শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার উপর দিয়ে বয়ে চলা সোমেশ্বরী নদীর উজানে অবৈধভাবে বালির বাঁধ নির্মাণ করে নদীর গতিপথ বন্ধ করে দিয়েছে উজানের কৃষকরা। ফলে ভাটি এলাকার কৃষকরা চলতি বোরো মৌসুমে সেচ সংকটে পড়েছেন।উজানে বাঁধ নির্মাণের কারণে ভাটি এলাকায় পানির অভাবে কৃষকরা বোরো জমি তৈরি করতে পারছে না। অন্যদিকে শত একর জমি অনাবাদী হয়ে পড়ে রয়েছে।ভাটির কৃষকরা সোমেশ্বরী নদীর এসব বাঁধ ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন।স্থানীয় কৃষি বিভাগ ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, ভারতের মেঘালয়ের পাহাড় চিরে সোমেশ্বরী নদীটি শ্রীবরদী উপজেলার খাড়ামুড়া-বালিজুড়ি সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। পরে এটি ঝিনাইগাতী হয়ে ভাটির দিকে প্রবাহিত হয়ে মালিঝি নদীর সাথে মিশেছে। স্থানীয়ভাবে সোমেশ্বরী নদীটি ‘পাগলা নদী’ নামেই পরিচিত। নদীর এই পানি দিয়ে দুই পাড়ের কৃষকরা বোরো আবাদ করতেন। কিন্তু, প্রায় একযুগ ধরে জলবায়ূ পরিবর্তনের প্রভাবসহ নানা কারণে শুষ্ক মৌসুমে সোমেশ্বরী নদীতে পানির নাব্যতা আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। কয়েক বছর যাবত উজানের কৃষকরা শুষ্ক মৌসুমে নদী থেকে বালু তুলে বাঁধ দেওয়ার ফলে ভাটি এলাকায় এ সময় তীব্র সেচ সংকট দেখা দেয়।ভাটি এলাকার কৃষকরা জানায়, তাদের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র অবলম্বন বোরো আবাদ। কারণ বর্ষা মৌসুমে পাগলা নদীতে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে তাদের কষ্টার্জিত আমন ফসলের এক ছটাক ধানও তারা ঘরে তুলতে পারে না। তাই বোরো আবাদেই পরিবারের সদস্যদের জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। কিন্তু, গত কয়েক বছর ধরে তাদের জীবিকার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে উজানের এই বাঁধ।সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নদীর উজানে শ্রীবরদীর বালিজুড়ি থেকে ঝিনাইগাতীর দুপুরিয়া এলাকা পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার প্রবাহ পথে ৪টি বাঁধের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। নদীর তীর সমান উচ্চতার আড়াআড়িভাবে এসব বালির বাঁধ দেওয়ার ফলে ভাটির দিকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার এলাকায় পানি প্রবাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। এর ফলে ঝিনাইগাতী উপজেলার বিলাসপুর, দুপুরীয়া, বিধামপুর, বাগেরভিটা , ধানশাইল , চাপাঝোরা, দারিয়ারপাড়, নয়াপাড়া, কলিনগর, বালুরচর, মাটিয়া পাড়া, দড়িকালিনগর, সারি কালিনগর, বগাডুবি, সুরিহারা, কোঁনাগাও, বেলতৈল, পাগলার মুখ, লঙ্গেশ্বর, হালগুড়া, পাইকুড়া এলাকার প্রায় সাড়ে তিন হাজার একর জমি সেচ সংকটে পড়েছে। এতে হুমকির মুখে পড়েছে ওই এলাকার প্রায় দুই হাজার কৃষক পরিবার।নদীতে বাঁধ কিংবা অন্যকোনো প্রতিবন্ধতা সৃষ্টি করে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করা আইনত: অপরাধ হলেও উজানের কৃষকরা এসবের কোনো তোয়াক্কা করছেনা। বরং উজানের একশ্রেণির প্রভাবশালী ব্যক্তি নিজেরা টাকা খরচ করে এসব বাঁধ তৈরি করে। পরে তারা বাঁধের ভেতর আটকে থাকা পানি স্যালোমেশিনের সাহায্যে উত্তোলন করে কৃষকদের কাছে বিক্রি করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব বাঁধ অপসারণের জন্য একাধিকবার জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগও করা হয়েছে। দু’একবার বাঁধ কেটে দেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত কাজের কাজ কিছুই হয়নি।জানা যায়, পানির দাবিতে ভাটির কৃষকরা ইতোপূর্বে সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং, মানববন্ধনও করছে। কোনো কোনো সময় সামান্য পানি ছেড়ে দেওয়া হলেও এর স্থায়ী কোনো সমাধান হয়নি। এমনকি নদীর পানি নিয়ে উজান ও ভাটি এলাকার কৃষকদের মধ্যে দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও মামলা মোকাদ্দমাতে জড়িয়ে পড়ার ঘটনাও রয়েছে। চলতি বোরো মৌসুমের শুরুতেই সোমেশ্বরী নদীর উজানে বালিজুরী, কাংশা, আয়নাপুর ও দুপুরিয়া এলাকায় ৪টি অবৈধ বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। উজানের ওই ৪টি বাঁধের আওতায় শ্রীবরদী উপজেলায় প্রায় ৫০০ একর এবং ঝিনাইগাতী উপজেলায় প্রায় এক হাজার একর জমি চাষাবাদ করা হয়। কিন্তু, তাতে করে ভাটিতে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার একর জমি সেচ সংকটে পড়েছে। ভাটির কৃষকরা তাদের জমিতে সেচ সুবিধা পেতে উজানের এসব বাঁধ ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য সরকারের নিকট দাবি জানিয়েছেন।কৃষক শাহাবুদ্দিন মিয়া (৭২) বলেন, আমাদের পানি সমস্যা। পানির বেগরে (অভাবে) ফসল করা হাইতাছিনা (হচ্ছেনা)। উজানে বান (বাঁধ) দেওয়ায় এক ফোঁডা পানিও পাইতাছিনা।এ বিষয়ে ঝিনাইগাতী উপজেলা কৃষি অফিসার এএফএম. কোরবান আলীর সাথে কথা হলে তিনি বলেন, নদীতে বাঁধ দেওয়া বে-আইনী। আমরা উপজেলা প্রশাসনসহ সর্বোচ্চ পর্যায়ে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চেষ্টা করছি। তাছাড়া নদী তীরের কৃষকদের ক্রপ প্যাটার্ন পরিবর্তন করে কম পানি সেচ লাগে এমন ফসল আবাদের জন্য পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি।এসএইচএ/এমএএস/আরআই
Advertisement