‘ট্রেনিং প্রফেশন’ এ দেশে অনেকটা ক্রিকেটের মত। ক্রিকেট যে একটা ক্যারিয়ার হতে পারে এক সময় তা মানুষ ভাবতে পারত না। তেমনই ট্রেনিং প্রফেশনও এগিয়ে যাচ্ছে যুগের চাহিদা মেটাতে। এই পেশায় যারা আসতে চান তাদের জন্যই মূলত লেখাটা। এই পেশা সম্পর্কে যদি আগেই জেনে নিতে পারেন তাহলে সফলতা আসবে অনেক দ্রুত। আপনাকে প্রথমেই ক্যারিয়ার অবজেক্টিভ ঠিক করতে হবে। আগে জানতে হবে প্রতিষ্ঠানগুলোতে কী কী বিভাগ রয়েছে? কোন বিভাগে কী ধরনের কাজ হয় এবং সে কাজ করার জন্য কী ধরনের যোগ্যতা এবং মনোভাব প্রয়োজন। এগুলো জানতে আপনাকে ক্যারিয়ার বিষয়ক সেমিনারগুলোতে অংশগ্রহণ করতে হবে। যারা ইতোমধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন তাদের কাছ থেকেও জানতে পারেন। মূলত যাদের শেখা বা শেখানোর আগ্রহ বেশি অর্থাৎ মানুষের দক্ষতার ইতিবাচক পরিবর্তনের ব্যাপারে যারা অনেক আগ্রহী, মূলত তাদেরই এ জগতে আসা উচিত। এখানে একটা বিষয় বলে রাখা ভালো যে, ট্রেনিং আয়োজন করা আর ট্রেনিং দেয়া কিন্তু আলাদা বিষয়। যে ভালো আয়োজনকারী তিনি যে ভালো প্রশিক্ষকও হবেন এমনটি নয়। ট্রেইনার, ফ্যাসিলিটেটর, কোচ, মেন্টর, ইনস্ট্রাক্টর, শিক্ষক, বস, ম্যানেজার, লিডার- এই টার্মগুলো সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকাটা খুব জরুরি।যাদের প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করার আগ্রহ বেশি; তাদের টিওটি (ট্রেনিং ফর ট্রেইনার) করা থাকলে ভালো। যাদের পাবলিক স্পিকিংয়ের অভ্যাস আছে এবং স্পষ্ট কণ্ঠস্বর; তাদের জন্য এই পেশা বা তাদের জন্য এ দু’টো বিষয় অ্যাডভান্টেজ বলতে পারেন।কিছু প্রতিষ্ঠানে ট্রেনিং ম্যানেজারের কাজ শুধু ট্রেনিং আয়োজন করা। আবার কিছু প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করতে হয় অথবা দু’টোই করতে হয়। যারা ট্রেনিং ইন্ডাস্ট্রির বাইরে আছেন; তাদের মধ্যে কিছু ধোঁয়াশা আছে। ট্রেনিং মানে অনেকে ভাবেন, এটা এমপ্লয়িদের জন্য এক ধরনের মোটিভেশন। অনেকে ভাবেন, এই কাজ করে আসলে কোনো লাভ নেই, শুধু শুধু টাকা নষ্ট। অনেকে ভাবেন, এর মাধ্যমে শুধু কিছু শেখানো হয়। আসলে তা নয়। মজার কথা হচ্ছে, এখানে শিক্ষার্থীদের চেয়ে ট্রেইনারদের বেশি শিখতে হয়। নতুন নতুন বিষয় এবং অ্যাপ্রোচ সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করতে হয়। আমরা যখন অডিয়েন্সের সামনে থাকি; তখন একভাবে কথা বলতে হয়, যখন সহকর্মীদের সাথে তখন অন্যভাবে, আবার যখন পাবলিকলি কথা বলি তখন অন্যভাবে। আবার পরিবার এবং বন্ধুদের সাথে অন্যরকম। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, আপনি যখনই একজন প্রশিক্ষক; তখন আপনি অন্যদের এমন কিছু জানাচ্ছেন যা তারা জানেন না এবং আপনার সে যোগ্যতা আছে বলেই আপনাকে এই দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তাই কথা খুব সাবধানে বলা উচিত। আপনি কাউকে যদি মিসগাইড করেন সেটা হবে গুরুতর অন্যায়। এই পেশায় আপনি মিথ্যাচার করতে পারবেন না। যদি মিথ্যা কথা বলেন তাহলে সমস্যা আছে। সত্য কথা বলতেই হবে। কিন্তু যখন আপনি ট্রেনিং জগতে আছেন তখন এটা অনেক বেশি মেনে চলতে হয়। কারণ এখানে আপনার সাথে অনেক মানুষ রিলেটেড। আপনি যদি মিথ্যা বলেন তাহলে ধীরে ধীরে আপনার জনপ্রিয়তা হারাবেন, মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট হবে। কারণ সত্য সব সময় সুন্দর। সুন্দর জিনিস অসুন্দরভাবে উপস্থাপন করা এক ধরনের কুপমণ্ডুকতা।