মতামত

একাত্তরের চেতনায় আগামীর মুক্তিবীজ

১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর গৌরবের নিশান উড়িয়ে আসে কাঙ্ক্ষিত মুক্তি। এ মুক্তি বা বিজয় কেবলমাত্র পাকিস্তানি হায়েনাদের বাংলার মাটি থেকে চিরদিনের জন্য উপড়ে ফেলার জন্য ছিল না পাশাপাশি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সব ধরনের অন্যায়-অবিচার থেকে মানুষের মুক্তির মাধ্যমে একটি শোষণমুক্ত, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত এবং ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য সমান অধিকার আর সুখী ও মানবিক মূল্যবোধের সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে ছিল। পাকিস্তানের মতো একটি সুপ্রতিষ্ঠিত এবং সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধবিদ্যায় অনভ্যস্ত বাঙালি জাতির বিজয় খুব সহজ বা সাধারণ কোনো ঘটনা ছিল না। সেই কঠিন লড়াইটাই সম্ভব হয়ে উঠেছিল বাঙালি জাতির দেশপ্রেমের উত্তাপে। বিজয়ের ডিসেম্বর তাই মনে করিয়ে দেয় বীর বাঙালির সক্ষমতা, এই ডিসেম্বর এলেই তাই আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে জেগে উঠি নবপ্রাণে, নব উদ্দীপনায়। আমরা যখন আবেগের স্রোতে ভাসি বিজয়ানন্দে পরাজিত শক্তি তখন প্রতিশোধের আগুন বুকে জ্বেলে বদলা নেয়ার  হিসাব কষে। আহ্নিক গতির ঘূর্ণন প্যাঁচে সময় কিন্তু গড়িয়েছে বেশ। ঝড়, তুফান আর আলো ঝলমলে রোদের কাল ধরে ৪৫ বছর পেরোলেও পরাজিত শকুনদের কালো ছায়া থেকে বাংলার মাটি আমরা সত্যিকার অর্থে আজো মুক্ত করতে পারিনি। আর তাই বিশ্ব ইতিহাসে কলঙ্কের কালিমা লেপে বিজয়ের মাত্র সাড়ে তিন বছর পরেই  লাখো শহীদের রক্তে কেনা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় সেই পরাজিত দানবেরা বঙ্গবন্ধু আর তার পরিবারের পাশাপাশি তার আদর্শিক সঙ্গীদেরও নির্মমভাবে হত্যা করে রাষ্ট্রকে নিয়ে আবার পাকিস্তান অভিমুখে যাত্রা করে।একাত্তরের সেই ঘৃণ্য ঘাতক দালালেরাও একদিন হয়ে ওঠে দেশ পরিচালনার ক্রীড়নক। অত্যন্ত দুঃখজনক ও লজ্জাজনক হলেও সত্য যে, প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের অস্তিত্বই যারা বাস্তবিক অর্থে স্বীকার করে না- এ দেশের শাসন ক্ষমতার কলকাঠি বেশিরভাগ সময় আসলে তাদের হাতেই ছিল। বিজয়ীরা বরাবরই যুদ্ধজয়ের আনন্দে ভুলে যায় বিজয় অর্জনের  ফেলে আসা বন্ধুর, বেদনার আর গৌরবময় পথ কিন্তু পরাজিতেরা জীবনভর মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে সেই অব্যক্ত যন্ত্রণা। বিজয়ের ৪৫ বছর পরেও যখন দেশের আনাচে-কানাচে ধর্মান্ধতার দুর্গন্ধ ছড়ায়, আকাশে যখন উড়তে দেখি হিংসা-বিদ্বেষের সেই পুরনো শকুন তখন বিজয় আনন্দ থমকে গিয়ে অজানা আশঙ্কায় হৃদয় তার ভ্রু কুঁচকে কিছু সময়ের জন্য হলেও পেছন পানে চায়। এ ব্যর্থতার দায় কার, সে কাদা ছোড়াছুড়িতে আপাতত না গিয়ে পাঠক বরং চলুন খুঁজে দেখি চূড়ান্ত বিজয়ের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানো সে পরাজিত হায়েনা কোথায় কোথায় তাদের জাল বিছিয়েছে। প্রথমে ধর্মকে প্যারাসাইট হিসেবে ব্যবহার করে দখল নিয়েছে দুর্বল মস্তিষ্কের, এরপর রাষ্ট্র থেকে শুরু করে একে একে শিক্ষিত, অশিক্ষিত, ধনী, দরিদ্র নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে। রামু, হেফাজতের তাণ্ডব, হলি আর্টিসান বা সম্প্রতি ঘটে যাওয়া নাসিরনগরের ঘটনার পর এটি  প্রমাণের জন্য নতুন কোনো তথ্য-উপাত্তের আসলে আর প্রয়োজন নেই। আরও আশঙ্কার কথা, সেইসব ঘৃণ্য অপরাধীর কারো কারো রক্তের উত্তরাধিকারীদেরও বুকে টেনে নিয়ে দল ভারি করতে চাইছে ‘বিএনপি’। ক্ষমতায় থেকে এই দল ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকেই প্রতি পদে পদে প্রমাণ দিয়ে চলেছে তার অস্বাভাবিক জন্মের ইতিহাসের। মীমাংসিত সব ইস্যুকে সামনে টেনে এনে বালখিল্যতার উদাহরণই কেবল টানছে না বরং মানুষকে পুড়িয়ে, জ্বালিয়ে একের পর এক অসুস্থ রাজনীতির নজির সৃষ্টির প্রতিযোগিতায় নেমেছে যেন। কাজেই বাকি ক’জন যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি হলেই আমরা নিশ্চিত জীবন-যাপনের অধিকার পেয়ে গেলাম- এটা ভাবা হবে এক ধরনের মূর্খতা। বরং নতুন করে যুদ্ধ প্রস্তুতি নেয়াই হবে সঠিক সিদ্ধান্ত। যে চেতনার বীজে একাত্তরের জন্ম, সে বীজ থেকে জন্মানো দুর্বল বৃক্ষকে মহীরুহে পরিণত করাই হবে এবারকার যুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা পেয়েছি একটি মানচিত্র, যা জ্বলে-পুড়ে মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়, পেয়েছি লাল সবুজের স্বাক্ষর, পেয়েছি ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’, সেই সোনার বাংলাকে ভালোবাসি বলেই শোধ করবো পূর্বপুরুষের রক্তঋণ। মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিল জাতীয়তাবাদ, ন্যায় ও গণতন্ত্র এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ; দেশের গণতন্ত্রের যাত্রাপথও সুগম হয়েছে, স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি রাষ্ট্র ক্ষমতায় অন্যদিকে ভীষণ আশার কথা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি এমন প্রজন্মও আজ দেশকে কলঙ্কমুক্ত করতে বদ্ধপরিকর। জননেত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে এ জয় আমাদের হবে সুনিশ্চিত- গৌরবোজ্জ্বল বিজয় মাসে এই সংকল্প হৃদয়ে ধারণ করেই নতুন করে শুরু হোক আমাদের নতুন পথচলা।লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। arifa1977@yahoo.comএইচআর/এনএইচ/আরআইপি

Advertisement