সালতামামি

জৌলুশ হারিয়েছে আইএস

জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস) বিশ্বজুড়েই একটি আতঙ্কের নাম। ২০১৩ সালের আগেই ইরাক ও সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেট নাম দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিল জঙ্গি সংগঠনটি। সে সময় তারা খিলাফত রাষ্ট্র ঘোষণা করেছিল। তবে ২০১৪ সালে ইরাকের রাজধানী বাগদাদ এবং গুরুত্বপূর্ণ মসুল শহরে হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করেই সংগঠনটির ওপর নজর পড়ে বিশ্ববাসীর। বিভিন্ন দেশে ভয়াবহ হামলা, নিরপরাধ মানুষকে শিরশ্ছেদ, অপহরণ, জিম্মি করে অর্থ আদায় আইএসের দৈনন্দিন কাজের একটি অংশ হয়ে দাঁড়ায়।জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরাকে ২০১৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ২৫ হাজার ৩০০’র বেশি বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছে আইএস। তবে সিরিয়ার যুদ্ধ-সংঘাতের কারণে অনেক এলাকায় সংবাদমাধ্যম এবং সাংবাদিকদের প্রবেশ সহজ ছিল না বলে সেখানকার প্রকৃত হতাহতের সংখ্যা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।তবে যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউমেন রাইটস গত সেপ্টেম্বরে এক রিপোর্টে জানিয়েছে, ২০১১ সালের মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত আইএসের হামলায় ৮৬ হাজার বেসামরিকসহ ৩ লাখের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। কোণঠাসা আইএসবেশ কয়েক বছর ইরাক ও সিরিয়ায় প্রভাব বিস্তার করলেও ২০১৫ সালের শেষ দিক থেকেই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ১২ ভাগ এলাকার দখল হারিয়েছে আইএস। প্রতিরক্ষা বিষয়ক গবেষণা সংস্থা আইএইচএস বলছে, ২০১৬ সালের প্রথম ছয় মাসেই জঙ্গি সংগঠনটি বিভিন্ন জায়গা থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। আর এ কারণেই তাদের রাজ্য ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক ওই সংস্থাটি জানিয়েছে, দুই বছর আগে আইএস যতোটুকু এলাকাজুড়ে খেলাফত প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছিল তার তুলনায় সেই এলাকা এখন ২৬ হাজার বর্গমাইলেরও বেশি সঙ্কুচিত হয়েছে।নিজেদের দখলকৃত এলাকা হারিয়ে আইএস এখন মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপে বেসামরিক লোকজনকে লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছে। এ ধরনের হামলা আরো বাড়তে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।আইএইচএসের বিশ্লেষক কলাম্ব স্ট্র্যাক বলেছেন, ইসলামিক স্টেটের এলাকা যেহেতু কমে আসছে সেহেতু এটা পরিষ্কার যে, তারা যেভাবে শাসনকাজ চালিয়ে আসছিল সেটা ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে তারা তাদের অগ্রাধিকারের পরিবর্তন ঘটাচ্ছে।তিনি আরো বলেন, ‘আমরা আশঙ্কা করছি বেসামরিক লোকজনের ওপর হামলা আরো বাড়তে পারে। হামলা হতে পারে অর্থনৈতিক স্থাপনাতেও। এসব হামলা ইরাক, সিরিয়া ছাড়া ইউরোপেও হতে পারে।’আইএইচএস বলছে, ইসলামিক স্টেটের পক্ষ থেকে খেলাফত ঘোষণার ৬ মাস পর ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে ইরাক ও সিরিয়ায় তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকার আয়তন ছিল ৯০ হাজার ৮শ’ বর্গকিলোমিটার। তবে ২০১৫ সালের ডিসেম্বর নাগাদ এই এলাকা ১৪ ভাগ কমে এসেছে। তারপর থেকেই আইএস আরো ৯ হাজার ৭০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা হারিয়েছে।এখন আইএসের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ৬৮ হাজার ৩০০ বর্গকিলোমিটার যা আয়ারল্যান্ড কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের সমান।সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের সরকার বাহিনীর পাশাপাশি রাশিয়া ও ইরানের দিক থেকেও চাপের মুখে পড়েছে আইএস।