত্মঘাতী হওয়া জঙ্গি সাবিনার কথা আলোচনা করতে গিয়ে ‘হতাশা থেকে নারীরা আত্মঘাতী জঙ্গি হচ্ছে’ বলে মন্তব্য করছেন অনেকেই। এটি এতো সরল বিশ্লেষণ নয়। কারণ, যে প্রক্রিয়া এবং  প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে জামায়াত-শিবির-জেএমবির মতো ধর্মীয় মৌলবাদী সন্ত্রাসভিত্তিক দলগুলোর সদস্য থেকে আত্মঘাতী দলে যাওয়ার বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করতে হয়, তার সাথে ‘হতাশা’র মতো মানসিক দুর্বলতাটি যায় না। বরং স্বামীর নির্দেশনায় জিহাদের জন্য শারীরিক এবং মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই জঙ্গি হচ্ছে নারীরা। রিমান্ডে নেয়া জঙ্গিদের কাছ থেকে এমন তথ্য পাওয়া গেছে যে, তাদের স্বামীরা বড় কোনো অপারেশনে যাওয়ার আগে বা হিজরতের আগে স্ত্রীদের এমন নিদের্শনা দিয়ে যাচ্ছে যে, ‘জিহাদের’ জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। লড়াই করে যেতে হবে শেষ শক্তি দিয়ে। পুলিশের কাছে ধরা পড়ার আগে প্রয়োজনে আত্মাহুতি দিতে হবে। কোন অপারশনে মারা গেলে যোগ্যতার বিচার না করেই সংগঠনের সদস্যদের মধ্য থেকে যে কাউকে বিয়ে করার, আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ নেয়ার পাশাপাশি সন্তানদের জঙ্গি দীক্ষা দেওয়ার এবং সংগঠনে নতুন ‘সিস্টার’ বাড়ানোর নির্দেশনাও দিয়ে যাচ্ছে দুর্ধর্ষ জঙ্গিরা। পুরুষতন্ত্রের রাজনীতির সামনে দাঁড়াতে হবে বারবার, যেখানে পুরুষ ধর্ম তৈরি করেছে আর নারী সেই ধর্ম পালন করেছে বিনা বাক্য ব্যয়ে। বাংলাদেশের পুরুষতান্ত্রিক সামজিকীকরণে স্বামীর প্রতি আনুগত্য, স্বামীর আদেশ পালনের শিক্ষা নারীরা শৈশব থেকেই পেয়ে থাকে। এখানে “স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেস্ত” হাদিস প্রচার করেছে পুরুষ যা অনেক নারীর কাছেই ভয়ঙ্কর জনপ্রিয়। এই সুযোগটিই গ্রহণ করে নারীদের আত্মঘাতী হবার ভয়ঙ্কর মগজ ধোলাইটি করছে স্বামীরা। পুরুষতান্ত্রিক রাজনীতি ও ধর্মের এমনই শক্তি, ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতি করা তুখোড় মেয়েও বিয়ের পরে মহিলা জামায়াতের সদস্য হয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী মেয়েদেরও সহজেই ‘জিহাদের’ জন্য আত্মাহুতি দিতে প্ররোচিত করতে পারে। যে ধর্মের নামে পুরুষরা এতোদিন নারীকে অন্তপুরে আটকে রেখেছিল, নিজেদের অস্তিত্ব সংকটে সেই ধর্মকে ব্যবহার করেই পুরুষ নারীকে বলছে, ধর্ম আক্রান্ত হয়েছে, ধর্ম বাঁচাও, জিহাদ করো। মার্ক্স বলেছিলেন, ধর্মটা অনেকের কাছে আফিমের মতো। তবে এদেশের নারীদের কাছে, অনেক পুরুষের কাছেও ধর্ম আফিমের চাইতেও ভয়াবহ। জঙ্গিবাদ তাই সাবিনা বা নিবরাসদের মতো জঙ্গিদের কাছে এমন এক ‘জিহাদ’ যার জন্য সন্তানের হাত ধরে ‘সুইসাইডাল ভেস্ট’ এর সুইচ টিপতে পারে, মানুষের রক্তে পা ডুবিয়ে পাস্তা-প্রণ দিয়ে সেহেরি করতে পারে।  