বিশেষ প্রতিবেদন

পুলিশকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে

আকবর আলি খান। অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা। মন্ত্রিপরিষদের সাবেক এ সচিব মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হবিগঞ্জের মহকুমা প্রশাসক এবং যুদ্ধকালীন সক্রিয়ভাবে মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে কাজ করেছেন। স্বাধীনতার পর যুক্ত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায়। বর্তমানে অধ্যাপনা করছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে। সম্প্রতি তিনি মুখোমুখি হয়েছিলেন জাগো নিউজের সঙ্গে। কথা বলেন দেশের বর্তমান রাজনৈতিক, সামাজিক ও সমসাময়িক বিষয় নিয়ে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু। আজ থাকছে শেষ পর্ব।জাগো নিউজ : আগের পর্বে রাজনৈতিক সংকটের কথা বলছিলেন। এমন সংকটের সামাজিক প্রভাব কী?আকবর আলি : গণতন্ত্র দুর্বল বলেই ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর বিস্তার ঘটছে। গণতন্ত্রের দুর্বলতা বৃদ্ধি পেলে বিস্তার আরও ব্যাপক হবে। ফলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হচ্ছে আপসের ব্যবস্থা। বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে পরস্পর ভাগযোগ করে রাষ্ট্র, সমাজ পরিচালনা করে। যদি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা না থাকে তাহলে এক দলই সব কুক্ষিগত করে রাখে। এতে বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে সংঘাত বাড়তে থাকে।চলমান সমস্যা সমাধান দ্রুত হবে বলে আমি মনে করি না। দ্রুত সমাধানের পথ জ্যোতিষীরা ভালো দিতে পারেন। সমাজবিজ্ঞানীদের পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা দীর্ঘমেয়াদের কথা বলতে পারি।জাগো নিউজ : দীর্ঘমেয়াদেই সমাজ কোন দিকে যাচ্ছে বলে মনে করেন? আকবর আলি : শুধু আমাদের দেশেই নয়, দীর্ঘমেয়াদে গোটা দুনিয়াতেই সংকট দেখা দিয়েছে। এর প্রধানতম কারণ হচ্ছে, বিশ্বায়নের যুগে সম্পদ পুঞ্জীভূত হয়ে যাচ্ছে। ধনীরা দ্রুত গতিতে আরও ধনী হয়েছে। সেই তুলনায় গরিবদের ভাগ্যের তেমন কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না।বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর গরিব মানুষের কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু যারা ধনী লোক ছিলেন, তারা আরও অধিক সম্পদের মালিক হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। সমাজে ধন বৈষম্য বেড়েই চলছে। এ বৈষম্যে আমরা এক সময় নিচু পর্যায়ে ছিলাম। এখন উচ্চপর্যায়ে পৌঁছেছি।এ বৈষম্য বাড়লে সমাজে অস্থিরতা বাড়বেই। এমন সমাজে বড় সমস্যা হচ্ছে বেকারত্ব বেড়ে যাওয়া। উন্নত বিশ্বেও এ সমস্যা প্রকট হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক প্রতিষ্ঠানে ছাঁটাই হচ্ছে। বেকার হয়ে পড়া মানুষ যে কাজ পাচ্ছে, তা আরও নিম্নমানের। যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার অন্যতম কারণ হচ্ছে সে দেশের বেকার সমস্যা। ওবামার আট বছরেও বেকার সমস্যার সমাধান করতে পারেনি।একই অবস্থা বাংলাদেশেও। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ঘোষণা করছে, বেকার ৪ শতাংশ। এটি পশ্চিমা অর্থনীতির আদলে। এই হিসাব বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।জাগো নিউজ : আপনার বিশ্লেষণ কী?আকবর আলি : এ নিয়ে আমার বিশেষ কোনো গবেষণা নেই। তবে আমি পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখিছি, বাংলাদেশে এ মুহূর্তে বেকারত্বের হার ৩০-৪৭ শতাংশ। বিদেশে এক কোটি মানুষ যাওয়ার পরও এ হিসাব প্রযোজ্য। এ বেকার সমস্যা যদি দূর করতে না পারি তাহলে সামাজিক অস্থিরতা অনেক গুণ বেড়ে যাবে, যা আমরা ইতোমধ্যেই দেখতে পাচ্ছি। জাগো নিউজ : রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে নিপীড়নের ঘটনা বাড়ছে। পুলিশের নির্যাতনে ময়মনসিংহে শিক্ষক নিহত, গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতাল নিহতের ঘটনায় উদ্বেগ বাড়িয়েছে। আপনার মন্তব্য জানতে চাই?