মতামত

ক্যাম্পাস গণতন্ত্র

ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার পর সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস ও পরীক্ষা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ক্যাম্পাসে সব ধরনের সভা-সমাবেশ, মিছিল-স্লোগান নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ছাত্রদের তিনটি আবাসিক হল আগামী ১ জানুয়ারি পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। গত বুধবারের ঘটনা এটি। ভাগ্য ভাল যে, কোন প্রাণ হানির ঘটনা ঘটেনি। তবে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাশ পরীক্ষা চালু হয়েছে। আগামীকাল ২৫ ডিসেম্বর হলগুলোও খুলে দেয়া হবে। এরকম ঘটনা প্রায়ই ঘটছে, প্রাণ যাচ্ছে, রক্ত ঝরছে, সাধারণ শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার ক্ষতি হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন মানেই একাধিক গ্রুপ এবং রক্তারক্তি। এখন ছাত্রলীগের মধ্যে এমনটা হচ্ছে, এক সময় ছাত্রদলেও তা দেখা গেছে। এসব সংঘর্ষ আর সহিংসতার ছবি টিভি পর্দায়, কিংবা পত্রিকায় দেখে যেকোন স্বাভাবিক বোধ সম্পন্ন মানুষের কষ্ট লাগে। ফলে ছাত্ররাজনীতি নিয়েই এক ধরনের নেতিবাচক মনোভাব গড়ে উঠছে। ছাত্র রাজনীতি আছে, তার নামে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি আছে। কিন্তু দেশে দীর্ঘ সময় কোন ছাত্র আন্দোলন নেই। ছাত্ররা রাজনীতি করবে না এমনটা বলার অর্থ হলো তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করা। তবে স্বীকার করতেই হবে যে, ছাত্র রাজনীতির নামে চলা হিংসার তাণ্ডবে আজ কোন ইতিবাচক ভাবমূর্তি নেই ছাত্ররাজনীতির। নব্বইয়ে স্বৈরাচার হটিয়ে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার পর থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রসংসদ নির্বাচন হয় না। কথায় কথায় আমরা এদেশের বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনায় ছাত্র আন্দোলনের প্রসঙ্গ টেনে আনি। কিন্তু ভাবছিনা একবারও এখন আর সেই ছাত্র আন্দোলন নেই। একটা সময় ছিল ছাত্র আন্দোলন ছিল ছাত্রদেরই আন্দোলন। কিন্তু এখন ছাত্র রাজনীতিতে ছাত্রদের ভূমিকা প্রান্তিক। ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বও ঠিক করা মূল দলের কেন্দ্র থেকে। আর এলাকা দখলের রাজনীতির দাপটে নেতাদের মদতে সেই জায়গা দখল করে রাখছে সশস্ত্র  ক্যাডাররা। এই বাস্তবতায় সামগ্রিক ছাত্র আন্দোলনের অবস্থা নিতান্ত করুণ। আগে গুন্ডারা ছাত্রদের সমঝে চলত, এখন ছাত্ররা গুন্ডাদের মেনে চলে। ছাত্রদের রয়েছে তীব্র আবেগ, তীব্র ন্যায়-অন্যায়বোধ এবং আদর্শনিষ্ঠ চারিত্র্যিক সততা। এবং এ কারণেই আমরা দেখেছি দেশের স্বাধীনতার আগে এবং পরে সকল গণআন্দোলনে, দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে এই অপরিণামদর্শী তারুণ্য সব সময় সংগ্রামের সামনের সারিতে থেকেছে। কিন্তু সেই ছাত্ররাই নিজেরা নিজেরা, নিজের দলের কর্মীদের পর্যন্ত জীবন কেড়ে নিচ্ছে। অনেকেই বলার চেষ্টা করেন দলীয় রাজনীতি করার কারণেই ছাত্ররা দলের ক্রীড়নক হয়ে পড়ছে। কথাটা পুরোপুরি উড়িয়ে দেয়া যাবে না। কিন্তু একথাওতো মানতে হবে যে, ১৮ বছরের কেউ ভোট দিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করতে পারলে, দলীয় রাজনীতি কেন করতে পারবে না? অন্য সকলের যেমন দলীয় রাজনীতি করার বা না-করার অধিকার আছে, তেমনই ছাত্রদেরও তা আছে।