খেলাধুলা

বিপিএল কী বিষফোঁড়া!

বিপিএলে এসব কি হচ্ছে? যে আসর হতে পারে বাংলাদেশের ক্রিকেট ব্র্যান্ডিংয়ের কেন্দ্রবিন্দু, তার গায়ে কাল দাগ কেন? চারিদিকে প্রশ্ন। এ প্রশ্ন যে এবারই প্রথম উঠছে, তা নয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, ‘বিপিএল’ ‘বিতর্ক’ আর ‘অনিয়ম’ প্রায় পাশাপাশি। প্রথম আসর থেকে সেই যে বিতর্ক শুরু হয়েছে, তা বন্ধ হয়নি। এখনো আছে। সেই শুরু থেকে ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক নিয়ে জটিলতা ও অনিয়ম সঙ্গী। প্রথম আসরে ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক পাওয়া নিয়ে রাজ্যের ভোগান্তির ঘটনা ছাপিয়ে বড় হয়ে দেখা দেয় সেমিফাইনালিস্ট নির্ধারণ নিয়ে নিয়মের চরমতম লঙ্ঘণের ঘটনা। অনিয়ম শুরু ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক নিয়েও। ভারতের আইপিএলের সাথে পাল্লা দিয়ে প্রথম দিকে আকাশছোঁয়া পারিশ্রমিক নির্ধারণ করা হয়েছিল। ভাবা হয়নি ফ্র্যাঞ্চাইজিদের পক্ষে তা দেয়া সম্ভব হবে কি না? তা না করে আইকন ও ‘এ’ গ্রেডের তারকা ক্রিকেটারদের মোটা অংকের টাকায় নিলামে তুলে পরে তা শোধ করায় নাভিশ্বাস ফ্র্যাঞ্চাইজিদের। আর ক্রিকেটারদের পাওনা অর্থের জন্য ফ্র্যাঞ্চাইজিদের দ্বারে দ্বারে ধর্না দিতেই কম্ম সাবাড়।ক্রিকেটারদের পাওনা পরিশোধের অনিয়ম ছাপিয়ে প্রথম বিপিএলের গায়ে সবচেয়ে বড় কালো দাগ হয়ে দেখা দেয় সেমিফাইনাল নির্ধারণ নিয়ে ঘটে যাওয়া রাজ্যের হ-য-ব-র-ল অবস্থায়। পয়েন্ট সমান হওয়ার পর কোনো কোনো দল শেষ চারে পৌঁছাবে? তা নির্ধারণ করা নিয়ে রীতিমত লঙ্কাকাণ্ড ঘটে যায়। প্রথমে এক নিয়মে দুই দলকে সেমিফাইনালিস্ট ঘোষণা করা হয়। পরদিন তা পাল্টে আবার অন্য নিয়ম অনুসরণ করে আরেক দলকে শেষ চারে দেখানো হয়। ভাবুন একবার, একদল আগের রাতে জানল তারা সেমিফাইনালিস্ট। পরদিন অন্য নিয়মে বদলে গেল তাদের ভাগ্য। আরেক নিয়মের প্রয়োগে ওই দলের জায়গায় শেষ চারে পৌঁছে গেল অন্য দল। অনিয়মের এর চেয়ে বড় দলিল আর কী হতে পারে? অবশ্য পরের আসরগুলোয় আর সেমিফাইনালিস্ট নির্ধারণ নিয়ে কোনো জটিলতা ও সমস্যা দেখা দেয়নি।কিন্তু পারিশ্রমিক নিয়ে ফ্র্যাঞ্চাইজিদের টালবাহানা অব্যাহত ছিল। আসর শেষ হওয়ার পরও পারিশ্রমিক পেতে রাজ্যের ভোগান্তির মুখে পড়তে হয়েছে ক্রিকেটারদের। অবশেষে সে ভোগান্তি দুর করতে গত আসর থেকে ক্রিকেটারদের পাওনা পরিশোধের দায়িত্ব নেয় বিসিবি। দ্বিতীয় আসরে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার সঙ্গে যোগ হয় ‘ফিক্সিং’ বিতর্ক। মোহাম্মদ আশরাফুলসহ দেশি বিদেশি ক্রিকেটার এবং চ্যাম্পিয়ন ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্স ফ্র্যাঞ্চাইজি শিহাব ট্রেডিংয়ের স্বত্তাধিকারী সেলিম চৌধুরীর বড় ছেলে শিহাব চৌধুরী বহিস্কার হন। তাদের ফ্র্যাঞ্চাইজি স্বত্ত¡ও বাতিল হয়। এবার বিপিএলের গায়ে নতুন দাগ- ‘নারী কেলেঙ্কারি।’ সব মিলে একটা ‘বিব্রতকার’ পরিস্থিতি। এবার প্রথম গোল বাধলো রংপুর রাইডার্সের ম্যানেজার সানোয়ার হোসেন এবং ক্রিকেটার জুপিটার ঘোষকে নিয়ে। তাদের পরস্পর বিরোধী বক্তব্য দিয়েই শুরু বিপত্তির। প্রথম জানা গেল রংপুর ম্যানেজমেন্ট ক্রিকেটার জুপিটার ঘোষকে নিষিদ্ধ করেছেন। তার বিরুদ্ধে নাকি আছে বড় ধরনের শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ। রংপুর ফ্র্যাঞ্চাইজি কর্তৃপক্ষ বিষয়টি পরিষ্কার না করলেও তাদের বক্তব্যে পরিষ্কার হয়েছে, জুপিটার ঘোষ মাঠের বাইরে অনৈতিক ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে নিষিদ্ধ হয়েছেন। সিসি ক্যামেরা ফুটেজে জুপিটার ঘোষকে এক নারী সঙ্গীনির সাথে হোটেল লবিতে দেখা যাওয়ায় বিষয়টি আরও জটিল হয়েছে। অনেকেরই ধারনা জুপিটার ঘোষ নারী কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। যদিও জুপিটার ঘোষ নিজেকে নির্দোশ দাবি করে উল্টো রংপুর ম্যানেজার সানোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন। জুপিটারের দাবি, সানোয়ার হোসেন তাকে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। ওই ঘটনায় আসলে কে কতটা দোষী? জুপিটার ঘোষ সত্যিই নারী কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত কি না? নাকি সানোয়ার সত্যিই তাকে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন? এসবের তদন্ত চলছে। এখন তদন্ত শেষেই কেবল জানা যাবে প্রকৃত দোষী কে? তবে জুপিটার ঘোষ ও সানোয়ার বিতর্কের অবসান না ঘটতেই বিপিএলের গায়ে নতুন কালো দাগ। এবার নারী কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে বিপুল পরিমান অর্থদণ্ড শাস্তি হয়েছে দুই তরুণ সাব্বির রহমান রুম্মন ও আল আমিন হোসেনের। ৪০ লাখ টাকায় রাজশাহী কিংসের হয়ে খেলা সাব্বির রহমানের পারিশ্রমিতের তিন ভাগের এক ভাগ কাটা গেছে। আর বরিশাল বুলসের পক্ষে ২৫ লাখ টাকায় সই করা পেসার আল আমিনের মোট পারিশ্রমিকের অর্ধেকই হাতছাড়া। এর আগের অনিয়ম ও অব্যস্থাপনা এবং ফিক্সিং বিতর্ক ছাড়িয়ে গেছে এবারের নারী কেলেঙ্কারীর ঘটনা। নানা অনিয়ম ও রাজ্যের বিতর্ক যুক্ত হওয়ায় মূল আয়েজনটাই হয়ে পড়েছে প্রশ্নবিদ্ধ। এমন কথাও বলা হচ্ছে, ‘আচ্ছা বিপিএল কী দেশের ক্রিকেটে বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিল? আবার কেউ কেউ এক প্রস্থ এগিয়ে বলছেন, বিপিএল দেশের ক্রিকেটে কোনই ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারছে না। উল্টো নেতিবাচক ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। ক্রিকেটাররা নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। যে আসর ক্রিকেটারদের অনৈতিক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত হবার ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা বন্ধ করে দেয়াই তো উত্তম। তাতে করে দেশের ক্রিকেট দাগমুক্ত থাকবে।  খুব বড় ক্ষতির মুখেও পড়বে না।’ এতো গেল এক পক্ষর কথা। আবার বিপরিত পক্ষও আছে। সচেতন ক্রিকেট অনুরাগিদের ভাবনা ভিন্ন। তাদের সোজা-সাপ্টা উত্তর, ‘ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি থাকতেই পারে। বিশ্বের সব ফ্র্যাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টি আসরের গায়েই কোনো না কোনো দাগ আছে। আইপিএলে স্পট-ম্যাচ ফিক্সিং নিয়ে কথা কথা। বলিউড স্টারদের মাতামাতি। মাঠ ও মাঠের বাইরে নানা মুখরোচক কথাবার্তা; কিন্তু তারপরও আইপিএল আয়োজন নিয়ে কোন নেতিবাচক কথা নেই। অতিবড় সমালোচকও মানছেন, ভারতীয় ক্রিকেটের উত্তরণে আইপিএল রেখেছে দারুণ কার্যকর ভূমিকা। ভারতীয় ক্রিকেটারদের অ্যাপ্রোচ ও অ্যাপ্লিকেশন পাল্টে গেছে আইপিএল খেলার মধ্য দিয়ে। রক্ষণাত্মক মানসিকতা পাল্টে ভারতীয় ক্রিকেটাররা এখন অনেক বেশি সাহসী ও আক্রমণাত্মক। একইভাবে বিপিএলও হতে পারে বাংলাদেশের ক্রিকেটের ব্র্যান্ডিংয়ের অন্যতম ক্ষেত্র।’ তাদের শেষ কথা, টি-টোয়েন্টি ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট উৎসব ও আসর এখন প্রায় সব দেশেই হচ্ছে। ভারতের আইপিএল এখন ক্রিকেটবিশ্বের সবচেয়ে সাড়া জাগানো আসর। অস্ট্রেলিয়ার বিগ ব্যাশও যথেষ্ট জনপ্রিয়। এছাড়া কারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগ, শ্রীলংকার এসএলপিএল এবং পাকিস্তানের পিএসএল- সব আসরই কম বেশি সফল। দর্শক বিনোদনের পাশাপাশি ক্রিকেটের প্রচার-প্রসার, জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে রাখছে কার্যকর ভুমিকা। বাংলাদেশের বিপিএলও তাই। প্রথম কথা হলো, বিপিএল হচ্ছে দেশি ও বিদেশি ক্রিকেটারদের সম্মিলন ক্ষেত্র। এটাই একমাত্র আসর যেখানে ৭জন বাংলাদেশি ক্রিকেটারের সাথে খেলছেন মাহেলা, সাঙ্গাকারা, আফ্রিদি ও ব্রাভোর মত ক্রিকেটাররা। তারা ছাড়া আরও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিদেশি ক্রিকেটারের সান্নিধ্যে যাবার অবারিত সুযোগ থাকছে। কুমারা সাঙ্গাকারা, মাহেলা জয়বর্ধনে, ক্রিস গেইল, শহিদ আফ্রিদি, ডোয়াইন ব্রাভো, আন্দ্রে রাসেল, শোয়েব মালিকের মত ক্রিকেটারদের সাথে এক হোটেলে থাকার সুযোগ করে দিচ্ছে বিপিএল। এক মাস সকাল বিকেল রাত একসঙ্গে এক ড্রেসিংরূম শেয়ার করা, প্র্যাকটিসের পাশাপাশি ১২ থেকে ১৪টি ম্যাচ খেলার সুযোগ পাচ্ছেন একজন আনকোরা তরুণ ক্রিকেটারও। এ আসর টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের শরীরি ভাষা, অ্যাপ্রোচ-অ্যাপ্লিকেশন এবং মাঠের পারফরমেন্স পাল্টে দিতে পারে। মোদ্দা কথা নিজেদের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অঙ্গনে মানিয়ে নিতে বিপিএল হতে পারে সবচেয়ে সহায়ক ক্ষেত্র। তার প্রমাণ, প্রথম বিপিএলে গেইল, আফ্রিদিসহ বিশ্ব তারকাদের সাথে খেলে খেলে হাত পাকিয়ে ওই বছর এশিয়াকাপে ভারত ও শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে প্রথমবার ফাইনালে পৌঁছেছিল বাংলাদেশ। ইতিহাস সুস্পষ্ট সাক্ষী দিচ্ছে,  ক্রিকেটারদের নিজেকে ঘষে মেজে তৈরির সর্বোৎকৃষ্ট ক্ষেত্র বিপিএল। পাশাপাশি ক্রিকেটারদের আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ারও অনুকুল ক্ষেত্র। পারিশ্রমিক যত করেই হোক না কেন, নানা অনিয়ম ও টালবাহানার পর শেষ পর্যন্ত ক্রিকেটাররা যে পরিমাণ অর্থ পান, তা ঘরোয়া ক্রিকেটের কোন আসরে মেলে না। কাজেই ক্রিকেটারদের আর্থিক উন্নতি এবং ক্রিকেটীয় উত্তরণে বিপিএল রাখতে পারে সর্বোচ্চ ভূমিকা। এমন এক আসর আয়োজনের পক্ষেই বরং যুক্তি বেশি। হ্যাঁ প্রশ্ন আসতে পারে নানা অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা ও কেলেঙ্কারি নিয়ে। এগুলো বন্ধ করা সম্ভব। একটু চোখ কান খোলা রেখে এবং ব্যবস্থাপনায় আরও দক্ষতার ছাপ রাখতে পারলে সব অনিয়ম-অব্যস্থাপনা ও বিভিন্ন কেলেঙ্কারি বন্ধ করা সম্ভব। যারা কোটি কোটি টাকা খরচ করে দল করেন, তারা দল জিতলে পাঁচ তারকা হোটেলে পার্টি দেবেন। সেখানে অনেক পার্টি ‘গার্ল-বয়দের’ আনাগোনা থাকে। ওটা বিগ ব্যাশ আর আইপিএলে আরও বেশি থাকে; কিন্তু সেখানে ক্রিকেটাররা নারী কেলেঙ্কারিতে জড়ান খুব কম; কিন্তু বাংলাদেশে ওই সব পার্টি দেখে অনেক ক্রিকেটারের মতিভ্রম ঘটতেই পারে। কারণ তার বেড়ে ওঠার সঙ্গে ওই জমকালো পার্টির সম্পৃক্ততা খুব কম। এসব বিষয় দূর করতে উদ্যোগ দরকার। শেষ কথা, মানুষের শরীরে নানা রোগ ব্যাধি হয়। কোনো কোনো রোগ সারাতে অপারেশনেরও দরকার পড়ে। অস্ত্রপ্রচারও হয়; কিন্তু তাই বলে কি শরীর কেটে ফেলা যায়? যায় না। মাথায় ব্যাথা হলে নিশ্চয়ই মাথা কেটে তার চিকিৎসা সম্ভব নয়। ঠিক একইভাবে এখন বিপিএলের গায়েও কিছু ঘা হয়েছে। তা সারাতে অস্ত্রোপচার দরকার। তা কেটে দিলেই সব ল্যাঠা চুকে যাবে; কিন্তু বিপিএল বন্ধ করে তো কোন সমসাধান নয়! বিপিএল চালু রেখে যতটা সম্ভব ভালো আয়োজনের চিন্তা ও চেষ্টাই আসল লক্ষ্য হওয়া উচিৎ। জাগো চ্যাম্পিয়নের ১৭তম সংখ্যা পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে।এআরবি/আইএইচএস/এমএস

Advertisement