সাহিত্য

চন্দ্রভূক অন্ধকার

রাইত কাবার দিয়ে বেইনবেলা ঘরত আইছিস মাগী, কার নগে চিত হবার গেছলি? : এত্তগুলান টেকাদি যেই বিটা উপুত হবার চাইছিলো তার ঘরে গেছলাম। কুমার নদীর পার। গায়ে গা ঠেকিয়ে একের পর এক ঘাটে বাঁধা নৌকা। ছইওয়ালা নৌকা, ছইছাড়া নৌকা। এখানে বেদেদের পল্লী। বছরে ছয়মাস নৌকা এবং মানুষগুলো ঘাটে বাঁধা থাকে। নদীতে জল বাড়লে এরা আরেক ঘাটে ভেড়ে। জলের উপর বসতী। এই পল্লীতে সভ্যতা এখনো এসে পৌঁছেনি। ধারাপাত বইয়ের চাইতে শিশুদের কাছে বেশি পরিচিত লাল রঙয়ের রাজা কনডম। সবুজ ফ্রকপরা শিশুর হাতে সুতোয় বাঁধা বেলুন। বাতাসে উড়ে যায় লাল বেলুন। উড়ুক্কু মেঘের ডানায় ঘষা লেগে ফেটে যায় প্লাস্টিক, অচেনা পুরুষের শুকিয়ে যাওয়া বীর্যসমেত। বেদে পুরুষেরা মাতৃতান্ত্রিকতায় বিশ্বাসী কেবল কাজের বেলায়। পুরুষেরা ঘরে থাকে মেয়েরা কাজে যায়। সাপের খেলা, ভেল্কিবাজির খেলা। আড়ালে আবডালে কেউ কখনো বেছে নেয় গণিকাবৃত্তি। ডাঙ্গার মানুষেরা ঠকতে ভালোবাসে। বেদেনীরা ঠকাতে। তবে আগের দিন এখন আর নাই। মানুষগুলান চতুর হয়ে উঠছে। গ্রামে গ্রামে টেলিভিশন। চায়ের দোকানে ছেলেদের হাতে হাতে মোবাইল ফোন। বেদেনীদের হেলেদুলে চলা নিতম্বের দিকে তাকিয়ে কেউ আর দুটো টাকা গুঁজে দেয় না হাতে। তার চেয়ে মোবাইলের চৌকো স্ক্রিনে ফর্সা চামড়ার সানী লিওন সহজলভ্য অনেক। হায় সানি লিওন, সানি লিওন! দিনমান ক্লান্তির পর ঘরে ফেরে বেদেনীরা। সারাদিন উপার্জনের টাকাগুলো হাতিয়ে নেয় বেটাগুলান। তাড়ির নেশা, জুয়ার নেশা-এ বড় সর্বনাশা নেশা। টাকায় টান পরলে বউ-ঝিয়ের গায়ে হাত উঠে। অকর্মা পুরুষের শরীরে অসুরের শক্তি ভড় করে যেন। তিস্তা-বহতা নয় অনেক আছাড়ি বিছাড়ির পর থমকে যাওয়া স্রোত। কৃশকায় মেয়েটি সমতল বক্ষা। হলে হবে কি, কাঁচাসোনা গায়ের রং। নৌকার ঘরের মেয়েছেলে, এত রুপ ভালো নয়। রুপে সর্বনাশ নামে। রাতের আন্ধারে সাপের মাথার কোহিনুর মনি চুরি করতে আসে ওঁঝা। আর ওঁঝার হাতেই সাপের মরণ। এ নিয়তী। এ অদৃষ্ট। অদৃষ্ট ঠেকাবার ক্ষমতা কারো নেই। যৌবনে ডুব দেবার আগেই তিস্তার ঘর হয়েছিল, বর হয়েছিল। দুধসাদা বিছানার চাঁদরে লাল নীল সুতোয় ফুল তুলেছিলো তিস্তা। ঢেউয়ের তালে নৌকা দুলে। সেই সাথে দুলে যুবতী তিস্তার মন, ছইয়ের ভেতরে সংসার। দিন কাটে ডাঙায় আর রাত যায় নৌকার ছইয়ে। কোন কোনরাতে ভালো খদ্দের পেলে বাবুদের বাড়ি রাত কাটে। তিস্তার স্বামী অন্যসব বেদে পুরুষের মতই ঘরে বসে খায়, জুয়োর আসরে টাকা খোয়ায়। বছর দুয়েকের মাথায় পেট ভার ভার ঠেকে তিস্তার। পোয়াতী হয় সে। পেটের ভেতরে নড়েচড়ে ছেলে। যেন পঙ্খীরাজ সাপে পেটের ভেতর কিলবিলায়। : আলো