বেগম রোকেয়া দিবসে শুধু একটা কথাই মনে হচ্ছিল এই প্রহসনের অর্থ কি? আমাদের এই দেশে বেগম রোকেয়ার নাম নিয়ে তাঁকে আর অপমানিত না হয় নাই করি। নারীর অগ্রগতির পরিবর্তে আমরা তো মনে হয় অতীতের দিকেই পিছু হটছি।ধর্ষণের শাস্তি দিব কি তার বদলে আমরা তার পুরস্কারের ব্যবস্থা করছি। নতুন যে বাল্যবিবাহ আইন সেটি বাল্যবিবাহকে কতদূর প্রতিরোধ করবে সে তো বলাই বাহুল্য। উল্টো এটি বিশেষ বিধানে শিশু মেয়ের ধর্ষণকে আরও উৎসাহিত করবে। এবং ধর্ষকের জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা করবে তার বিয়ের আয়োজন করে। আইনের এই বিশেষ ধারা যারা প্রণয়ন করেছেন বলতে বাধ্য হচ্ছি, ‘বিয়ে’, ‘ধর্ষণ’ ‘বাল্যবিবাহ’, ‘নারী অধিকার’, ‘নারীশিক্ষা’ সংক্রান্ত ধ্যানধারণায় তাদের গুরুতর সমস্যা আছে। তাদের জেন্ডার কনসেপ্ট অত্যন্ত দুর্বল এবং সামাজিক বাস্তবতা বিষয়ে তাদের জ্ঞান অতি সীমিত। প্রথমত, ধরা যাক ধর্ষণের প্রসঙ্গ। ধর্ষণ একটি গুরুতর অপরাধ। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুসারে এর শাস্তিও কঠোর। আমাদের দেশে গ্রাম্য সালিশে অনেক সময় ধর্ষকের সঙ্গে যে ভিকটিমের বিয়ের আয়োজন করা হয় সেটাও কিন্তু আইনত অপরাধ। ধর্ষকের সঙ্গে ভিকটিমের বিয়ের ব্যবস্থা করা মানে তার অপরাধকে লঘুভাবে দেখা এবং অপরাধীকে তার প্রাপ্য শাস্তি থেকে বাঁচানোর অপকৌশল।ধর্ষণ সংঘটিত হলে যত দ্রুত সম্ভব ভিকটিমের মেডিকেল পরীক্ষা করতে হবে এবং ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্তকে গ্রেফতার করতে হবে। এটি অজামিনযোগ্য অপরাধ। ধর্ষণ সংঘটিত হলে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী দ্রুত উপযুক্ত ব্যবস্থা নিবে। দেশের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা এমন হওয়া প্রয়োজন যাতে এ ধরনের অপরাধ না ঘটে এবং শিশুসহ সকল বয়সী নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। এখন যদি ধর্ষকের সঙ্গে ভিকটিমের বিয়ে বৈধতা পায় তাহলে লম্পট বখাটেদের উৎপাত যে চরমে পৌঁছাবে সেকথা একটা শিশুও বুঝতে পারে। ১২/১৩ বছর বয়সী মেয়েদের বখাটেরা উত্ত্যক্ত করবে, ধর্ষণ করবে তারপর মনের আনন্দে সেই মেয়েটির সঙ্গে বিয়ের পিঁড়িতে বসবে। আহা এমন মজা হয় না! প্রশ্ন উঠেছে ধর্ষণের ফলে যদি মেয়েটি গর্ভধারণ করে তাহলে কি হবে। এমন ঘটনা রোধে ইমার্জেন্সি কনট্রাসেপটিভ যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে গর্ভপাতের ব্যবস্থা। আর কোনোটিই যদি কাজ না করে তাহলে আদালতের নির্দেশে শিশুর ভরণপোষণের ব্যবস্থা করা হবে ধর্ষকের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে। এবং শিশুটি ধর্ষকের সম্পত্তির বৈধ উত্তরাধিকারী হবে এমন বিধান রাখা কি একান্তই অসম্ভব?এখন আসা যাক বিয়ের প্রসঙ্গে। বিয়ে হলো দু’জন নারী পুরুষের মধ্যকার সামাজিক চুক্তি। বিয়েতে বর ও কনের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা, সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ দরকার। ধর্ষকের সঙ্গে একটি মেয়ের বিয়ে দেওয়ার অর্থ হলো মেয়েটিকে চিরদিনের জন্য একজন অপরাধীর সঙ্গে বাস করার জন্য ঠেলে দেয়া। শুধু তাই নয় সে তো দিনের পর দিন ম্যারিটাল রেপেরও শিকার হবে। দাম্পত্য ধর্ষণ বা ম্যারিটাল রেপও যে একই রকম গুরুতর অপরাধ সে কথা বুঝতে পারার মতো বিচক্ষণতা অবশ্য বাল্যবিবাহের আইন প্রণেতাদের কাছে আশা করা যায় না। আইনের এই বিধানটির ফলে এখন যেটা হবে সেটা হলো বখাটে লম্পট ব্যক্তিরা গ্রামে গ্রামান্তরে কিশোরী মেয়েদের ধর্ষণ করবে এবং তাদের তিন বা চার নম্বর বউ হিসেবে ঘরে তুলে শাস্তি এড়াবে। বখাটেদের এমন সুযোগ-সুবিধা করে দেয়ার জন্য অবশ্য সরকারকে সাধুবাদ জানাতেই হয়!