জাতীয়

অভিজিৎ হত্যাকাণ্ড : সন্দেহের তালিকায় ১৫ জঙ্গি

মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ও বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ড. অভিজিৎ রায়ের সন্দেহভাজন খুনিরা রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশেই অবস্থান করছে। তারা ঘটনার রাতেই বিচ্ছিন্নভাবে দুটি এলাকা বেছে নেয়। ওই দুটি এলাকায় আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা অভিযান চালিয়েছেন। কিন্তু অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেননি গোয়েন্দারা। তবে গোয়েন্দারা আশা করছেন, খুব দ্রুতই খুনিরা তাদের জালে ধরা পড়বে। এ ক্ষেত্রে পুরনো জঙ্গিদের একটি সূত্রকেও কাজে লাগানো হয়েছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) সম্ভাব্য ১৫ জঙ্গির নামের তালিকা হাতে নিয়ে সেগুলো যাচাই-বাছাই করছে। পাশাপাশি তদন্তে পারিপার্শ্বিক অন্য বিষয়গুলোও প্রাধান্য পাচ্ছে। তদন্ত সূত্র আরও জানিয়েছে, উগ্রপন্থী মত ও কৌশলের দিক থেকে হিজবুত তাহরীর এবং আনসারুল্লাহ বাংলা টিম একই চরিত্রের। এই উগ্রপন্থী গোষ্ঠী একজোট হয়ে তাদের কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডে পুরনো ও নতুন জঙ্গিরা অংশ নেয়। নতুন জঙ্গি সদস্যরা বয়সে তরুণ এবং তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে।ঘটনার রাতে টিএসসি এলাকায় দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তাদের গাফিলতির বিষয়টিও খতিয়ে দেখছে পুলিশের তদন্ত কমিটি। এরই মধ্যে শাহবাগ থানার এসআই হাফিজুল ইসলামকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। কমিটি সূত্রে জানা গেছে, ঘটনার রাতে দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যদের সবাইকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে। এরই মধ্যে এক পুলিশ কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে।গোয়েন্দারা বলছেন, এবিটির আত্মগোপনে থাকা জঙ্গি সদস্যদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ইতিমধ্যে দুজনকে নজদারিতে এনেছে। রিমান্ডে থাকা ফারাবীর কাছে পাওয়া তথ্যও যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। ফারাবী জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, এবিটি নানা কৌশলে খুন করে থাকে। তবে এ খুনের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা নেই। ফারাবী স্বীকার করেছেন, বিভিন্ন সময় এবিটির সদস্যদের দেশের বাইরে থেকে নির্দেশনা আসত। এ ক্ষেত্রে তিনি পাকিস্তানে পলাতক ইজাজ হোসেন ও জিয়ার নাম স্বীকার করেছেন। আর তাদের সব নির্দেশনা দিয়ে থাকেন এবিটির বড় ভাই বলে পরিচিত রেজওয়ানুল আজাদ রানা।ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মুখপাত্র যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলাম বলেন, অভিজিৎ খুনের ঘটনায় সাত সদস্যের তদন্ত টিম কাজ করছে। খুব শিগগিরই তাদের গ্রেফতার করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, তদন্ত টিমের কাছে বেশ কিছু তথ্য এসেছে। এর সূত্র ধরেই চলছে আভিযানিক তৎপরতা। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ড. অভিজিৎ খুনের পর আনসার বাংলা সেভেন নামে যে গ্রুপটি হত্যার বিষয় স্বীকার করেছে এরা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমেরই একটি অংশ। বৃহস্পতিবার ঘটনার রাতে অভিজিৎ রায়কে খুনের পর জঙ্গিদের একটি গ্রুপ তাদের মিডিয়া সেকশনকে তথ্য জানিয়ে দেয়। এরপরই ওই সংগঠনের নামে টুইট বার্তাটি পোস্ট হয়।তদন্ত সূত্র জানিয়েছে, অভিজিৎ রায়কে খুনের কয়েক ঘণ্টা আগে থেকে খুনিরা তাকে অনুসরণ করে। সন্ধ্যায় বড় মগবাজারের বাসার কাছ থেকেই তাকে অনুসরণ করা হয়। একটি দল অভিজিৎকে বইমেলায় যাওয়ার পথে ও অন্যটি তার ফেসবুক অনুসরণ করে। দুটি গ্রুপে কেউ খুনি ছিল না। খুনের জন্য একটি অপারেশন টিম ছিল। যেখানে শিক্ষার্থীর বেশে টিএসসি এলাকায় অবস্থান করে দুই খুনি। আর তারা দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করতে হেঁটেই দুদিকে চলে যায়।