বিশেষ প্রতিবেদন

খালেদা জিয়ার প্রস্তাবে কোনো অভিনবত্ব নেই

আকবর আলি খান। অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা। মন্ত্রিপরিষদের সাবেক এ সচিব মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হবিগঞ্জের মহকুমা প্রশাসক এবং যুদ্ধকালীন সক্রিয়ভাবে মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে কাজ করেছেন। স্বাধীনতার পর যুক্ত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায়। বর্তমানে অধ্যাপনা করছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে। সম্প্রতি তিনি মুখোমুখি হয়েছিলেন জাগো নিউজের সঙ্গে। কথা বলেন দেশের বর্তমান রাজনৈতিক, সামাজিক ও সমসাময়িক বিষয় নিয়ে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জাগো নিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু।জাগো নিউজ : বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা এবং নির্বাচন কমিশন বিষয়ে প্রস্তাব দিয়েছেন। খালেদা জিয়ার এ প্রস্তাবকে কীভাবে দেখছেন?ড. আকবর আলি খান : এ প্রস্তাব মূলত নির্বাচন উপলক্ষে বিএনপির রাজনৈতিক তৎপরতার অংশ বলে মনে করি। বিএনপি প্রস্তাব দিয়ে দেখতে চাইছে সরকার নির্বাচন প্রশ্নে কোনো ছাড় দেবে কিনা? নির্বাচনকে ঘিরে সামনে এ ধরনের আরও প্রস্তাব আসবে। প্রশ্ন হচ্ছে, জনসম্মুখে এ ধরনের প্রস্তাবে বিবদমান দুটি পক্ষের মধ্যে কোনো আলোচনা হয় কিনা।জাগো নিউজ : আপনার কী মনে হয়, কার্যকর আলোচনায় কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে?ড. আকবর আলি খান : না। এতে রাজনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে সহায়তা করতে পারে। কিন্তু কোনো ইতিবাচক ফলাফল মিলবে বলে মনে হয় না।জাগো নিউজ : কিন্তু ফলাফল তো রাজনৈতিক তৎপরতার মধ্য দিয়েই আসে?ড. আকবর আলি খান : এমন তৎপরতা থেকে তখনই ফলাফল আসে, যদি রাজপথে বড় ধরনের কোনো আন্দোলন থাকে। এটি বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে প্রমাণিত। আন্দোলন থাকলে সরকার আলোচনার জন্য প্রস্তুত থাকত। যেহেতু রাজপথে কোনো আন্দোলন নেই, সেহেতু এ প্রস্তাবের কোনো তাৎপর্য নেই। আন্দোলন ছাড়া যত প্রস্তাবই দেয়া হোক না কেন, তার কোনো ফলাফল মিলবে না। ‘আন্দোলন ছাড়া প্রস্তাবের কোনো তাৎপর্য নেই। বিএনপি নেত্রীর প্রস্তাব নিয়ে এটিই আমার মন্তব্য’- যোগ করেন তিনি।জাগো নিউজ : তার মানে রাজনীতির যে সংকট চলছে, তা থেকে উত্তরণের জন্য আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই?ড. আকবর আলি খান : সংকট উত্তরণের জন্য আন্দোলন জরুরি কিনা, তা নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করার সময় আসেনি। রাজপথে আন্দোলন নেই বলেই আমার এমন মন্তব্য। রাজনৈতিক আলোচনায় বিএনপি এই মুহূর্তে খুব দুর্বল অবস্থানে আছে। অন্যদিকে সরকারি দল আওয়ামী লীগ খুব সবল অবস্থায়। জাগো নিউজ : ভবিষ্যৎই ফলাফল নির্ধারণ করে। কিন্তু খালেদা জিয়া নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে যে প্রস্তাবনা রেখেছেন তার মূল্যায়ন করবেন কীভাবে?ড. আকবর আলি খান : এ রকম হাজার হাজার প্রস্তাব দেয়া যায়। খালেদা জিয়ার প্রস্তাবে কোনো অভিনবত্ব নেই, যার মধ্য দিয়ে সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।জাগো নিউজ : তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থেকে সরে এসে নতুন সরকার ব্যবস্থার কথা বলেছেন খালেদা জিয়া। এটিকে অনেকে ইতিবাচকভাবেও দেখতে চাইছেন...ড. আকবর আলি খান : তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থেকে সরে এসে বিএনপির লাভ নাকি সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করা- তা হচ্ছে ওদের (বিএনপি) রাজনৈতিক খেলার বিষয়। তবে আমি মনে করি, নির্বাচন নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হলে নির্বাচনকালীন সরকারের আচরণ ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের আচরণ থেকে ভিন্ন হতে হবে।