শুরুতেই ধাক্কা খেলাম। ‘ধাক্কা খেলাম’ বললাম এ জন্য যে, আমাদের প্রত্যাশাটা ছিল অনেক বেশি। দেশের মাটিতে টানা ম্যাচ জিতছিলাম। একের পর এক সিরিজ জিতেছি। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষেও এর আগে টানা বেশ কয়েকটি ম্যাচ জয় আছে আমাদের। হয়তো তার ধারাবাহিকতায় দেশের মানুষের যে প্রত্যাশা এবং আমাদের যে আত্মবিশ্বাস ছিল, সে জায়গাটায় কিন্তু আমাদেরকে মাটিতে নামিয়ে নিয়ে এসেছে এই এক ম্যাচের হারে। যদিও আমরা ম্যাচটা নিউজিল্যান্ডের মাটিতে, তাদের অনুকুল পরিবেশে খেলেছি। তারপরও আমি বলবো যে, বাংলাদেশ জাতীয় দলে যে ক্রিকেটাররা খেলেছে, তাদের মধ্যে অধিকাংশই নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটারদের চেয়ে বেশি অভিজ্ঞ। সে জন্যই আমি আগেও বলেছি, আমরা কিন্তু অনেক অভিজ্ঞ একটি দল। আজ (প্রথম ম্যাচে) খেলার শুরুতে যে ব্যাপারগুলো ছিল, সেটা হচ্ছে শারীরিক এবং মানসিক ভাষা- দু’দিক থেকেই নিউজিল্যান্ড এগিয়ে ছিল আমাদের চেয়ে। এতদিন আমরা ভাবতাম, বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড়দের বয়সের তুলনায় ফিটনেস বেশ ভালো; কিন্তু এই ম্যাচে আমাদের চোখে পরিস্কার হয়ে গেলো, ফিটনেসে আমরা নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটারদের চেয়ে অনেক বেশি পিছিয়ে। রানিং বিটুইন দ্য উইকেট থেকে শুরু করে, বলের পেছনে দৌড়ানো থেকে শুরু করে, পাওয়াফুল শটের যে ঘাটতি দেখেছি, তাতে দু’দলের মধ্যে পরিস্কার পার্থক্য ফুটে উঠেছে। ৭৭ রানে আমরা ম্যাচটা হেরেছি সত্য; কিন্তু এখনও অনেক জায়গা আছে যেখানে আমরা উন্নতি করতে পারি। আমাদের পেস বোলিং যাচ্ছেতাই মানের হয়েছে আজ। হ্যাগলি ওভালের ওই উইকেটে মাশরাফি এবং মোস্তাফিজ কিছুটা সঠিক লাইন এবং লেন্থে বোলিং করেছে। তাসকিনকে দেখে মনে হয়নি, ম্যাচের পরিস্থিতি দেখে বল করছে বা ফিল্ডিং যে দিকে আছে সেদিকে বল করছে। সব সময় মনে হয়েছে যে, সে শুধু বল করতে হবে তাই বল করছে।স্পিনারদের মধ্যে সাকিব এবং মোসাদ্দেক ভালো বল করেছে। তবে নিউজিল্যান্ডের বড় ইনিংসের পেছনে আমাদের বোলারদের ব্যর্থতার সঙ্গে তাদের ব্যাটসম্যানদেরও কৃতিত্ব দিতে চাই। বিশেষ করে টম ল্যাথাম এবং কলিন মুনরো। অসাধারণ ব্যাটিং করেছে এই দু’জন। তাদের ব্যাটিংয়ের সবচেয়ে বড় যে দিকটা ছিল, তারা আসলে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী। শুরু থেকেই দেখেছি, তারা রানের জন্য মুখিয়ে। দেড় রানকে দুই রান করছিল, আড়াই রানকে করছিল তিন রান। ওই জায়গাটায় আমরা যদি খেলাটাকে স্লো করে দিতে পারতাম, কোনোভাবে আরেকটা উইকেট নিয়ে নিতে পারতাম, তাহলে তাদেরকে হয়তো ৩৪১ রান করার সুযোগ দিতাম না। বোলিং ডিপার্টমেন্টে আমরা সাকিবের সামর্থ্য এবং অভিজ্ঞতার পুরোটা কাজে লাগাতে পারিনি। তারপরও আমি বলবো, এই ম্যাচ থেকে যে শিক্ষা আমরা পেয়েছি, বিশেষ করে বোলিং এবং ফিল্ডিংয়ে- পরবর্তী