আকবর আলি : এটি ঘটতে বাধ্য। অন্য দেশ থেকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। বাংলাদেশে একটি মাত্র পুলিশ বাহিনী রয়েছে। ফেডারেল সরকার ব্যবস্থায় দেখবেন একাধিক পুলিশ বাহিনী আছে। পাশের দেশ ভারতেও রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকারের আলাদা পুলিশ বাহিনী রয়েছে। নরেন্দ্র মোদি চাইলেই মমতা ব্যানার্জির পুলিশের বিপরীতে কিছু করতে পারবে না। জবাবদিহিতার ব্যাপার থাকে। যুক্তরাষ্ট্রে তিনটি পুলিশ বাহিনী রয়েছে। বাংলাদেশের জন্য একটি মাত্র পুলিশ বাহিনী থাকাই হচ্ছে প্রথম সমস্যা। দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে, পুলিশকে নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশেষ কর্তৃপক্ষ না থাকা। সাধারণত এ কর্তৃপক্ষ পুলিশের হাতে থাকে না। বাইরের লোকের হাতে থাকতে হয়। পুলিশ ঠিকমতো কাজ করছে কিনা, তা কর্তৃপক্ষ মনিটরিং করে। প্রতিটি উন্নত দেশেই ছিল। বাংলাদেশেও ছিল।বিচার বিভাগ পৃথক হওয়ার পর পুলিশের ওপর নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা উঠে গেছে। আগে গুলি করতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমোদন দরকার হতো। এখন জেলা ম্যাজিস্ট্রেটরা আর সে ক্ষমতা রাখেন না। অন্যদিকে জেলা জজরাও পুলিশকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। কারণ সরকার নিজেই সেই কর্তৃত্ব মানবে না। বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না।আগে পুলিশের গুলিতে কেউ মারা গেলে ম্যাজিস্ট্রেট গিয়ে তদন্ত করতেন। এখন সে ব্যবস্থাও নেই। এ অবস্থায় যে-ই পুলিশে আসুক না কেন, সে ক্ষমতার অপব্যবহার করার সুযোগ পায়। প্রচলিত এ পুলিশ ব্যবস্থা দিয়ে মানবাধিকার রক্ষা করা সম্ভব নয়।জাগো নিউজ : এ নিয়ে আপনার পরামর্শ কী?আকবর আলি : প্রথমত পুলিশকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। এরপর জেলা পুলিশকে আলাদা করে শক্তিশালী করা যেতে পারে।জাগো নিউজ : পুলিশের সহযোগী কয়েকটি বাহিনীও তো মাঠে কাজ করছে?আকবর আলি : এরা সবাই পুলিশের অধীনস্ত। একটি মাত্র পুলিশ বাহিনীই সব নিয়ন্ত্রণ করে। পুলিশ বাহিনীর পুনর্গঠনের দরকার বলে মনে করি। বিচার বিভাগ পৃথক করার পর পুলিশ ব্যবস্থা নিয়ে যা করার কথা, তা করা হয়নি। এ কারণেই সমাধান মিলছে না।জাগো নিউজ : এটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার?আকবর আলি : রাজনৈতিক কারণেই পুলিশের পুনর্গঠন হচ্ছে না। তবে শুধু পুলিশ নয়, রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানের ওপরই রাজনৈতিক প্রভাব অধিক মাত্রায় বেড়েছে। এই প্রভাব ধারাবাহিকভাবেই হয়ে আসছে। সামগ্রিকভাবে এটি আমাদের জাতীয় ব্যর্থতা।জাগো নিউজ : রোহিঙ্গা সমস্যা কীভাবে দেখছেন?আকবর আলি : এ সমস্যার সহজে সমাধান হবে বলে আমি মনে করি না। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ওপর যে নির্যাতন চলছে, তা বৌদ্ধ ধর্মের আদর্শের সঙ্গে কোনোভাবেই মানায় না। এ বর্বরতা কোনোভাবেই মানা যায় না। তবে ইতিবাচক কথা হচ্ছে এই মুহূর্তে বিশ্ব মহল বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। স্থিরতা এনে বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন আদায় করে এর সমাধান বের করতে হবে।জাগো নিউজ : রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া নিয়ে বিতর্ক প্রসঙ্গে কী বলবেন?আকবর আলি : ধরলাম আরও ৫ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসলো। কষ্ট কিছুটা হবে বটে। কিন্তু মানবিক দিক থেকে দেখলে এই কষ্ট দূর হয়ে যাবে বলে আমি মনে করি। তবে বিশ্বকে সঙ্গে নিয়ে রোহিঙ্গা ইস্যুতে স্থায়ী সমাধান বের করা সময়ের দাবি।এএসএস/আরএস/আরআইপি

Advertisement