বিশেষ প্রতিবেদন

লাশের গন্ধে ভারি রাখাইনের আকাশ

জাতিসংঘের মতে, বিশ্বের অন্যতম নিপীড়িত এক জনগোষ্ঠী মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের মুসলিম রোহিঙ্গা। দেশটির সেনাবাহিনীর হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশ ছাড়ছেন তারা। দিনের পর দিন খেয়ে না খেয়ে খোলা আকাশের নিচে থাকতে হচ্ছে তাদের। হন্যে হয়ে এদিক-সেদিক ঘুরছেন একটু আশ্রয়ের আশায়। ঢুকে পড়ছেন পার্শ্ববর্তী দেশ বাংলাদেশেও।নির্যাতিত এই জাতিগোষ্ঠীর খবর জানাতে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকা দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ঘুরে বেড়াচ্ছেন জাগো নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক শাহেদ শফিক। তার ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে ষষ্ঠ পর্ব। মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে নারকীয় তাণ্ডব চালাচ্ছে দেশটির সেনাবাহিনী ও মগ দস্যুরা। তারা রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়ে সম্পত্তি দখলে নিয়েছে। নির্বিচারে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করা হয়েছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুকে। ধর্ষণ যেন নিত্যদিনের ঘটনা। এরই মধ্যে হত্যা করা লাশের গন্ধে রাখাইন রাজ্যের আকাশ ভারি হয়ে উঠেছে।পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কাও করছেন কেউ কেউ। গত কয়েকদিনে সীমানা পেরিয়ে অবৈধভাবে পালিয়ে আসা টেকনাফ ও উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।  তারা জানান, ৯ নভেম্বর থেকে মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকা রাখাইন রাজ্যের ঢেকিবনিয়া, কুমিরখালী, শিলখালী, বলিবাজার, পোয়াখালী, নোয়াখালী ও নাগপুরাসহ অন্তত ২০টি গ্রামে দেশটির সেনাবাহিনী ও স্থানীয় মগ দস্যুরা একযোগে স্থল ও আকাশ পথ ব্যবহার করে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় তাণ্ডব চালায়। হাত-পা বেঁধে পশুর মতো গলা কেটে, পাখির মতো গুলি ও আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় হাজার হাজার নারী-পুরুষ ও শিশুকে। হত্যা করা এসব লাশের গন্ধে ভারি হয়ে উঠেছে রাখাইন রাজ্যের আকাশ। গন্ধে টিকতে না পেরে এখন গ্রাম ছাড়ছে সেখানকার নির্যাতনকারী স্থানীয় মগ দস্যুরাও। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদ্যরাও এখন দিশেহারা।  গত কয়েকদিন মিয়ানমার সীমান্তবর্তী টেকনাফ, উখিয়া, রামু ও কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম জাতির ওপর সে দেশের সেনাবাহিনী ও মগ দস্যুরা রোমহর্ষক নারকীয় তাণ্ডব চালাচ্ছে। হাত পা বেঁধে গুলি, পুড়িয়ে ও গলা কেটে নির্বিচারে হত্যা করা হয় তাদের। যুবতীদের পেলেই ধরে নিয়ে গণধর্ষণ করা হচ্ছে। ধান চাল, গরু ছাগল ও ফসলি ক্ষেত কিছুই তাদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। রাখাইনের প্রতিটি গ্রাম এখন আতঙ্কের জনপদ। নৃশংস বর্বর নির্যাতনে দিশাহারা এসব মানুষ ছুটছেন একটু আশ্রয়ের আশায়। নিজ দেশের সরকারি বাহিনীর হাতে সহায় সম্বল হারিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছেন তারা। পালিয়ে আসা এসব মানুষের চোখে মুখে বোবা কান্না। বর্বর নির্যাতনের চিত্র মনে করে এখনও শিউরে উঠে সবাই। ধর্মীয় কিংবা জাতি ভাইয়েরা আশ্রয় দেবেন এমন আশায় অবৈধভাবে ঢুকে পড়ছে পাশবর্তী দেশ বাংলাদেশে।  