পিরোজপুরের জিয়ানগর উপজেলা চেয়ারম্যান মাসুদ সাঈদী ফেসবুক পেজে ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসের কয়েকটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তার একটি হলো ‘মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ জিয়ানগর উপজেলা কমান্ড কাউন্সিলের সকল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। পুরস্কার নিচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের বর্তমান উপজেলা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব বেলায়েত হোসেন, বর্তমান উপজেলা ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা স্বপন কুমার রায়, সাবেক কমান্ডার মাহবুবুল আলম হাওলাদার (আমার আব্বার মামলার বাদী ও প্রথম সাক্ষী), মুক্তিযোদ্ধা খলিলুর রহমান, মুক্তিযোদ্ধা দেলোয়ার ফকির।’ এই স্ট্যাটাসের সঙ্গে মাসুদ সাঈদী ৫টি ছবিও দিয়েছেন। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, উল্লিখিত মুক্তিযোদ্ধারা উপজেলা চেয়ারম্যানের কাছ থেকে পুরস্কার নিচ্ছেন। ছবিতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদেরও দেখা যাচ্ছে। একই দিন মাসুদ সাঈদী দৈনিক নয়া দিগন্তের একটি নিউজের লিঙ্কও শেয়ার করেছেন। নিউজটিতে বলা হয়েছে, ‘পিরোজপুরের জিয়ানগরে বর্ণাঢ্য বিজয় র্যালি অনুষ্ঠিত হয়েছে। আজ শুক্রবার সকালে উপজেলা পরিষদ ও প্রশাসনের উদ্যোগে সুসজ্জিত বিজয় র্যালিটি উপজেলার পত্তাশী ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় থেকে শুরু হয়ে উপজেলা পরিষদ চত্বরে গিয়ে শেষ হয়। দীর্ঘ ১ কিলোমিটার লম্বা এ র্যালিতে অংশগ্রহণ করেন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মাসুদ সাঈদী, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জাকির হোসেন বাচ্চু, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট এম মতিউর রহমান, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. বেলায়েত হোসেন, ওসি একেএম মিজানুল হক, উপজেলা জেপির সভাপতি আসাদুল কবির তালুকদার স্বপন ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মৃধা মো. মনিরুজ্জামান। র্যালিতে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, উপজেলা আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ছাত্র-ছাত্রী, এনজিও কর্মী এবং সর্বস্তরের জনসাধারণ অংশগ্রহণ করেন। এর আগে সকালে ২১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসের শুভ সূচনা এবং শহীদ বেদীতে পুষ্পমাল্য অর্পণ করা হয়। আরেকটি স্ট্যাটাসে তিনি একটি ক্রেস্টের ছবি দিয়ে লিখেছেন, ‘মহান বিজয় দিবস ২০১৬ উপলক্ষে উপজেলা প্রশাসন থেকে প্রাপ্ত শুভেচ্ছা স্মারক।’একজন উপজেলা চেয়ারম্যান মহান বিজয় দিবসে র্যালি করছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা ও পুরস্কার দিচ্ছেন, জেনে নিশ্চয়ই আপনারা আনন্দিত। এতকিছু যিনি করছেন, উপজেলা প্রশাসন থেকে একটি শুভেচ্ছা স্মারক নিশ্চয়ই তার প্রাপ্য। আপনারাও নিশ্চয়ই তাকে অভিনন্দন জানাতে পারেন।তিষ্ঠ ক্ষণকাল। দাঁড়ান আমরা এই মহান মুক্তিযুদ্ধপ্রেমিক উপজেলা চেয়ারম্যান মাসুদ সাঈদীর পরিচয়টা একটু দিয়ে নেই। মাসুদ সাঈদীর ‘আব্বা’র নাম দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। এই সাঈদীর কথা নিশ্চয়ই আপনারা ভুলে যাননি। এই দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধী এখন বাংলাদেশের কারাগারে, মৃত্যু পর্যন্ত যার সেখানেই থাকার কথা। কিন্তু এই মেশিনম্যানকে প্রায়ই চাঁদে দেখা যায়। তাকে চাঁদে দেখা গেলে তাণ্ডব চলে বাংলাদেশে। সাঈদী একাত্তরে কী কী অপরাধ করেছে, তার বিবরণ দিয়ে জায়গা নষ্ট করে লাভ নেই। তার অপরাধ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রমাণিত। সে অপরাধেই সে আমৃত্যু কারাদণ্ড ভোগ করছে। একাত্তরের পর থেকে তার অপরাধ নিয়ে কোনো মামলা হয়নি, হয়তো হবেও না, হলেও তা প্রমাণ করা হয়তো কঠিন। কিন্তু