দিনের আলো নিভে গেছে সবে। সন্ধ্যার ভিড় ঠেলতে ঠেলতে রিকশার বেল বাজছে ক্রিং ক্রিং। ওপারে লাইটার জাহাজের সাইরেনও শোনা যাচ্ছিল। এমন আলো-আঁধারের খেলায় এসে যোগ দিল ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা ট্রেনটির তীর্যক আলো। আর তাতেই ওর রং মাখানো বদনখানি যেন ঝিলিক দিয়ে উঠল। তানিয়া। বয়সের সঠিক হিসেব মেলাতে পারল না। ১২ বছর ধরে এ পথে রয়েছেন। বাড়ি চাঁদপুরে। কাজের তাগিদে ১৪ বছর বয়সে নারায়ণগঞ্জে এসেছিলেন। যার হাত ধরে এসেছিলেন, সে হাতে আর ভর কুলায়নি। নারায়ণগঞ্জের লঞ্চঘাটেই একা ফেলে লাপাত্তা হয় বন্ধুসম পুরুষটি। পাল্টে যায় জীবনের হিসেবে। কত টাকায় বিক্রি হয়েছিল কিশোরী তানিয়ার দেহটি, তাও জানার অধিকার ছিল না।আর ফেরা হয়নি আলোর পথে। অন্ধকার হোটেলের চোরা পথেই কাটিয়েছে ৫ বছর। এ হোটেল থেকে ও হোটেল। এক খদ্দেরের হাত ছেড়ে আরেক খদ্দেরের হাতে পড়া। প্রতি রাতে খদ্দের বদলেছে, কিন্তু জীবনের রং বদলাতে পারেনি আজও। হোটেলে কাজ বন্ধের পর গ্রামে ফিরেছিলেন একবার। তবে স্থায়ী হওয়া সম্ভব হয়নি সেখানে। আবারও ফিরেছেন অন্ধকার পথেই।এখন কাজ করেন নারায়ণগঞ্জ রেলস্টেশনের পরিত্যক্ত খোলা জায়গায়। সেখানেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা হয় তানিয়ার সঙ্গে। বলেন, যার ফাঁদে পা দিয়ে এ পথে এসেছিলাম, তার সঙ্গে টানবাজারের সম্পর্ক ছিল। সে-ই টানবাজারের এক সরদারনির হাতে তুলে দিয়ে পালিয়ে যায়। টানবাজারের পতিতাপল্লী উচ্ছেদের পর সরদারনি হোটেলে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। আমার মতো অনেককেই ফাঁদে পড়ে হোটেলে কাজ করতে হয়েছে। এক সময় হোটেলেও বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকেই খোলা জায়গায় কাজ করছি।তানিয়ার জীবনালাপ শুনতে যোগ দেয় লক্ষ্ণী নামের আরেক ভাসমান যৌনকর্মী। বয়স ২৮ কি ৩০ হবে হয়তো। তবে শরীরের গাঁথুনি বয়স বেশ বাড়িয়ে দিয়েছে। ভাঙা চোয়াল। শীতে জড়িয়ে যাওয়া শরীর পাতলা ওড়নায় সামাল দেয়ার চেষ্টা করছিল বারবার। ইয়াবা সেবন করেছে খানিক আগেই। আগে হিরোইনে আসক্তি ছিল লক্ষ্ণীর। গত ৬ বছর থেকে রাত কাটে ইয়াবা সেবন করেই।বললেন, আমার জন্মই টানবাজারের পল্লীতে। এ পেশা মায়ের কাছ থেকেই শেখা। মা মরে বেঁচে গেছেন। কিন্ত আমার আর ফেরা হয়নি। বিয়ে করেছিলাম। ঘরে একটি মেয়েও আছে। রাত জেগে যত আয় করতাম, তার সবই যেত স্বামীর নেশার ঘরে। ওর কারণেই আমি নেশার ঘোরে। টানবাজার থেকে উচ্ছেদ হওয়ার সেই বিভীষিকাময় রাতের কথাও শোনালেন লক্ষ্ণী। বলেন, ভোরের দিকের কথা। হঠাৎ করেই বাঁশির শব্দ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভাঙচুর শুরু হল। নেতা-পুলিশ এক হয়ে হামলা করল। ঘর থেকে কিছুই বের করতে পারিনি। পুনর্বাসনের কথাও বলা হয়েছিল। কিন্তু আজও মাথা গোঁজার ঠাঁই মেলেনি।