এ ভিন্ন আচরণ নির্ভর করে দেশে কী ধরনের রাজনৈতিক আন্দোলন বা সরকারের ওপর চাপ আছে তার ওপর। চাপ প্রয়োগকারী পক্ষগুলো কত শক্তিশালী তার ওপরই এটা নির্ভর করে।জাগো নিউজ : নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে আপনার কোনো ভাবনা আছে কিনা?ড. আকবর আলি খান : আমি এ মুহূর্তে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে কমপক্ষে ১০টি বিকল্প প্রস্তাব দিতে পারি। কিন্তু প্রস্তাব দেয়া তো বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে, দুই দল আলাপ-আলোচনা করবে কিনা? আলাপ-আলোচনা করার পরিবেশ আছে কিনা? উভয় পক্ষই যদি ছাড় না দেয়, তাহলে আলাপ আলোচনা করে কোনো ফল হবে না। ছাড় দেয়ার মানসিকতা কারও আছে বলে মনে হয় না। সুতরাং আলোচনাও হবে না।জাগো নিউজ : গত নির্বাচনের আগেও এমন পরিবেশ ছিল। কার্যকর না হলেও কিছুটা আলোচনা তো হলো...ড. আকবর আলি খান : ওই সময় বিএনপির পক্ষ থেকে কিছুটা আদায় করা সম্ভব ছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে সরকারের কাছ থেকে সেটাও আদায় করা সম্ভব হবে না। সরকার যদি নিজ থেকে উদ্যোগ নেয়, সেটা হবে সরকারের দূরদর্শিতা। চলমান পরিস্থিতিতে সরকার কিছু করবে বলে মনে হয় না।যদি সরকার গণতন্ত্রের সংকট স্বীকার করে তাহলে তারা ভবিষ্যতের জন্য দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে পারে। কিন্তু সরকার সে পরিচয় দেবে বলেও মনে হয় না। জাগো নিউজ : তাহলে সংকট উত্তরণের উপায় কী?ড. আকবর আলি খান : আগামীকালই সংকটের উত্তরণ ঘটবে এমন সমাধান কেউ দিতে পারবে না। ৩০ বছর বা ৫০ বছরও লেগে যেতে পারে। অনেকেই মনে করেন রাত পোহালেই সমাধান হয়ে যাবে। আমি এ ধরনের কোনো সমাধান দেখি না। এটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ব্যাপার। সময়ের আবর্তেই রাজনৈতিক সংকটের সমাধান মিলবে।জাগো নিউজ : উন্নয়নের বিপরীতে গণতন্ত্রকে মূল্যায়ন করছে সরকার। এশিয়ার কয়েকটি দেশকে আমলে নিয়েই সরকারের নীতিনির্ধারকরা এমন ইঙ্গিত দিচ্ছেন। এ নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?ড. আকবর আলি খান : এটি নতুন কোনো বিষয় নয়। এশিয়ান গণতন্ত্র নিয়ে এক সময় বিতর্ক হয়েছিল। নব্বইর দশকের কথা। সেখানে চীন ও সিঙ্গাপুর বলেছিল, ‘গণতন্ত্র বড় কথা নয়, মানুষের ভাগ্য উন্নয়নই বড় কথা।’ কিন্তু এই যুক্তি পরে ধোপে টেকেনি। অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলেই মানুষের চাহিদা মিটে যাবে, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। গণতন্ত্র বাদ দিয়ে উন্নয়ন মানুষের কল্যাণ আনতে পারে না।বরং অমর্ত্য সেন বলেছেন, যেখানে গণতন্ত্র নেই সেখানে দুর্ভিক্ষ পর্যন্ত হতে পারে। কর্তৃত্ববাদী সরকার যেখানে, সেখানে দুর্ভিক্ষের প্রবণতা অনেক বেশি। এ কারণে এশিয়ান গণতন্ত্র নিয়ে যে ধারণা, তা বিশ্ব গুরুত্ব দেয় বলে আমার কাছে মনে হয় না।জাগো নিউজ : কিন্তু চীন, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার উন্নয়ন তো উদাহরণ দেয়ার মতোই?ড. আকবর আলি খান : গণতন্ত্র ছাড়া উন্নয়ন হয়েছে, এমন দেশ অনেক আছে। আবার গণতন্ত্রের মধ্যে উন্নয়ন হয়েছে এমন দেশও অনেক আছে। বিজ্ঞজনরা বলেন, গণতন্ত্র এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্যে সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। উন্নয়ন হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। সুতরাং অন্য দেশে হলেই বাংলাদেশে গণতন্ত্র ছাড়া উন্নয়ন হবে তার কোনো গ্যারান্টি নেই। উন্নয়ন নিয়ে আওয়ামী লীগ এমন ইঙ্গিত কেন দেয়, বুঝে আসে না। দলটির প্রতিটি নির্বাচনী ইশতেহার গণতন্ত্রের জন্য। এখনও তাই। সুতরাং এগুলো রাজনীতির জন্যই বলা। এগুলো বিশেষ গুরুত্ব দেয়ার কোনো কারণ আছে বলে আমি মনে করি না।এএসএস/আরএস/পিআর

Advertisement