টাঙ্গাইলে প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত লাল-সবুজের ‘বীর নিবাস’ প্রকল্পের মাধ্যমে বিনামূল্যে একতলা ভবন পেয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন জেলার ভূমিহীন ও অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধারা। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের(এলজিইডি) আওতায় চলমান ‘ভূমিহীন ও অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের বাসস্থান নির্মাণ প্রকল্পের বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি করেছেন মুক্তিযোদ্ধারা। টাঙ্গাইল এলজিইডি সূত্রে জানা যায়, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি’র) তত্ত্বাবধানে জেলার ১২টি উপজেলায় প্রায় সাড়ে ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ১৪৬টি বাসস্থান নির্মাণ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ১১২টি ‘বীর নিবাস’ নির্মাণ করে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি ৩৪টির নির্মাণ কাজ চলছে।সূত্রমতে, জেলার ১২টি উপজেলার মধ্যে সদর উপজেলায় রয়েছে ২৫টি। এর মধ্যে ২৪টি হস্তান্তর করা হয়েছে আর একটির নির্মাণ কাজ চলছে। ভূঞাপুর উপজেলার ১০টির মধ্যে সাতটি হস্তান্তর হয়েছে। বাকি তিনটির কাজ চলছে। গোপালপুরে সাতটির মধ্যে সবকটি হস্তান্তর করা হয়েছে। ঘাটাইলে ২১টির মধ্যে ১৮টি হস্তান্তর হয়েছে। বাকি তিনটির কাজ চলমান রয়েছে। মির্জাপুরে ১৩টির মধ্যে ১১টি হস্তান্তর হয়েছে। বাকি দুইটির কাজ চলছে। নাগরপুরে ১২টির মধ্যে ৯টি ভবন হস্তান্তর হয়েছে। বাকি তিনটির নির্মাণ কাজ চলছে। কালিহাতীর ১৪টির মধ্যে ছয়টি হস্তান্তর হয়েছে। বাকি ৮টির নির্মাণ কাজ চলছে। সখীপুরের ১৪টির মধ্যে ৯টি হস্তান্তর ও ৫টির কাজ চলছে। বাসাইলে ১৪টির মধ্যে ১১টি হস্তান্তর ও ৩টির নির্মাণ কাজ চলছে। দেলদুয়ারে ১৩টির মধ্যে ১২টি হস্তান্তর ও ১টি নির্মাণ করা হচ্ছে। ধনবাড়ীতে দুইটির মধ্যে দুইটিই হস্তান্তর এবং মধুপুরের একটির মধ্যে একটিই হস্তান্তর করা হয়েছে।সরেজমিনে টাঙ্গাইল সদর উপজেলার বিশ্বাস বেতকার অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আবুল খায়ের মুন্সী, ঘারিন্দা ইউনিয়নের গোসাই জোয়াইর গ্রামের মো. আহসান উদ্দিন, ছিলিমপুর ইউনিয়নের পাকুল্যা গ্রামের মো. আ. রহমান খান, চৌবাড়িয়া গ্রামের মো. হুরমুজ আলী; ঘাটাইলের সাঘরদীঘি ইউনিয়নের আকন্দেরবাইদ গ্রামের মো. দানেছ আলী, বেতবাড়ী গ্রামের আ. মান্নান, ধলাপাড়া ইউনিয়নের মো. আলীফ হোসেন, দেওপাড়া ইউনিয়নের ফুলবাড়ী গ্রামের মো. আব্বাছ আলী, বাসাইল উপজেলার হাবলা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুল কাইয়ুম খানসহ ভবন পাওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের সৌভাগ্যবান মনে করছেন। তাদের একজনের ও ছিলনা ভালো টিনের ঘর। প্রায় প্রত্যেকেই ৩-৬ জন ছেলে-মেয়ে নিয়ে ছনের ঘর বা ছাপড়া ঘরে গাদাগাদি করে অতিকষ্টে বসবাস করতেন। অনেকেরই টিনের ঘরে বসবাস করা ছিল স্বপ্নের মতো। তারা জানান, কখনো তারা কল্পনাও করতে পারেননি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য তারা পাকা ভবন পাবেন। ভালো কোনো টিনের ঘরে ঘুমানোর শুধু আশাই করেছেন, বাস্তবে পারেননি। সরকার তাদের পাকা ভবন নির্মাণ করে দেয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তারা।