আমার বিবেচনায় সাঈদীর একাত্তরের পরের অপরাধও কম নয়। বছরের পর বছর ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে দেশে-বিদেশে ওয়াজ করে বেরিয়েছে এই সাঈদী। এটা মানতে দ্বিধা নেই, সাঈদীর ওয়াজ খুব জনপ্রিয়। কেন জনপ্রিয়, এটা জানতে আপনি সাঈদীর ওয়াজের অ্যালবাম সংগ্রহ করে শুনে দেখতে পারেন। আমি নিশ্চিত আপনি সফট পর্নো শোনার আনন্দ পাবেন। এরপর আর তার ওয়াজের জনপ্রিয়তার কারণ অনুসন্ধানে সময় ব্যয় করতে হবে না আপনাকে। গ্রামগঞ্জে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মনে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে দেয়া, তরুণ প্রজন্মকে বিপথগামী করতে এককভাবে সাঈদীর কৃতিত্ব অনেকখানি। একটি উদার, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্নে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত হয়েছে বিজয়। কিন্তু বিজয়ের ৪৫ বছর পরও যে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা নিরাপদ নয়, এখনও যে ইসলামের নামে হামলা হয়, জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটে; তার দায় অনেকটাই সাঈদীর এই অনৈসলামিক, সফট পর্নোর।আপনারা কেউ হয়তো বলতে পারেন, ধান ভানতে শিবের গীত গাইছি কেন। গাইছি, কারণ সাঈদীর সম্পর্কে ছোট একটু ধারণা না পেলে মাসুদ সাঈদীর বিষয়টা বোঝা যাবে না। মাসুদ সাঈদী লোক কেমন, আমি জানি না, কখনো দেখিওনি। সত্যি বলতে, এই স্ট্যাটাস খুঁজতে তার ফেসবুক পেজে গিয়েই তার ছবি প্রথম দেখেছি। কিন্তু মাসুদ সাঈদী একজন দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীর ছেলে। কেউ হয়তো বলতে পারেন, পিতার অপরাধের দায় পুত্রকে দিচ্ছেন কেন। পিতার অপরাধের দায় অবশ্যই পুত্রের নয়। কিন্তু যদি মাসুদ সাঈদী তার পিতার দায় স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে রাজনীতি করতে আসতো, আমি হয়তো অতটা আপত্তি করতাম না। কিন্তু মাসুদ সাঈদীর ফেসবুক পেজের কাভার সাঈদীর মুক্তির দাবিতে একটি র্যালির ছবি দিয়ে সাজানো। পেজেও রয়েছে সাঈদীর বিভিন্ন সময়ের ওয়াজের লিঙ্ক। সাঈদী যে বিষ ছড়াতো, এখন সেই দায়িত্ব পালন করছেন তার ছেলে। আপনারা হয়তো বলতে পারেন, মাসুদ সাঈদী তো জনগণের ভোটে নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান। এখানেই গণতন্ত্র নিয়ে আমার আপত্তি। জিয়ানগরের মানুষ ভোট দিয়েছে বলেই দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছেলে ধোয়া তুলসি পাতা হয়ে যাননি। ভোটের বিজয় তাকে মহান বিজয় দিবস নিয়ে ফাজলামো করার অধিকার দেয়নি।তবে মহান বিজয় দিবস নিয়ে এই ফাজলামোর জন্য আমি মাসুদ সাঈদীকে ততটা দায়ী করবো না। যতটা করবো উল্লিখিত মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের। নিজের গা থেকে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতার দায় মুছে ফেলতে মাসুদ সাঈদী তো চাইবেনই, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষের সাথে মিলেমিশে থাকতে। সাঈদীর মামলার বাদী ও প্রথম সাক্ষী যদি সাঈদীর ছেলের কাছ থেকে পুরস্কার গ্রহণ করে, তখন লজ্জায় আমাদের মাথা হেট হয়ে যায়। এমনিতে দলমত নির্বিশেষে সকল মুক্তিযোদ্ধার প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা। কারণ আমরা জানি একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধারা জীবনের মায়া না করে দেশ স্বাধীন করতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। আমরা অনেক কিছু হতে পারবো। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা হতে পারবো না। কিন্তু সেই মুক্তিযোদ্ধাদের অন্তত পাঁচজন যখন দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীর ছেলের কাছ থেকে পুরস্কার গ্রহণ করেন, আমার মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছা করে। স্থানীয় রাজনীতি, স্থানীয় বাস্তবতার যত দোহাই-ই দেন না কেন, এই পাঁচ মুক্তিযোদ্ধা কোনোভাবেই সাঈদীর ছেলের দায়মুক্তির এই আয়োজন থেকে নিজেদের দায় মুক্ত করতে পারবেন না। আমি মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের কাছে দাবি জানাচ্ছি, তারা যেন অবিলম্বে জিয়ানগর উপজেলা কমান্ডের নেতাদের ডেকে বিষয়টির ব্যাখ্যা দাবি করেন এবং কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। আমি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছে দাবি জানাচ্ছি, জিয়ানগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ যারা মাসুদ সাঈদীর সাথে র্যালি করেছে, একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছে; তাদের অবিলম্বে দল থেকে বহিষ্কার করার।তবে আমি জানি, এ নিছকই অরণ্যে রোদন। আওয়ামী লীগ এখন মামলাজর্জরিত বিএনপি-জামায়াত নেতাদের পুনর্বাসন কেন্দ্র। নিছক দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মতো ‘তারকা’ যুদ্ধাপরাধীর সন্তান বলেই হয়তো মাসুদ সাঈদী আওয়ামী লীগে সরাসরি যোগ দিতে পারছেন না। কিন্তু স্থানীয় আওয়ামী লীগের পৃষ্ঠপোষকতায়ই মাসুদ সাঈদী নির্বিঘ্নে উপজেলা শাসন করছেন। আমাকে জানাতে হবে কেন, সাঈদীর ছেলে যে উপজেলা চেয়ারম্যান এটা তো নিশ্চয়ই ওবায়দুল কাদেরের অজানা নয়। বর্তমান সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। উপজেলা নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের জিতিয়ে আনতে নানা অনিয়ম করেছে নির্বাচন কমিশন ও সরকার। এসব অনিয়মের প্রতিবাদ আমরা সবসময় করে এসেছি। কিন্তু সাঈদীর ছেলের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ তাদের সেই নির্বাচনী অপকৌশল প্রয়োগ করলো না কেন? আমরা যতটুকু জানি, মাসুদ সাঈদী স্থানীয় আওয়ামী লীগের কারো কারো সহায়তায় নির্বাচনে জিতেছেন। এটাও পিরোজপুরের সবাই জানেন, সুধাংশু শেখর হালদারকে হারাতে আওয়ামী লীগেরই একটি অংশ একসময় দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে সংসদ সদস্য হতে সাহায্য করেছে। সেই অংশটিই এখন সাঈদীর ছেলেকে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে।আওয়ামী লীগের নানা অপকৌশলের পরও বিএনপি-জামায়াতের অনেকে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরে নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েই যেন তারা অপরাধ করেছেন। নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই তারা দৌড়ের ওপর আছেন। একের পর এক সত্য-মিথ্যা মামলা দিয়ে, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এক কলমের খোঁচায় জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্ত করে ফেলা তো এখন ডালভাত। নির্বাচনের আগে-পরে সরকারের এসব অগণতান্ত্রিক আচরণের, জনমতের প্রতি বারবার অবজ্ঞা-অশ্রদ্ধার নিন্দা আমরা জানিয়েছি, এখনও জানাচ্ছি। কিন্তু দেখুন, বিএনপি-জামায়াতের অধিকাংশ উপজেলা চেয়ারম্যান যখন দৌড়ের ওপর, তখন মাসুদ সাঈদী বহাল তবিয়তে মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনার নামে অপমান করছে। কলঙ্কিত করছে মহান বিজয় দিবসকে।অন্তত একটি কারণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আমার সারাজীবনের কৃতজ্ঞতা। ’৭৫এর পর বাংলাদেশ যখন উল্টোপথে যাত্রা শুরু করলো, যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে যখন উড়লো জাতীয় পতাকা, তখন আমরা ভাবতে পারিনি, একসময় এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে। দেশী-বিদেশী নানা মহলের চাপ সামলে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত দৃঢ়তায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অসম্ভব কাজ সম্ভব হয়েছে। এখন এই স্থানীয় আওয়ামী লীগের নানা রাজনৈতিক বাস্তবতার দোহাই দিয়ে কেউ যেন তার অর্জন ম্লান করতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্বও তাকেই নিতে হবে। আওয়ামী লীগ যেন জামায়াতের পুনর্বাসন কেন্দ্র হয়ে উঠতে না পারে।১৭ ডিসেম্বর, ২০১৬probhash2000@gmail.comএইচআর/পিআর
Advertisement