মনে রাখবেন, ভালো কিছু করতে গেলে কিছু মানুষ আপনাকে পুশ করবে আবার কিছু পুলও করবে। আপনি কোথায় স্পষ্টভাষী হবেন আর কোথায় হবেন না, এটা বুঝতে পেরে কাজ করার মধ্যদিয়ে মানুষ আপানাকে বিচার করবে- আপনি কতখানি স্মার্ট।আমি বলতে চাচ্ছি, আপনি জনপ্রিয়তা হারাবেন তখন; যখন আপনি আপনার বা আপনার আশেপাশের ২-৪টা পরিচিত মানুষের অভিজ্ঞতা বা বাস্তবতাকে পুঁজি করে কোন বিষয় নিয়ে সাধারণীকরণ করবেন। ফাঁকা বুলি (বুল শিট) হয়তো আপনাকে অনেক ওপরে নিয়ে যেতে পারে, কিন্তু আপনি বেশিক্ষণ ওখানে টিকে থাকতে পারবেন না।এই পেশায় এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রতিযোগিতা। এখানে ভালো করা তো দূরে থাক, টিকে থাকতে হলে অবশ্যই নতুন প্রোডাক্ট নিয়ে আসতে হবে। অথবা পুরনো প্রোডাক্টের নতুন বা আলাদা দিক বা ব্যবহার নিয়ে কাজ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, ঠিক যেই সময় আপনি পাবলিক ফিগার হয়েছেন, আপনার দায়িত্ব বেড়ে গিয়েছে। আপনি আপনার ব্যক্তিগত অভিমত প্রকাশ করতেই পারেন কিন্তু অপরকে আঘাত দিয়ে নয়। আপনাকে পাবলিক সেন্টিমেন্ট বিবেচনা করতে হবে। নিজের উদ্দেশ্য ঠিক রেখে কথা আর কাজ করতে হবে। ধীরে ধীরে কাজের গতি এমনিতেই বাড়বে। অনেক সময় দেখবেন কেউ কেউ হুট করে অনেক সস্তা জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়। তখন ‘ধরাকে সরা জ্ঞান’ করতে শুরু করে।কোনো বিষয় নিয়ে টুকটাক কথা বলুন সমস্যা নাই, যখনই কোনো গোষ্ঠী নিয়ে কথা বলবেন বা অনেক বেশি সেনসেটিভ ইস্যু নিয়ে কথা বলবেন তখন আপনার কথার শক্ত বেইজ লাগবে। আপনার কথা, আপনার মন্তব্য, আপনার বিশ্বাস এবং আপনার ব্যবহার যে আপনার ব্যক্তিত্বকে রিপ্রেজেন্ট করে তা যদি না মানেন তাহলে এই ইন্ডাস্ট্রি আপনার জন্য নয়।সবচেয়ে জরুরি কথা হল, প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ পেতে চাইলে আপনার কত বছরের অভিজ্ঞতা আছে তা জানতে চাওয়া হবে। আপনি কাজ করে মজা পাচ্ছেন কিনা, যোগ্যতা এবং দক্ষতা অনুযায়ী পারিশ্রমিক পাচ্ছেন কিনা সেগুলোর দিকে নজর রেখে কাজ করলে সফলতা আসতে বাধ্য। এ পেশায় অনেক পড়াশোনা করতে হবে, অনেক ট্রেনিংয়ে অংশ নিতে হবে। আর নিজের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে জানতে হবে। কারণ আপনি যখন প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করবেন; তখন সেশন শেষে প্রশ্নোত্তর পর্বে আপানাকে অনেক প্রশ্ন করা হবে। সেসব প্রশ্নের উত্তর আপনাকে সুন্দর করে সাবলীল্ভাবে সামলাতে হবে। ট্রেনিং প্রফেশনালদের জন্য আগে আলাদা কোন প্ল্যাটফর্ম ছিল না যা এখন আছে। যার পুরো নাম ‘বাংলাদেশ অরগানাইজেশন ফর লার্নিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’। এখানে যুক্ত হলে আপনি উপকৃত হবেন।তবে সবকিছুর পর মনোভাবটাই আসল। যার মনোভাব ভালো নয়, তাকে যখনই তার কোন ভুলের কথা বলবেন সে মানতে চাইবে না। সবকিছুর ব্যাপারে আমাদের মনোভাব বা দৃষ্টিভঙ্গিই আসলে সফলতা নির্ধারণ করে। সবশেষে বলতে চাই, আপনার নেশা এবং পেশা এক করে ফেলতে পারলেই সাফল্য অনিবার্য।লেখক : প্রশিক্ষকএসইউ/এমএস
Advertisement