প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বহুদিনের লালিত অনেক স্বপ্ন নিয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে সব জেলা শহরের শিক্ষার্থীরা এখানে আসে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে দেশের এ সর্ববৃহৎ বিদ্যাপীঠে শহর এলাকার চেয়ে বেশী আসে গ্রামগঞ্জ থেকে বেড়ে উঠা ছেলে মেয়েরা। বাবা, মা, ছোট ভাই বোন, পাড়া প্রতিবেশী কিংবা অন্যকেউ সকলের থাকে এদের নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন। আর এমন স্বপ্নগুলোর বাস্তবে রূপ দিতে এসে তাদের পড়তে হয় নানান যন্ত্রনায়। নতুন একটি পরিবেশে এসে তারা যখন নিজেদের মানিয়ে নিতে হিমশিম, তখন শুরু হয় ইমিডিয়েট সিনিয়রদের বেঁধে দেয়া কিছু ধরাবাঁধা নিয়ম। এসব নিয়মতান্ত্রিকতার সামান্য হেরফের হলেই সহ্য করতে হয় কথিত বড় ভাইদের অমানুষিক নির্যাতন। আর ক্যাম্পাস জুড়ে এমন ঘটনা ঘটছে অহরহ। সর্বশেষ রোববার দিবাগত রাত বারোটা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হলে বেধে যায় প্রথম বর্ষ ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষ। যেখানে আহত হয় ১ম বর্ষের ৪ জন শিক্ষার্থী। আহতরা হলেন, জুবায়ের (বিবিএ), হাবিব (ভাষাবিজ্ঞান), ইমরান (ইংরেজি) ও সাইদুল (বাংলা)। এদের মধ্যে জুবায়েরের অবস্থা গুরুতর বলে জানিয়েছেন তার বন্ধুরা। তার গলায় চাপাতির কোপ লেগেছে বলে জানা গেছে। তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।ঘটনার সূত্রপাত ঘটে, ওই রাতে ২য় বর্ষের শিক্ষার্থীরা মিনি গেস্টরুম নেয়ার জন্য ১ম বর্ষের ওই চার ছাত্রকে ২২৬-ক নম্বর রুম থেকে ২২৭ নম্বর রুমে ডাকে । এই রুমে ছাত্রলীগের হল সভাপতি গ্রুপের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী পারভেজ (বিশ্ব ধর্মতত্ত্ব), সাবিত (ইসলামি স্টাডিজ) ও মুন্না (দর্শন) থাকে। প্রথম বর্ষের ওই শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা থাকায় তারা আসতে অস্বীকৃতি জানালে দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা তাদের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। এক পর্যায়ে তাদের উপর রড, চাপাতি দিয়ে হামলা চালানো হয়। এতে জুবায়েরের গলায় চাপাতির কোপ লাগে। তাৎক্ষণিকভাবে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।এছাড়া অভিযোগ উঠেছে, গত শুক্রবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ এফ রহমান হলে একই ঘটনা ঘটে। ওই দিন তোফায়েল আহমেদের প্রোগ্রাম থেকে ছুটি নিয়ে হলে আসার জের ধরে প্রথম বর্ষের রবিন নামের এক শিক্ষার্থীকে মারধর করে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের সোহেল নামের এক শিক্ষার্থী। এ ঘটনায় রাতে গেস্ট রুম বর্জন করে হলের ১১০ ও ১১১ নম্বর রুমের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা। পরে ওই দুই রুমে রাত ১১টার দিকে তালা লাগিয়ে দেয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। পরবর্তীতে হল কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় রাত ৪টার দিকে ওই দুই রুম খুলে দেয়া হয়। এছাড়া এ ঘটনায় রনি নামের প্রথম বর্ষের এক ছাত্রকে ৭ দিন হলের বাইরে থাকার নির্দেশ দিয়েছে হল ছাত্রলীগ। এর আগে সোহেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে একই অভিযোগে মাসুম নামের আরেক শিক্ষার্থীকে মারধরের।এর আগে একই অভিযোগে ২য় বর্ষের শিক্ষার্থীদের গেস্টরুম সিথিল করার নিদের্শ দেন শহীদুল্লাহ হলের ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থীরা। এসব কারণে প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠেছে বেশির ভাগ হলের শিক্ষার্থীরা। কয়েকটি হলে এর প্রতিবাদ করতে পারলেও বেশির ভাগ হলের শিক্ষার্থীরা হল থেকে বের করে দেয়ার ভয়ে নিশ্চুপ।এসব নিয়মতান্ত্রিকতার কিছু ভালো দিক থাকলেও কিছু কিছু বিষয় শিক্ষার্থীদের মেনে নেয়া আসলেই কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জিয়া হলের এক শিক্ষার্থী জানান, গেস্টরুমের এত ধরাবাঁধা নিয়ম মেনে চলা আসলে অসম্ভব। তারপরও চলতে হয়। কারণ হল থেকে বের করে দিলে বাহিরে থাকার টাকা নাই। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিয়মিতই চলছে গেস্টরুম নামের জুনিয়রদের মানসিক নির্যাতনের এমন ঘটনা। যেখানে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে ১ম বর্ষের শিক্ষার্থীরা। যার মধ্যে গেস্টরুমে কড়াকড়ির অভিযোগ রয়েছে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল, স্যার এ এফ রহমান হল, সলিমূল্লাহ মুসলিম হল এবং মাস্টার‘দা সূর্যসেন হল। আবার সিথিল গেস্টরুম নেয়ায় ক্যাম্পাসে সুনাম রয়েছে সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের। জানা গেছে, জহুরুল হক হলের সভাপতি রিফাত জামান ইমিডিয়েট সিনিয়রদের না দিয়ে নিজেই সপ্তাহে ২ থেকে ৩ দিন জুনিয়রদের গেস্টরুম নিয়ে থাকেন। জুনিয়রদের জন্য যেখানে স্থান পায় পাঠচক্রসহ বিভিন্ন জ্ঞানগর্ভা কথার। যাতে শিক্ষার্থীরা নতুন পরিবেশে এসে চলার অনেক জ্ঞান পেয়ে থাকে। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদী হাসান মোল্লা বলেন, কোনো ছেলের ক্লাস পরীক্ষা থাকলে তাকে মিছিল প্রোগ্রামে না আনার নির্দেশ দেয়া আছে। যেসব ছেলে পড়া লেখা করতে চায় তাদের সকল ধরনের সুযোগ করে দিতে আমরা আন্তরিক। এখনকার ছাত্রলীগের মধ্যে পড়ালেখা বাদ দিয়ে রাজনীতির কোনো সুযোগ নেই। এছাড়া যেসব হলের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া গেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর অধ্যাপক ড. এম আমজাদ আলী জানান, যারা প্রভোস্টের মাধ্যমে হলে উঠবে, তাদের বিষয়ে কিছু হলে আমরা দেখবো। এছাড়া রাজনৈতিকভাবে হলে উঠলে তাদের বিষয়গুলো রাজনৈতিক ভাবে তারা সমাধান করবে। এমএএস/পিআর
Advertisement