আলো আলো হারামজাদার বিটা, আমার গতরত থাকি আমাকেই লাত্থি চড়াস! না জানি কপালে আমার কি লিখা আছে এই বিটাক নিয়ে। হাসতে হাসতে চোখের কোণে পানি আসে। গা গুলোয়, মাথা চক্কর দেয়। ঝিমধরা দুপুরে নদীর স্থির হয়ে থাকা পানিতে হঠাৎ একটা মাছরাঙা উড়ে যায়। স্তব্ধতাকে চিড়ে দিয়েছিয়েছিলো সেদিন কোয়েলার মা দাইয়ের কণ্ঠস্বর, : তিস্তার একখানা রাজপুতুরের লাহান বিটা ছাওয়াল পয়দা হয়েছে। আজকাল সাপের খেলার কদর নেই। মানুষের জীবনে আনন্দের নিত্য নতুন জোয়ার এসেছে। “বিধির কি হইলো” গানে নয়া জমানার মানুষের মন টানেনা। তিস্তার ঘরে ছোট ছাওয়াল। সাপের খেলা দেখানোর এই সামান্য রুজিতে তিন তিনটে পেট চলেনা। ছেলে এখনো মাই টানে। ছেলে জন্মাবার পরে তিস্তার সমতল বুকে বানের জোয়ারের মত দুধ নেমেছে। একবেলা না খাওয়াতে পারলে বুক টনটন করে। ছেলের জন্য দুধের টিন কেনার খরচা না থাকলেও অন্য খয় খরচা বিস্তর। বাচ্চার কাপর-চোপড়, খেলনা। কম খরচার ব্যাপার না। বাড়তি উপার্জনটা বাবুদের দয়া, শরীরতো নিমিত্তমাত্র। আটমাসের ছেলেকে বাপের কাছে রেখে গতরাতে ঘরে ফেরেনি তিস্তা। চটজলদি বাবুর সাথে যেতে হয়েছিলো তাই নৌকায় সংবাদও পাঠাতে পারেনি। বাড়ির মানুষেরা অভ্যস্ত এতে। ঘটনা নতুন কিছুতো নয়। তারপরেও রাতে বাড়ি ফেরেনি বলে রাগ হয় কর্তার। চুপ করে থাকলে পৌরুষ নষ্ট হয়। অকর্মা পুরুষের অহেতুক হম্বিতম্বি, হাঁকডাক। কিছুক্ষণ হেঁকেডেকে তিস্তার কাছ থেকে টাকা নিয়ে নৌকা থেকে বের হয়ে যায় পুরুষ। হয়তো বাজারে গিয়ে তাড়ি গিলছে। গত রাত থেকে আকাশটা গুমড়ে আছে। ছোট শিশুর মত ঠোট উলটে থাকা, শুধু কান্নার জন্য অপেক্ষা। অগ্রহায়ণ মাস শেষ হয়ে আসছে। সকাল বেলা নদীতে থাকে ঘন কুয়াশা। এপার ওপার কিচ্ছু দেখা যায় না। তিস্তা ঘরে গিয়ে রাতের বাশি কাপড় বদলায়। নৌকার পাটাতনে মোটা কাঁথা বিছিয়ে তার উপর বিছানা বালিশ। হাত পা ছড়িয়ে বিছানার উপর ঘুমিয়ে আছে আটমাসের ছেলে। ঠোঁটের কষা বেয়ে লাল ঝরে পড়ছে। কোমরে কালো তাগা বাঁধা। রুদ্রাক্ষের গোটা, কড়ি আর মাদুলী, রক্ষাকবচ। কত পীর ফকিরের কাছ থেকে চেয়ে চিনতে এগুলো এনেছে তিস্তা। সারাদিন ঘরে থাকে না, এই কবচই ছেলেকে রক্ষা করে চেনা অচেনা বিপদাপদ থেকে। খিদেয় পেট চিনচিন করে তিস্তার। যেই লোকের সাথে রাতে গিয়েছিলো সে বড় দয়ালু। তিস্তাকে ঘরে রেখে বাজার থেকে বিরিয়ানি কিনে এনেছিলো। ভড়পেট খাবার পর পরিশ্রমতো কিছু কম হয়নি! শরীর জিরোয়, মন জিরোয় না। মনে যার আনন্দ শরীর তাকে রুখবে কি করে! নির্লিপ্ত তিস্তা বাবুর আনন্দে সায় দেয়। বিছানার পড়ে থাকে যেন মরা সাপ। গাঢ় অন্ধকারে হিম শরীর। এখন খিদেটা টের পায় তিস্তা। পেটের ভেতরে নরকের আগুন জ্বলে। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে শুয়ে থাকে সে চুপচাপ। একটু নিশ্বাসের শব্দেই ছেলে নড়েচরে উঠে। ছইয়ের নৌকার বাইরে বাতাস বয়। ক্রমে ক্রমে বাতাসের শব্দ তীব্র হতে থাকে। বুকের ভেতরটা অজানা ভয়ে কাঁপতে থাকে তিস্তার। বৃষ্টি শুরু হয়েছে। তুমুল বৃষ্টি। তিস্তার মনে পরে বাবুর ঘরে একটা রেডিও ছিলো। নদীতে তুফানের খবর বলা হয়েছিলো সেই রেডিও সংবাদে। পাঁচ নাম্বার বিপদ সংকেত। তিস্তা মনোযোগ দিতে পারেনি। তার কেবল ঘরে ফিরতে ইচ্ছে করছিলো। কখন সকাল হবে। কখন ছেলের মুখ দেখবে। ভয়ার্ত তিস্তা হঠাৎ টের পায় বাতাসে নৌকার পালের দড়ি ঘাট থেকে ছিঁড়ে গিয়েছে। ছেলের বাপ এখনো ফেরেনি। কোথায় তাড়ি খেয়ে পড়ে আছে কে জানে! ছেলেকে বুকের সাথে চেপে ধরে পীর মুর্শিদের নাম জপতে থাকে তিস্তা। মনে হয় নূহ নবীর নৌকায় চড়ে অজানায় পাড়ি জমাচ্ছে মায়াবতী জননী। আশেপাশের নৌকাগুলোর চিৎকারের শব্দ ক্রমেই দূর হয়ে আসছে। ঝরের দাপট বেড়ে চলছে। চিড়বির করে বাজ পরে। তাদের নৌকা একাকী ভেসে চলেছে। উল্টে যাবার আগে নৌকার ভেতরে তিস্তার বুকের সাথে জাপ্টে ধরা ছিলো আটমাস বয়সের ক্রন্দসী ছেলে। ফুল ঝরে যাবার পর কাশবনকে মনে হচ্ছে যেন উলঙ্গ এক বালুচর। তিস্তা যখন চোখ মেলে চেয়েছিলো আকাশে তখন সন্ধ্যা ঘনাচ্ছে। চারিদিকে চিকচিক করছে বালি। মাটির সাথে মিশে যেতে পারেনি কারুনের ধন। অফুরান রত্ন আজো বালিতে জানান দেয় কারুনের ঐশ্বর্য। হাতের মুঠোতে বালিধরা। শেষবার, মনে পরে তিস্তার, হাতের মুঠোয় ধরা ছিলো তার আটমাস বয়সি ছেলে। শরীর নাড়াতে পারেনা তিস্তা। কোনোমতে ঘার ঘুরায়। কোথাও কোন জীবিত মানুষের অবয়ব চোখে পড়ে না। না কাক না পক্ষী। এখানে ওখানে দু’চারটে মানুষের মরা শরীর। পেট ফুলে ঢোল হয়ে আছে। একটা বুড়ি উবু হয়ে পরে আছে খানিকটা দূরে। সন্ধ্যার মরা আলোয় বালিতে উঠে বসে তিস্তা। নদীর এপার ওপার দেখা যায় না। ভাসতে ভাসতে কোথায় এসে পরেছে, খোদা রাসুল জানে। চারিদিকে কালো পানি তার মধ্যে একটুকরা চরা। খানিক কান পেতে থাকার পর মানুষের শব্দ শুনতে পায় তিস্তা। বোধহীন শরীর টেনে স্খলিত বসনা মেয়েটি পাশে গিয়ে বসে বারো তের বছর বয়সী কিশোরীর। : মাগো বড় তিয়াস, জল দেও সারাদিনে জমে থাকা দুধ বুক বেয়ে ঝরছে তিস্তার। ব্যথায় বুক টনটন করে। ছিঁড়ে পরে যেতে চাইছে মাইদুটো। এই প্রথম ছেলের মুখ মনে পড়ে। সন্ধ্যার মরা আলোয় কাঁচুলির হুক খুলে স্তনবৃন্ত গুঁজে দেয় কিশোরীর ঠোঁটে। আকাশে আবীর রং দেখে বুঝা যায়, মাগরীবের ওয়াক্ত। হাইয়া আলাল ফালাহ, হাইয়া আলাল ফালাহ। কল্যাণের পথে এসো, কল্যাণের পথে এসো।এইচআর/এমএস

Advertisement