সম্প্রতি সিরীয় বাহিনী আইএসের হাত থেকে প্রাচীন পালমিরা নগরীও পুনর্দখল করে নিয়েছে। শুধু পালমিরাই নয় ইরাকের গুরুত্বপূর্ণ শহর মসুল, সিরিয়ার আলেপ্পো, দাবিক, মানবিজ, শাদ্দাদি, আল-কারিয়াতিন, তিকরিত এবং ফাল্লুজাসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ এলাকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে আইএস। জঙ্গি সংগঠনটির বেশ কিছু শক্ত ঘাঁটিও দখল করে নিয়েছে সিরীয় এবং ইরাকি বাহিনী। ইরাকে সরকার বাহিনী তাদের মিত্র মিলিশিয়াদের সঙ্গে নিয়ে ইরাকের দক্ষিণের মসুল শহরে আইএসের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে আইএসকে একেবারে কোনঠাসা করে দেয়। এছাড়া রুশ বিমান হামলার মুখে পালমিরা এবং আলেপ্পো শহর থেকেও পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে জঙ্গিরা। সিরিয়া ও তুর্কি সীমান্তেও আইএস নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। ওই এলাকা আইএস মুক্ত বলে দাবি করেছেন তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিম। তিনি বলেছেন, সিরিয়ার সঙ্গে তুরস্ক সীমান্ত থেকে সব সন্ত্রাসী সংগঠন পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। সিরীয় বিদ্রোহীদের সঙ্গে যৌথভাবে তুরস্কের সেনাবাহিনী আইএসের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। তীব্র লড়াইয়ে আইএস ওই এলাকা ছাড়তেও বাধ্য হয়েছে। তবে ইরাক ও সিরিয়ায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মরিয়া আইএস ইয়েমেন, লিবিয়া এবং আফগানিস্তানে বেশ কিছু বিচ্ছিন্ন হামলা চালিয়ে আতঙ্ক তৈরি করার চেষ্টা করেছিল। আইএসের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা লিবিয়া আশ্রয় নেয়। তবে মার্কিন বিমান হামলায় আইএসের বেশ কয়েকটি ঘাঁটি ধূলিস্যাৎ হয়ে গেছে, নিহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতাও। ইরাক ও সিরিয়ার পর কোনো দেশেই বিস্তার করতে পারেনি আইএস। নিরাপত্তা বাহিনীর কড়া অভিযানে প্রতিবারই তাদের কোণঠাসা হতে হয়েছে।ভেঙে পড়েছে আইএসগত দুই বছরে কমপক্ষে ৫০ হাজার যোদ্ধা হারিয়েছে আইএস। মার্কিন সেনা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইরাক ও সিরিয়ায় আইএসের বিরুদ্ধে মার্কিন জোট অভিযান শুরুর পর বহু জঙ্গি নিহত হয়েছে। জোটের হামলায় এ পর্যন্ত কমপক্ষে ৫০ হাজার জঙ্গি নিহত হয়েছে বলে বিবিসির এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।জঙ্গিদের প্রতিহত করতে ইরাক ও সিরিয়ায় স্থানীয় বাহিনীগুলোকে সহায়তা করছে মার্কিন জোট এবং রাশিয়া। তবে আইএস দ্রুতই তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিয়ে নতুন যোদ্ধা নিয়োগ দিতে পারছে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্র।আয় কমেছে আইএসের কয়েক বছর আগে যে রকম দ্রুতগতিতে ইসলামিক স্টেট ইরাক ও সিরিয়ায় বিস্তীর্ণ এলাকা দখল করে নিয়েছিল সেই জৌলুশ হারাচ্ছে জঙ্গিরা। তাদের আয়ের রাস্তাও অনেকটা সীমিত হয়ে গেছে। গত ১৮ মাসে ইসলামিক স্টেটের এলাকা হারানোর গতি দ্রুততর হয়েছে। এতে স্পষ্ট হচ্ছে যে তাদের প্রশাসনিক প্রকল্পগুলো ভেঙে পড়ছে। ফলে তাদের আয়ও কমে গেছে। ২০১৫ সালে তাদের মাসিক আয়ের পরিমাণ ছিল ৮ কোটি ডলার- যা ২০১৬ সালের মার্চে দাঁড়িয়েছে ৫ কোটি ৬০ লাখ ডলার।মার্চের পরের কয়েক মাসে এই আয়ের পরিমাণ আরো ৩৫ শতাংশ কমে গেছে বলে জানিয়েছেন আইএইচএসের সিনিয়র বিশ্লেষক লুডোভিকো কারলিনো। আইএইচ এসের আরেকজন বিশ্লেষক কলাম্বো স্ট্র্যাক বলছেন, আগামী এক বছর সময়কালের মধ্যে আরো শহর ইসলামিক স্টেটের হাতছাড়া হয়ে যাবে এবং এর ফলে একটি কনভেনশনাল বাহিনী হিসেবে আইএস টুকরো টুকরো হয়ে যেতে পারে এবং শেষ পর্যন্ত তারা পরাজিত হবে।স্ট্র্যাক বলেন, তুরস্ক সীমান্তই তাদের খিলাফতে যাওয়া আসার একমাত্র পথ। তবে ২০১৫ সালের জুনে তাল-আবিয়াদ শহরের পতনের পর তাদের আয়ের ওপর চাপ বেড়ে গেছে। ২০১৪ সালে জুন মাসে ইসলামিক স্টেট যখন ইরাকের মসুল শহর দখল করে নেয় তখনই সারা পৃথিবীর দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় এই জিহাদি গ্রুপটির প্রতি। সে সময় তারা ইরাকের রাজধানী বাগদাদের কাছাকাছি এসেছিল। আইএসের সেরা সময়ে তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় প্রায় ১ কোটি লোক বাস করতেন। কিন্তু সে সংখ্যা এখন অনেক কমে গেছে। জাতিসংঘের এক হিসেব অনুযায়ী, খুব সুনির্দিষ্টভাবে জানা না গেলেও আইএস নিয়ন্ত্রিত এলাকায় যুদ্ধ, সন্ত্রাস এবং সহিংসতায় ২৩ হাজারেরও বেশি লোক নিহত হয়েছেন।ইরাক ও সিরিয়ায় আইএস নিজেদের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশ যেমন নাইজেরিয়া, আফগানিস্তান, সৌদি আরব, আলজেরিয়া, মিসরে তাদের শাখা ঘোষণা করেছে। বেশ কিছু ভয়াবহ হামলার ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে আইএস তাদের মতাদর্শ ছড়াতে পারছে না। তাদের মুখপত্র দাবিক দিয়েও তা পূরণ করা যাচ্ছে না। বিশ্বজুড়েই আইএস তাণ্ডব গুটিয়ে আসছে। সেদিন হয়তো খুব বেশি দূরে নয় যখন বিভিন্ন দেশের কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণে আইএস হয়তো নিশ্চিহ্নই হয়ে যাবে। শেষ হবে এক কালো অধ্যায়ের।টিটিএন/আরআইপি

Advertisement