মিয়ানমারের সেনাবাহিনী, পুলিশ ও স্থানীয় মগ দস্যুদের হাতে নির্মন নিপীড়নের শিকার এসব রোহিঙ্গারা নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় অপেক্ষা করছে সীমান্তবর্তী এলাকা নাফ নদী তীরে। এরই মধ্যে অনেকেই ঢুকে পড়ছে বাংলাদেশে। আবার নদী ও সাগরের জলে ভাসছে নারী-পুরুষ-শিশু ও নিরীহ মানুষ বোঝাই অনেক নৌকা। দেশি দালাল ও স্থানীয় জেলেদের সহযোগিতায় দুর্গম সীমান্ত পাড়ি দিয়ে রাতের আঁধারেই অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাখাইন ও টেকনাফের সীমানা নাফ নদীর ওপারে এখনও হাজার হাজার নির্যাতিত রোহিঙ্গা অপেক্ষা করছে। একটু সুযোগ পেলেই রাতের আঁধারে তারা ঢুকে পড়ছে বাংলাদেশে। শুধু সীমানা পার হলেই যেন দীর্ঘশ্বাস। কেউ কেউ লুটে পড়েন সেজদায়। কিছু হোক বা না হোক বাংলাদেশে এসে অন্তত জীবনটা তো বাঁচবে! বৃহস্পতিবার রাতে নির্যাতনের শিকার হয়ে পালিয়ে এসে উখিয়ার কুতুপালং এলাকার অস্থায়ী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন অন্তত চার শতাধিক নারী। এক কাপড়েই তাদের অবস্থান। এদের অধিকাংশের স্বামী-ছেলে, ভাই বোন ও বাবা-মাকে চোখের সামনে গুলি ও গলা কেটে হত্যা করে ফেলে যায় মিয়ানমারের বর্বর সেনাবাহিনী। অন্যদের ধরে গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয়। ২০ দিন অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত তাদের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।  তাদের কয়েকজন তাসমিন, মরিয়ম ও শামসুন্নাহার। বুধবার ভোর চারটায় নাফ নদী দিয়ে তারা পালিয়ে আসেন উখিয়ায়। এ সময় কথা হয় জাগো নিউজের সঙ্গে। তারা বলেন, টানা ২০দিন মিয়ানমার সীমান্তের কুমিরখালীর গহীন পাহাড়ে জঙ্গলে লুকিয়ে থাকার পর আজ বহু কষ্টে বিজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে এক জেলের নোকায় করে জেলে সেজে এ পারে এসেছেন। লাশের গন্ধে পাহাড়ের ওই জঙ্গলে এখন আর থাকার পরিবেশ নেই। গন্ধে সেনাবাহিনীও এখন দূরে চলে যাচ্ছে। মিয়ানমার সেনারা গ্রামের পুরুষ ও যুবক ছেলেদের ধরে নিয়ে জঙ্গলের ভেতরেই হত্যা করে। তাছাড়া বন্যপ্রাণী, সাপ, হাতিসহ কত জীবজন্তুর ভয়! তারা জানান, সীমান্ত পার হওয়ার আশায় ওই পাহাড়ে এখনও হাজার হাজার মুসলিম রোহিঙ্গা অপেক্ষা করছে। কোনো খাদ্য সামগ্রী না থাকায় তারা উপবাসে রয়েছেন। সুযোগ পেলেই তারা পালিয়ে আসবে বাংলাদেশে।কিন্তু সীমান্তে কড়াকড়ি থাকার কারণে সাহস পাচ্ছেনা রোহিঙ্গারা। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে এই রোহিঙ্গা বলেন, ‘বাবা আমাদের একটু পার করে দাও না। আর সহ্য হয়না। হাঁটতে পারিনা। আমার পোলাটারে কত দিন খাওন দিতে পারিনা’।