প্রতিনিধি নির্বাচনের গণতান্ত্রিক পাঠ শিক্ষার্থীরা লাভ করে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে। অথচ এই অধিকার প্রয়োগ করতে পারছেনা তারা দীর্ঘদিন। আর এ কারণেই ছাত্ররাজনীতি দলীয় বৃত্তে বন্দি হয়ে পড়ছে। ফলে বিভিন্ন ক্যাম্পাসে নানা অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটছে। এমন একটা বক্তব্যও মাঝে মাঝে উচ্চারিত হয় যে, দেশের সমস্যা নয়, ছাত্ররা তাদের নিজস্ব দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন করবে। কিন্তু তা কি সম্ভব? জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক বিষয়ে বরাবরই ছাত্ররা পথে নেমেছে এবং আগামীতেও নামবে। আবার নিজস্ব দাবিদাওয়াও নিশ্চয়ই তারা অবজ্ঞা করবে না, এটা প্রত্যাশা। কলেজে- বিশ্ববিদ্যালয়ে জবরদস্তি দখলে রাখার প্রতিযোগিতা করে ছাত্রসংগঠনগুলো। রাষ্ট্র ক্ষমতায় দল বদলায়, কিন্তু ছাত্র-রাজনীতির কলুষ দূর হয় না। মারামারি খুনোখুনি ছাড়াও সহপাঠিনীর শ্লীলতাহানি করার মতো ঘটনাও ঘটে অহরহ, হাত তোলা হয় শিক্ষকদের উপর। এ সবের পেছনে আছে সর্বস্তরের রাজনৈতিক মেরুকরণ ও বিভাজনের প্রভাব। কিন্তু তার পরও বলতে হবে, ছাত্র রাজনীতি অবাঞ্ছনীয় নয়। কথায় কথায় অনেকেই পশ্চিমের গণতন্ত্রে ছাত্র রাজনীতির কথা টেনে আনেন। বলার চেষ্টা হয় ইউরোপ-আমেরিকার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা রাজনীতি করে না। তবে, কথাটা সর্বাংশে সত্য নয়। সেখানকার ছাত্রছাত্রীরা যথেষ্ট রাজনীতি করে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা আর সমাবেশ বা সংগঠন করার অধিকার সেসব দেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। ছাত্র-ছাত্রীরা তাহলে কেন করবে না। সেসব দেশে রীতিমতো ছাত্র আন্দোলন হয়। আজকাল অনলাইন আর সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে দেখতে পাই পশ্চিমা বহু দেশের  বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিশ্বে চলমান নান ঘটনা নিয়ে সভা-সমাবেশ হচ্ছে, পোস্টারিং হচ্ছে। এটিও রাজনীতি। আর ছাত্র সংসদ নির্বাচনও সেসব ক্যাম্পাসে নিয়মিত। আমরা ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ করে দিয়ে উচ্চশিক্ষিত প্রজন্মকে রাজনীতিবিমুখ করে তোলার এক নষ্ট খেলায় মেতে আছি। এ কারণেই ছাত্র সংগঠনগুলো স্বাতন্ত্র্য হারিয়েছে, জড়িয়ে পড়ছে নানা দুর্নীতি এবং অর্থকরী কার্যক্রমে। টেন্ডার বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, ভর্তি বাণিজ্যের কথা এসব কারণেই বেশি ঘটছে, ঘটছে দলাদলি, বিশৃঙ্খলা আর সহিংসতা, বাড়ছে ধর্মান্ধতা, উত্থান ঘটছে জঙ্গিবাদের। শিক্ষায়তনে সুস্থ পরিবেশ প্রশ্নে এখন শিক্ষার্থীদের কোন ভূমিকা নেই। সব কিছুই করে প্রশাসন বা কর্তৃপক্ষ এবং শিক্ষকমণ্ডলী। ছাত্র সংসদের নির্বাচন না হওয়ায় ছাত্রছাত্রীরা বাদ সব কিছু থেকে। আর এমনভাবে আমাদের ক্যাম্পাসগুলোতে তারা বড় হচ্ছে গণতন্ত্রহীন এক পরিবেশে। ছাত্র সংসদ নির্বাচন হওয়াটা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে, কারণ মনে রাখতে হবে ক্যাম্পাস গণতন্ত্রই ক্যাম্পাসের সহিংসতা রোধের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উপায়। লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি। এইচআর/এমএস

Advertisement