এখন স্টেশনই আমার ঘরবাড়ি। মেয়ে গ্রামে থাকে। তানিয়া-লক্ষ্ণীর আলাপের ছলে রাত ঘনিয়ে আসে। খদ্দেরদের আনাগোনাও বাড়তে থাকে। কড়া সুগন্ধি আর মেকআপ মেখে আরও ডজন দুই যৌনকর্মী দখলে নেয় পরিত্যক্ত রেললাইনের কিছু অংশ। বয়স আর রূপের ওপর ভর করে দাম হাকাচ্ছেন যৌনকর্মীরা। সর্বোচ্চ দু’শ, তবে পঞ্চাশ টাকাতেও মিলছে খদ্দের।ততক্ষণে গল্পের ডালা গুটিয়ে বিদায় জানায় লক্ষ্ণী-তানিয়াও। রেলস্টেশন থেকে শতেক গজ দূরেই টানবাজার। তানিয়াদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েই যাত্রা টানবাজারে।পতিতাদের উচ্ছেদের পর টানবাজারের রূপ বদলেছে। বদলেছে নামও। টানবাজারের নাম এখন ‘টানবাজার পার্ক’। পাশেই মিনাবাজার নামে আবাসিক হোটেলও বসেছে। এমন আরও আরও নাম বসিয়ে টানবাজারের কালিমা মুছে দেয়ার চেষ্টা চলছে। কিন্তু জীবনের গন্ধ যেখানে অম্লান, তা কি মুছে ফেলা যায়?টানবাজারের রাস্তার উপরে চা বিক্রি করেন নরেশচন্দ্র রায়। টানবাজারে তিনটি ঘর ভাড়া নিয়ে দেহব্যবসা করতেন নরেশ। বলছিলেন, ‘ঘরগুলো এখনও রয়ে গেছে। সেখানে এখন সুতা-কাপড়ের ব্যবসা হয়। শীতলক্ষ্যায় শানবাঁধা ঘাটও রয়েছে। কিন্তু সে ঘাটে ওরা আর স্নান করতে আসে না। এরপরেও টানবাজারে এলে মানুষেরা বিশেষ টান অনুভব করে। শত বছরের পল্লীর অদৃশ্য যে রূপ রয়ে গেছে, তা কি চাকচিক্যের আড়ালে মুছে ফেলা যায়!ঘটনার দেড় দশক পেরিয়েছে। ২৪ জুলাই ১৯৯৯। ভোরের আভা তখনও ফোটেনি। অন্ধকারে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তারা আর কয়েকশ পুলিশ উচ্ছেদ করেছিল নারায়ণগঞ্জের টানবাজার ও নিমতলি যৌনপল্লী। জনতা আর পুলিশি তাণ্ডবে মুহূর্তেই খান খান হয়ে যায়, শত বছরে গড়ে ওঠা দেহব্যবসায়ীদের শেষ সম্বলটুকুও।টানবাজার উচ্ছেদের নেপথ্যে ছিলেন নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের তৎকালীন সরকারদলীয় এমপি শামীম ওসমান।পুনর্বাসনের নামে উচ্ছেদের সেই যজ্ঞে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের আশীর্বাদ ও সক্রিয় সমর্থনও ছিল। উদ্দেশ্য ছিল, যৌনপল্লীর বিএনপিপন্থী বাড়িওয়ালাদের আর্থিক কোমর ভেঙে দেয়া। তবে সময়ের বিবর্তনে বাড়ির মালিকদের কোমর আরও শক্ত হয়েছে। টানবাজারে ইটের উপর ইটের গাঁথুনিতে বহুতল ভবন নির্মাণ হয়েছে, হচ্ছে। রমরমা ব্যবসা হচ্ছে সুতা-কাপড়ের। কিন্তু সহস্রাধিক দেহব্যবসায়ীর কোমর সেই যে ভাঙল, তা আজও সোজা হয়নি।এএসএস/এএইচ/ওআর/আরআইপি
Advertisement