তদন্ত সূত্র জানিয়েছে, ঘটনার পর খুনিরা পালিয়ে গেলেও অভিজিৎ রায়ের ছবি তুলতে অবস্থান করে এক বা একাধিক সদস্য। বিশেষ করে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের একাধিক সদস্য ছবি ও ভিডিও ধারণ করে থাকে।সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সূত্র বলেছে, ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ব্লগার রাজীব হায়দার শোভনকে খুনের আগে যেসব কৌশল অবলম্বন করা হয়েছিল এবারও তারা একই কৌশল অবলম্বন করে। রাজীব হত্যার আগে আনসারুল্লাহর খুনিরা পল্লবীতে তার বাসার সামনে ক্রিকেট খেলে এবং নানা তথ্য ও খুনের নিশানা ঠিক করে নেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় ২৬ ফেব্রুয়ারি অভিজিৎকে খুনে শিক্ষার্থী সেজে ঘটনাস্থলে আসার কৌশল অবলম্বন করে। ব্যাগে করে চাপাতি আনা হয়। পরে খুনি ব্যাগ রেখেই চলে যায়। কারণ হিসেবে গোয়েন্দারা বলেন, খুনিকে আগে থেকেই মহড়া বা প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। তার কাছে ব্যাগ থাকলে পালানোর সময় সহজে চিহ্নিত করা যাবে এ জন্য সে ব্যাগ রেখেই সটকে পড়ে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মানস পোদ্দার বলেন, আমাদের কাছে এবিটির আত্মগোপনে থাকা জঙ্গিদের তালিকা আছে। এ তালিকাও যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। ডিবি পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, তাদের কাছে যে তালিকা আছে ওই তালিকার বাইরে আরও কয়েকজন আছে। তারা আনসারুল্লাহ ও হিজবুত তাহরীরের সঙ্গে জড়িত। তালিকায় নাম রয়েছে- আমিনুল ইসলাম, রেজওয়ান শরীফ, আলী আজাদ, নাইমুল হাসান নাইম, সাইফুল, জাহিদুল ইসলাম জাহিদ, জুন্নুন সিকদার, নবীর ওরফে নবীন, সায়েম ও আবদুল্লাহসহ ১৫ জন। এসব জঙ্গি এর আগে বেশ কয়েকজন প্রগতিশীল ব্যক্তিকে খুনের পরিকল্পনা করে। এর বাইরেও কয়েকজন তরুণ জঙ্গি আছে, তাদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে। আর এদের প্রধান হিসেবে কাজ করে সেই বড় ভাই রানা।ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (ডিসি) কৃষ্ণপদ রায় বলেন, খুনিদের চিহ্নিত করতে অনুসন্ধান ও তদন্ত চলছে। গোয়েন্দাদের যত কৌশল অবলম্বন করা প্রয়োজন সবই করা হচ্ছে।নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশে অবস্থান করা এফবিআইয়ের যে কর্মকর্তা আছেন তিনি বুধবারও অভিজিৎ হত্যার বিষয়ে খোঁজখবর নিয়েছেন। আগামী সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এফবিআইয়ের টিম ঢাকায় আসছে। ড. অভিজিৎ হত্যকাণ্ডের রাতে টিএসসি চত্বরে ডিউটিতে ছিল পুলিশের পাঁচটি টিম। এসব টিমে পুলিশ সদস্য সংখ্যা ছিল অন্তত ৩০ জন। টিমের মধ্যে ছিল কলসাইন গলফ টু ফাইভ টু নীলক্ষেত ফাঁড়ির ইনচার্জ উপপরিদর্শক (এসআই) ওয়াহেদুজ্জামান, টিএসসি বেরিকেড ওয়ানে রমনা থানার এসআই মজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ছিল ১০ জন কনস্টেবল, টিএসসি মিলন চত্বর ওয়ান-এ শাহবাগ থানার এসআই হাফিজুল ইসলামের নেতৃত্বে ছিল ৮ জন কনস্টেবল, ইউনিফর্ম ওয়ান-এ শাহবাগ থানার এএসআই দাউদ হোসেনের নেতৃত্বে ছিল অন্তত ৫ জন কনস্টেবল এবং টিএসসি চত্বরসংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটে ফুট পেট্রোল টিমে ৩ জন কনস্টেবল ডিউটিতে ছিলেন।এসআই হাফিজুল ইসলাম বুধবার যুগান্তরকে বলেন, ওই দিন (বৃহস্পতিবার) আমার স্ত্রী আদ্বদীন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। সন্ধ্যায় হাসপাতালেই আমার স্ত্রীর বাচ্চা হয়। আমার ডিউটি ছিল মিলন চত্বরে। ঘটনাস্থলের বিপরীত পাশে। কিন্তু সে সময় আমি ছিলাম না। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে আমার থানার অপারেশন অফিসারের কাছে (এসআই আবুল কালাম আজাদ) মোবাইল ফোনে কিছু সময়ের জন্য ছুটি নিয়ে হাসপাতালে স্ত্রী-সন্তানের কাছে যাই। রাত ৯টার পর আমি টিএসসিতে ফেরার পর শুনি হামলার ঘটনা ঘটেছে। তবে অপারেশন অফিসার এসআই আবুল কালাম আজাদ বলেন, কাউকে ছুটি দেয়ার এখতিয়ার আমার নেই। এসআই হাফিজুল আমার কাছে কোনো ছুটি নেয়নি। সে কোথাও গিয়েছিল কিনা, সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। সূত্র : যুগান্তর এসএইচএ/এআরএস/এমএস

Advertisement