অবেগাপ্লুত হয়ে তারা জানান, কোনোদিন ভাবেননি ছেলে-মেয়েদের নিয়ে পাকা ভবনে বসবাস করতে পারবেন। ছিল না সন্তানদের আগামী দিনের জন্য পাকা বাসস্থান নির্মাণ করে দেয়ার সাধ্যও।টাঙ্গাইল সদর উপজেলার গালা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মৃত আবুল কালামের স্ত্রী আছিয়া বেগম। স্বামী মারা গেছে ৭-৮বছর আগে তিন ছেলে-মেয়ে নিয়ে অতিকষ্টে একটি টিনের ছাপড়া ঘরে থাকতেন। বড় মেয়েটিকে বিয়ে দিয়েছেন, ছেলে কলেজের প্রথম বর্ষে ও ছোট মেয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ালেখা করে। সংসারের যাবতীয় খরচ চালিয়ে ভালো টিনের ঘর তৈরি করার শুধু স্বপ্নই দেখেছেন, কিন্তু তৈরি করতে পারেননি। সরকারি পাকা ভবন পেয়ে আনন্দে আত্মহারা তিনি। ঘাটাইলের সাগরদিঘী ইউনিয়নের গুপ্তবৃন্দাবন গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মৃত চান মাহমুদের স্ত্রী ফাতেমা বেওয়া ৫ ছেলে-মেয়ের জননী। বাড়ি ছিলনা, সরকার খাস জমি বন্দোবস্ত দিয়েছে। সেখানে মাটি ভরাট করে ছন ও বনের ডালপালা কেটে ঘর তৈরি করে বসবাস করতেন। সরকার পাকা ভবন নির্মাণ করে দেয়ায় তিনি বেজায় খুশি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মঙ্গল কামনা করে এখন তিনি প্রতি জুম্মায় মসজিদে মিলাদ দেন। ঘাটাইলের করিমপুরের কান্দুলিয়া গ্রামের মৃত ফজলুল করিম খানের স্ত্রী নাছরিন সুলতানা তিন সন্তানের জননী। ছেলে-মেয়েরা সংসারী হয়ে অন্যত্র থাকে। স্বামীর ভিটায় ঘর না থাকায় বাবার বাড়িতে থাকতেন। সরকার পাকা ভবন নির্মাণ করে দেয়ায় তিনি উচ্ছ্বাসিত। প্রতি পার্বণে ছেলে-মেয়েদের দাওয়াত খাওয়াতে পারার আনন্দে তার মিষ্টি হাসিটা চোখ ছুঁয়ে যায়। টাঙ্গাইল এলজিইডির উপ-সহকারী প্রকৌশলী ও মুক্তিযোদ্ধাদের ভবন নির্মাণ প্রকল্পের তত্ত্বাবধায়ক এসএম আব্দুল আব্দুল মান্নান বলেন, অসচ্ছল প্রত্যেক বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে ২৪ফুট ঢ ২০ফুট ১০ইঞ্চি পরিমাপের পাকা ভবন নির্মাণ করে দেয়া হচ্ছে। ভবনে দুইটি থাকার রুম, একটি বাথরুম, ডাইনিং, কিচেন ও ওয়াশ রুম থাকছে। এছাড়া পৃথকভাবে গরু রাখার ঘর (গোয়াল ঘর), মুরগী রাখার ঘর (খোয়ার), টিউবওয়েল স্থাপন করে দেয়া হচ্ছে। প্রতিটি পরিবারের জন্য খরচ হচ্ছে গড়ে ৮ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। এ ব্যাপারে টাঙ্গাইল এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মো. দেলোয়ার হোসেন জানান, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্পটিকে এলজিইডি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে দ্রুত বাস্তবায়ন করছে। টাঙ্গাইলের ১২টি উপজেলায় ১৪৬টি ভবনের মধ্যে ১১২টির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে অসচ্ছল বীরমুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি ৩৪টির নির্মাণ কাজও দ্রুত সম্পন্ন করা হচ্ছে। জাতীয় বীর মুক্তিযোদ্ধদের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এটি এক অনন্য প্রকল্প। আরিফ উর রহমান টগর/এআরএ/আরআইপি
Advertisement