ম্যাচগুলোতে যেন এই ভুলগুলো না করি। ব্যাটিংয়ের ক্ষেত্রে বলবো, ব্যাটসম্যানদের সামনে ছিল বিশাল একটি ইনিংস। ৩৪১ রান তাড়া কিন্তু সহজ ব্যাপার নয়। সঙ্গে যদি নিয়মিত বিরতিতে উইকেট পড়তে থাকে, তাহলে তো কথাই নেই। নিউজিল্যান্ডের মাটিতে আমরা সব সময়ই বলে আসছিলাম, উইকেট একটা ফ্যাক্টর। উইকেটে বাউন্স ছিল, পেস ছিল না। এরকম ব্যাটিং উইকেট আমি অনেকদিন দেখিনি। একটা সলিড ব্যাটিং উইকেট পেয়েছিলাম আমরা। ৩৪২ রান লক্ষ্য ছিল। আমরা ৩১০ থেকে ৩২০ রান করতে পারলে হয়তো আমি আরেকটু সন্তুষ্ট হতে পারতাম।ব্যাটিং অ্যাপ্রোচের কথা বলবো, বেশ কিছু জায়গা আছে যে জায়গাগুলো চিহ্নিত করতে হবে। যেমন সেট হয়েই আউট হয়ে যাওয়া। এর সঙ্গে মাহমুদউল্লাহকে কোনো দোষ দেবো না, কারণ সে সেটই হতে পারেনি। মুশফিক তো ইনজুরড হয়ে গেলো, তামিম, সাকিব, মোসাদ্দেক- ওরা যে ব্যাটিংটা করেছে; হয়তো রানের সংখ্যার দিক থেকে মনে হবে বেশ ভালো ব্যাটিং করেছে; কিন্তু দলের প্রয়োজনে যে ব্যাটিংটা করার দরকার ছিল সেটা করতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। তার প্রমাণ কিন্তু ওদের কলিন মুনরো যে ইনিংসটা খেলেছে সেটা। ওই জায়গাটাতেই আমরা পিছিয়ে গিয়েছি। আপনি যদি নিউজিল্যান্ডের ব্যাটিংটা দেখেন, দুটি পার্টনারশিপ- একটা কেন উইলিয়ামসনের সঙ্গে টম ল্যাথাম আর আরেকটা ল্যাথামের সঙ্গে কলিন মুনরোর। এ ধরনের পার্টনারশিপ আমাদের হয়নি একটাও। আমাদের হয়েছে- তবে সেগুলো খুব ছোট ছোট। যে পার্টনারশিপগুলো আমাদের বড় করার সুযোগ ছিল। এই জায়গাটায় যদি খেয়াল করি আগামী ম্যাচে, তাহলে আমাদের এখানে উন্নতি করার সুযোগ আছে। আর আমাদের ব্যাটিংয়ের যে অ্যাপ্রোচ ছিল, সেই অ্যাপ্রোচ কিছু জায়গায় চাপা পড়ে গিয়েছে। এখানে ইতিবাচক কিছু থেকেও কোনো লাভ হলো না। আর আমাদের তুলনায় নিউজিল্যান্ডের ব্যাটিং-বোলিং এবং ফিল্ডিং ছিল অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত। ওদের (নিউজিল্যান্ড) অ্যাপ্রোচ ছিল প্রথম বল থেকেই অন্যরকম যে, আমরা জিততে এসেছি। অথচ আমাদের (বাংলাদেশ) বডি ল্যাঙ্গুয়েজে, প্রথম বল থেকে কোনোভাবেই মনে হয়নি যে আমরা আসলে জিততে নেমেছি। সব ম্যাচে সব দল কিন্তু জিততেই নামে। তারপরও আমার কাছে মনে হয়েছে যে, বাংলাদেশ দলের মাঝে সেটা ছিল না।বাংলাদেশ দলের জন্য এই ম্যাচটা ছিল একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সব সময়ই সবাই বলে আসছিল ঘরের মাঠে বাংলাদেশ ভালো খেলে। তবে বিদেশের মাটিতে কেমন খেলে সেটা দেখার বিষয়। সে কারণে এই ম্যাচটা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবুও আমি বলবো, তার মানে এই নয় যে আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে। আরও দুটো ম্যাচ বাকি আছে এবং আমাদের দলে অভিজ্ঞ যে খেলোয়াড়রা আছে, একই সঙ্গে এই ম্যাচে যে ভুলগুলো করেছি, এগুলো যদি আমরা শোধরাতে পারি, পরের ম্যাচগুলোতে যদি আরও ভালো ক্রিকেট খেলতে পারি, তাহলে সবকিছু আমাদের পক্ষেই চলে আসবে আশা করি। আমাদের সে সামর্থ্য আছে। এর আগেও আমরা প্রমাণ করতে পেরেছি। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, এই ম্যাচটা কিন্তু শেষ হয়ে গিয়েছে। শেষ হওয়ার পর আমরা যদি রিলাক্সড হয়ে যাই, নিজেদের মধ্যেই সন্তুষ্টি চলে আসে, তাহলে কখনোই আমরা এগুতে পারবো না। আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে- এই ভুলগুলো যেন আর সামনে না করি এবং নিজেদের সেরা ক্রিকেটটাই যেন খেলতে পারি। আরেকটা বিষয়, আমার বেশ চোখে লেগেছে সেটা হলো- দলে ব্যাটিংয়ের যে রোলগুলো আছে, এগুলো আমার কাছে পরিস্কার নয়। পরিস্কার নয় মানে- নাম্বার থ্রি, নাম্বার ফোর, নাম্বার ফাইভ- এই স্থানগুলোতে কে কী জন্য ব্যাট করতে নামছে, ম্যাচের পরিস্থিতি অনুযায়ী তাদের ভুমিকা কী হবে, কীভাবে খেলতে হবে এ বিষয়গুলোতে আমাদের আরও বেশি মনযোগি হওয়া উচিৎ। সৌম্য সরকারকে আমরা মনে হয় অনেক বেশি সুযোগ দিয়ে ফেলেছি। কী কারণে এতটা সুযোগ দেয়া হচ্ছে- এটা আমি জানি না। যেখানে নাসিরের মত খেলোয়াড় বাইরে পড়ে আছে। আমাদের আরও অনেক পারফরমার আছে, সেখানে কেন সৌম্যকে এত বেশি সুযোগ দেয়া হচ্ছে তা আমার বুঝে আসে না। পুরোটা ম্যাচে বোলিং-ব্যাটিং-ফিল্ডিং সব জায়গাতেই নাসিরকে খুব মিস করেছি। আরেকটা জায়গায় আমাদের খুব কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়া উচিৎ। তাসকিনের জায়গায় রুবেল। ম্যাচের দিকে তাকালে দেখবেন, মাশরাফি যখন বল করতে আসে তখন যদি ওরা মেরে খেলে, তখন মাশরাফি খেলাটা স্লো করে দেয়। মোস্তাফিজও এই বয়সে শিখে গেছে, স্লো করে দেয়াটা। মার খেলে কিছুটা সময় নিয়ে ওভার শেষ করে। খেলা স্লো করে দেয়। যাতে ব্যাটসম্যানের মনসংযোগে ছিড় ধরে। একটা ওভার শেষ করতে প্রায় সাড়ে তিন মিনিট কিংবা চার মিনিট সময় লাগিয়ে দেয়। কিন্তু তাসকিনের বোলিং দেখলে মনে হয়, দেড় মিনিটে ওভার শেষ করতে হবে। ম্যাচের পরিস্থিতি অনুযায়ী এই জিনিসগুলো না বুঝলে তো হবে না। তার জায়গায় রুবেলকে খেলানো উচিৎ। মিরাজকেও মিস করেছি। যদিও এই দলটাতে মিরাজকে নেয়ার জায়গা ছিল না। মোসাদ্দেক ভালো বল এবং ব্যাট করেছে। তার সঙ্গে যদি নাসির থাকতো, তাহলে আমাদের দলে আরও ভারসাম্য আসতো। একটা সলিড টিম হয়ে যেতো। তখন নাম্বার থ্রিতে মাহমুদউল্লাহ, নাম্বার ফোরে সাকিব, ফাইভে মুশফিক, সিক্সে নাসির, সেভেনে মোসাদ্দেক- কত সুন্দর ব্যাটিং লাইনআপ হয়ে যায়। আজকের ম্যাচ শেষে মনে হলো, যে একাদশ সাজিয়েছি আমরা- এটা ছিল সম্পূর্ণ ভুল একাদশ। অর্থ্যাৎ একাদশ নির্বাচনই আমাদের ভালো হয়নি। আর লেগ স্পিনার একজন নেয়া হয়েছে ১৪ জনের দলে। এটা আমার মনে হয়েছে বিলাষিতা। একজন লেগ স্পিনার স্কোয়াডে রাখতে হবে, যতি তাই ভেবে রাখা হয় তাহলে সেটা সম্পূর্ণ ভুল। এটা হতে পারে না। আইএইচএস/আরআইপি
Advertisement