এই সত্য আস্বীকার করার উপায় নেই যে, জঙ্গিবাদ ধর্মীয় বিষয় নয় বরং একটি পরিকল্পিত রাজনৈতিক সন্ত্রাসের আন্তর্জাতিক জাল। বৈশ্বিক বাস্তবতাই এমন যে, নারী -পুরুষ উভয়েই অভিন্ন উদ্দেশ্য ও স্বার্থে এই জালে জড়িয়ে পড়ছেন ‘ধর্ম’ বাঁচাতে। বাংলাদেশে জামায়াতের উইং ছাত্রীসংস্থার মৌলবাদী রাজনীতি দীর্ঘবছর ধরে ধর্মের নামে নারীদের মোটিভেট করেছে, সংগঠিত করেছে, প্রশিক্ষণ দিয়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মেধাবী মেয়েদের টার্গেট করে তাদের পেছনে অর্থ ও সময় বিনিয়োগ করেছে। এরই ধারাবাহিকতায়, নব্য জেএমবির সক্রিয় নারী শাখার কথা আমরা জানতে পেরেছি গোয়েন্দা সংস্থার বরাতে। এই দুর্ধর্ষ জঙ্গিরা অনেক বেশি কঠোর। তারা আত্মঘাতী দলের সদস্য এবং বিস্ফোরকদ্রব্য ব্যবহারেও পারদর্শী। এভাবে বোরকার আড়ালে জঙ্গিরা যদি নারীদের আত্মঘাতী হিসেবে ব্যবহার করে, তাহলে বিপদজ্জনক পরিস্থিতি ছড়িয়ে পড়তে পারে গোটা দেশে। কেননা, এ দেশের বেশিরভাগ সাধারণ নারীই বোরকা ব্যবহার করে থাকে। বোরকার আড়ালে বোমা বহন কিংবা নাশকতা করলে তা পুলিশী তল্লাসি দিয়ে ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়বে। এদেশের ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষ বলি হয়ে যাবে ধর্মীয় মৌলবাদী রাজনৈতিক দানবের। সুতরাং জঙ্গিবাদ মোকাবেলা করার জন্য নির্মোহ বিশ্লেষণ জরুরি এবং জঙ্গিকে জঙ্গি হিসেবে ধরেই সে সমীকরণ মেলাতে হবে। পুরুষের হাত ধরে নারীরা জঙ্গি হয়ে উঠছে বা হতাশার কারণে নারী আত্মঘাতী হচ্ছে, এমনটাই একমাত্র বাস্তবতা ধরে নিলে নারী হিসেবে জঙ্গিরা সহানুভূতি পাবে, আড়ালে থেকে যাবে দেশীয় ও বৈশ্বিক চক্রান্ত। তাই জেন্ডারকে ব্যবহার করে জঙ্গিবাদের মতো একটা আন্তর্জাতিক অপরাধ লঘু করার বা সহানুভূতি কুড়োনোর ষড়যন্ত্র বন্ধ করতে হবে এখনই। ইংলিশ মিড়িয়ামের কেতা দুরস্ত নিবরাস বা গ্রামের মাদ্রাসার শফিউল, ইন্টার্ন ডাক্তার ঐশী কিংবা আত্মঘাতী সাবিনা, তাদের একটাই পরিচয়  ‘জঙ্গি’। মনে রাখতে হবে, নারী মানুষ হলে জঙ্গিও হতে পারে। এবং ‘নারীজঙ্গি’ নয়, বরং জঙ্গি হিসেবেই জঙ্গিবাদের বিচার করা উচিত। লেখক : প্রধান নির্বাহী সংযোগ বাংলাদেশ; কলামিস্ট ।এইচআর/এমএস

Advertisement