বাবা মা ভালো মনে করলে ১৮ বছরের আগেই মেয়ের বিয়ে দিতে পারবে এটাও বিশেষ ছাড় হিসেবে আইনে রয়েছে। এই আইন প্রণেতাদের মনে করিয়ে দিতে চাই ঊনবিংশ শতক ও তার আগের ইতিহাস। সে সময়ও বাবা মায়েরা সন্তানের ভালো চাইতেন সন্দেহ নেই। এবং তারা ভালো মনে করে নিতান্ত শিশু বয়সেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিতেন। সেসময় তিন-চার বছরের শিশু তো বটেই এমনকি কয়েক মাস বয়সী কন্যা সন্তানেরও বিয়ে দেয়া হতো। পঁচিশ বছরের ছেলের সঙ্গে তিন বছর বয়সী মেয়ের বিয়ে তখন বিরল কোনো ঘটনা ছিল না। এর ফলে শিশু বয়সেই মেয়েটিকে বাবার ঘর ছেড়ে শ্বশুরবাড়িতে চলে যেতে হতো। সেখানে অসংখ্য নির্যাতনের মুখোমুখি হতে হতো তাকে। বেগম রোকেয়ার লেখা অবরোধবাসিনী গ্রন্থের পাতায় পাতায় রয়েছে এসব। বাস্তব কথা হলো শিশু মেয়ের ভালো-মন্দ শুধু বাবা-মায়ের চিন্তা করলে চলবে না। কারণ আমাদের গ্রামীণ সমাজে প্রচুর অসচেতন ও অজ্ঞ বাবা মা আছেন। যারা শিশু মেয়েকে বিয়ে দেওয়াটাই ভালো বলে মনে করেন। সে কারণেই বাবা মাকে নয়, সরকারকে হতে হবে বৃহত্তর শুভচিন্তক। আজকের শিশু আগামী দিনের দেশ গড়ার কারিগর। আগামী দিনের এই দেশ গঠনের কারিগরদের ভালো মন্দ কিসে হবে সেকথা সরকার ও রাষ্ট্রকে চিন্তা করতে হবে। আর প্রাপ্তবয়স্ক একজন নারী ও পুরুষ নিজেদের জীবন সঙ্গী বেছে নিবেন এটা মানবিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। নারীর সঙ্গী বেছে নেয়ার অধিকার তার প্রজনন অধিকারের অন্তর্গত। কিন্তু শিশু মেয়ে কিভাবে নিজের ভালো মন্দ বুঝবে বা সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবে? তাই একটি মেয়ের আঠারো বছর না হওয়া পর্যন্ত কিছুতেই তার বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া চলবে না এমনটাই আইন হওয়া দরকার।দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠি নারী। তারা যেন লেখাপড়া শিখে সুনাগরিক হতে পারে এবং অর্থনীতি, রাজনীতিসহ সবক্ষেত্রে পুরুষের সমান(প্রয়োজনে বেশি) অবদান রাখতে পারে সে ব্যবস্থা তো সরকারকেই করতে হবে। এজন্য চাই নারীর উচ্চশিক্ষা। আর বাল্যবিবাহ যে নারীর উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পথে চরম অন্তরায় সেকথা তো নতুন করে বলার কিছু আছে বলে মনে করি না।বিয়ের পর মেয়েরা লেখাপড়া করবে-একথা মুখে বলা যত সহজ বাস্তবে ততোটা নয়। সংসারের যাঁতায় একবার ঢুকে পড়লে বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া আর যে লেখাপড়া চালিযে যাওয়া যায় না সেকথা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। বেগম রোকেয়ার পক্ষে সেটা সম্ভব হয়েছিল কারণ সাখাওয়াৎ হোসেনের মতো একজন মহাপ্রাণ ব্যক্তিকে তিনি স্বামী হিসেবে পেয়েছিলেন। আর রোকেয়া নিজেও ছিলেন দারুণ মেধাবী, প্রতিভাবান, ক্ষণজন্মা মানুষ। কিন্তু সকলে তার মতো প্রতিভাবান ও সাখাওয়াৎ হোসেনের মতো উদার হবে এমনটি আশা করা বাতুলতা। কমমেধাবী, কম প্রতিভাবান নারীরাও যেন শিক্ষার সুযোগ পায়, কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পারে, বিকশিত করতে পারে নিজেকে সেজন্য বাল্যবিবাহ বন্ধ করা সরকারেরই কর্তব্য। সে কর্তব্য সরকার কতটুকু পালন করছে আর কতটুকু পালনে আন্তরিক সে কথা তো সময়ই বলে দিবে।লেখক : কবি, সাংবাদিক। shantamariavalia@gmail.comএইচআর/এমএস
Advertisement