পালিয়ে আসা অপর একজন নারী এনাম বিবি। তিনি জানান, বাপ দাদা থেকে শুরু করে তারা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু থানায় বসবাস করে আসছেন। কিন্তু গত ৯ নভেম্বর হঠাৎ করেই মিয়ানমান সেনাবাহিনী ১৫ থেকে ২০টি হেলিকপ্টার নিয়ে আকাশ থেকে গুলি করতে থাকে। অপরদিক থেকে মগ দস্যুরা একযোগে বিভিন্ন ঘরবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। পুড়তে থাকে পুরো গ্রাম। তার ঘরে আগুন ধরিয়ে দিলে দৌড়ে ঘর থেকে বের হন।সঙ্গে সঙ্গেই আকাশ থেকে বোমা ও গুলি করতে থাকে সেনাবাহিনী। গুলিতে তার স্বামী নূর হোসেন ও ছেলে নবীর হোসেন মারা যান। তিনি গিয়ে আশ্রয় নেন ধান ক্ষেতে। তাতেও রক্ষা হয়নি। সেখানে গিয়েও ধর্ষণ করে মগ দুস্যরা। একপর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন এনাম বিবি। মৃত ভেবে ফেলে চলে যায় তারা। এনাম বিবি এখন আশ্রয় নিয়েছেন উখিয়ার কুতুপালংয়ের অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সেতারা জাহানের ঘরে। সেতারা জাহান জানান, তার পরিবারেই রয়েছে ৫ সদস্য।স্বামী কক্সবাজারে গিয়ে দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করেন। প্রতিদিন ২৫০ টাকা পান। এ থেকে ৫০ টাকা চলে যায় বাস ভাড়া। বাকি ২০০ টাকা দিয়েই কোনো মতে চলে তার ঘর সংসার। কিন্তু গত কয়েকদিনে মিয়ানমারে নির্যাতন শুরু হওয়ার পর তার কাছে আশ্রয়ের জন্য এসেছে ৫ পরিবারের আরো ২৮ জন রোহিঙ্গা। তার ছোট্ট খুপড়ি ঘরে নিজের পরিবারের সদস্যদেরই ঘুমাতে কষ্ট হয়, সেখানে ২৮ জনের ভরণপোষন ও ঘুমানো একেবারেই অসহনীয়। তার স্বামীর দৈনিক ২০০ টাকার আয়  দিয়েই চলছে ৩৩ জনের ভরনপোষণ।তিনি জানান, পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা কোথাও কাজ করতেও বের হতে পারে না। কারণ পথে পথে বিজিবির চেক পোস্ট। নিবন্ধিত কার্ড না থাকলেই গ্রেফতার।  এখনও মিয়ানমার সীমান্তের কুমিরখালীর গহীন পাহাড়ে অপেক্ষা করছে হাজার হাজার মানুষ। বুধবার ভোরেও টেকনাফ দমদমিয়া সীমান্ত এলাকা দিয়ে অন্তত ৫ শতাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছেন।  মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত প্রতিটি গ্রাম যেন এখন আতঙ্কের জনপদ। মৃত্যুপুরী বললেও খুব একটা বেশি বলা হবে না। সেখানে মাসাধিককাল ধরে চলা সে দেশের সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দমন নিপীড়ন ও নৃশংস বর্বর নির্যাতনে দিশাহারা অসহায় মুসলিম রোহিঙ্গারা ঘরবাড়ি সহায় সম্পত্তি ত্যাগ করে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে দলে দলে, এক কাপড়ে। তাদের চোখে মুখে বোবা কান্না, কেউ কেউ এখনও শিউরে ওঠেন মিয়ানমারের ভয়াবহ নির্যাতনের চিত্র মনে করে। বাংলাদেশ সীমান্তের ঘুমধুম সীমান্তবর্তী জনগণের ভাষায়, ওপারে চলছে মিয়ানমার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভয়াবহ নির্যাতন আর এপারে চলছে মুসলিম রোহিঙ্গাদের কান্না। এমএসএস/ওআর/এমএস

Advertisement