দুর্গম ও পিছিয়ে পড়া পাহাড়ি এক গ্রামের নাম চৈছড়ি। রাঙামাটি জেলার নানিয়ারচর উপজেলার ঘিলাছড়ি ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডে গ্রামটির অবস্থান। অথচ সেই চৈছড়ি গ্রামে স্থাপিত হয়েছে নিরাপদ পানির উন্নত প্রযুক্তি। প্রায় তিন কিলোমিটার দূরত্বের পাহাড়ি ঝরনা হতে পাইপলাইন টেনে পানি সংগ্রহের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সঠিক ব্যবস্থাপনা থাকলে আগামী ৩০ বছর চৈছড়ি গ্রামে নিরাপদ পানির সংকট হবে না।জানা যায়, রাঙামাটি-মহালছড়ি-খাগড়াছড়ি সড়কের ঘিলাছড়ি ইউনিয়ন সদর থেকে চৈছড়ি গ্রামটির দূরত্ব প্রায় ৫ কিলোমিটার। জেলা সদর থেকে দূরত্ব প্রায় ৪০ কিলোমিটার। গ্রাম থেকে ইউনিয়ন সদরের প্রধান সড়ক বা বাজারে আসা-যাওয়ার জন্য যানবাহন চলাচলে আজও কোনো রাস্তা নির্মাণ হয়নি গ্রামটি ঘিরে। ফলে হেঁটেই পাড়ি দিতে হয় উঁচু নিচু আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ। বাজারে কেনাবেচার জন্য মালামাল পরিবহন করতে হয় নিজের কাঁধে বোঝাই করে।গ্রামবাসী জানায়, চৈছড়ি গ্রামে বসবাস ৪৫ পরিবার লোকজনের। তাদের সবচেয়ে দুর্বিষহ ছিল নিরাপদ পানির অভাব। মৌসুমজুড়ে পানি প্রবাহের ছড়া থাকলেও সেই ছড়ার পানি নিরাপদ নয়। ফলে পানি সংগ্রহ করতে হতো অন্য জায়গা থেকে। গ্রীষ্মকালে পানি শুকিয়ে গেলে ভোগান্তি চরম আকার ধারণ করে। ময়লাযুক্ত পানি ব্যবহারের ফলে ডায়রিয়া, আমাশয়সহ পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়তো মহামারি আকারে। এতে এই গ্রামের কয়েকজনের অকাল মৃত্যুও ঘটেছে। এখন সেই পানির অভাব দূর হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এনজিও ফোরাম ফর পাবলিক হেলথ ও প্রগ্রেসিভ চৈছড়ি গ্রামে নিরাপদ পানির প্রযুক্তি স্থাপন করে একটি পানি পরিশোধানাগার ও সরবরাহ প্রকল্প সফল বাস্তবায়ন করেছে।২০১৪-১৫ অর্থবছর প্রকল্পের কাজ শুরু করে এ বছরের নভেম্বরে শেষ হয়েছে। বর্তমানে সরবরাহ হয়ে পানি যাচ্ছে গ্রামবাসীর ঘরে ঘরে। এছাড়া একই প্রকল্পের আওতায় সবার ঘরে ঘরে স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা স্থাপন করা হয়েছে বলে জানান গ্রামবাসী ও বাস্তবায়নকারী সংস্থার কর্তৃপক্ষ। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থার কর্মকর্তারা জানান, গ্রাভিটি ফ্লো সিস্টেম (জিএফএস) প্রকল্প নামে চৈছড়ি গ্রামে একটি নিরাপদ পানি প্রযুক্তি সফল স্থাপন সম্ভব হয়েছে। এ প্রযুক্তিতে উঁচু পাহাড়ের ঝরনা থেকে পাইপে সংগ্রহ করা পানি রিজার্ভারেই পরিশোধন হয়ে জমা থাকে। সেখান থেকে পাইপে পানি সরবরাহ হচ্ছে। এ প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৩ লাখ টাকা। এনজিও ফোরাম ফর পাবলিক হেলথের প্রধান প্রকল্প সমন্বয়কারী কর্মকর্তা যোসেফ হালদার বলেন, জিএফএস নিরাপদ পানির জন্য একটি কার্যকর ও নির্ভরযোগ্য প্রযুক্তি। এ প্রযুক্তিতে নির্মিত রিজার্ভারে প্রাকৃতিক উৎস হতে পানি সংগ্রহ করে তা পরিশোধিত হয়ে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। চৈছড়ি গ্রামে স্থাপিত প্রযুক্তিতে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরত্বের পাহাড়ি ঝরনা হতে পাইপলাইন টেনে পানি সংগ্রহের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এতে আগামী ৩০ বছর চৈছড়ি গ্রামে নিরাপদ পানির সংকট হবে না।প্রগ্রেসিভ’র নির্বাহী পরিচালক সুচরিতা চাকমা বলেন, প্রকল্পে স্থানীয় বিভিন্ন সমস্যা এবং প্রয়োজনীয় চাহিদা গ্রাম উন্নয়ন কমিটির মাধ্যমে চিহ্নিত করে পরবর্তী কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়। চলমান প্রকল্পে সুশাসন, জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে পিছিয়ে পড়া এবং দুর্গম এলাকার জনসাধারণের জন্য নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে গ্রাভিটি ফ্লো সিস্টেম, স্প্রিং ওয়াটার কেপিং সিস্টেম রিংওয়েল স্থাপন বাস্তবায়ন চলছে। চৈছড়ির বাসিন্দা শান্তি বিনয় চাকমা বলেন, আগে নিরাপদ পানির অভাবে আপদ-বিপদ সব সময় লেগেই থাকতো। প্রায় সময় ডায়রিয়া, আমাশয়, পেটের পীড়া মহামারি দেখা দিতো। চিকিৎসার অভাবে অনেকে মারাও গেছে। গ্রামের নারীরা ছড়া থেকে এবং ছড়ার কিনারে গর্ত করে কুপ খুঁড়ে কত কষ্টে পানি তুলতো ঘরে। কিন্তু সেই পানি ব্যবহার ও পান করে পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হতে হতো। আমাদের এই দুঃখ-দুর্দশার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এগিয়ে এসেছে এনজিও ফোরাম ফর পাবলিক হেল্থ, প্রগ্রেসিভ ও ঘিলাছড়ি ইউনিয়ন পরিষদ। স্থাপিত জিএফএস প্রযুক্তি দিয়ে ঘরে ঘরে নিরাপদ পানি সরবরাহ পাচ্ছি। ঘিলাছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান অমর জীবন চাকমা বলেন, পিছিয়ে পড়া ঘিলাছড়ি মানুষের কথা বিবেচনা করে তাদের জীবনমান উন্নয়নে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থা এগিয়ে এসেছে। এনজিও ফোরাম ফর পাবলিক হেলথ ও প্রগ্রেসিভ নিরাপদ পানি ও স্যানিটারি ল্যাট্রিন ব্যবহার নিশ্চিত করতে যথাসাধ্য সহায়তা করে যাচ্ছে। তাদের সহায়তায় চৈছড়ি গ্রামে নিরাপদ পানি ব্যবস্থার জন্য একটি জিএফএস প্রযুক্তি স্থাপন করা হয়েছে।সুশীল প্রসাদ চাকমা/এএম/পিআর
Advertisement