জাতিসংঘের মতে, বিশ্বের অন্যতম নিপীড়িত এক জনগোষ্ঠী মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের মুসলিম রোহিঙ্গা। দেশটির সেনাবাহিনীর হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশ ছাড়ছেন তারা। দিনের পর দিন খেয়ে না খেয়ে খোলা আকাশের নিচে থাকতে হচ্ছে তাদের। হন্যে হয়ে এদিক-সেদিক ঘুরছেন একটু আশ্রয়ের আশায়। ঢুকে পড়ছেন পার্শ্ববর্তী দেশ বাংলাদেশেও। নির্যাতিত এই জাতিগোষ্ঠীর খবর জানাতে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকা দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ঘুরে বেড়াচ্ছেন জাগো নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক শাহেদ শফিক। তার ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে দ্বিতীয় পর্ব। ঠিকমতো কথা বলতে পারছেন না। আনমনা তাকিয়ে থাকেন সবসময়। স্মৃতির পাতায় কী যে তাকে ক্ষণে ক্ষণে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। কিছু বলবেন এমন ভাব, কিন্তু বলতে পারছেন না। তিনি মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে সে দেশের সেনাবাহিনীর হাতে নির্যাতিত হয়ে অবৈধভাবে বাংলাদেশে চলে আসা ৭০ বছর বয়সের বৃদ্ধা লায়লা বেগম। টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পাশে একটি ভাড়া বাসায় থাকেন তিনি।জাগো নিউজের এ প্রতিবেদককে দেখতে পেয়ে অনেকটা বিচলিত হয়ে পড়েন তিনি। আহা! আর বুঝি এখানেও থাকা যাচ্ছে না! অঝোরে দুই চোখের পানি ছেড়ে কিছু বলার চেষ্টা করতে থাকেন, কিন্তু মুখ থেকে সে কথা আর বের হচ্ছে না। স্থানীয়রা জানালেন তিনি সবকিছু হারিয়ে এখন বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন। ছেলে-সন্তান, ঘর-সংসার -সবকিছু হারিয়ে তিনি এখন বাস্তুচ্যুত।লেদা ক্যাম্পের ওই বাসার সামনেই খোলা আকাশের নিচে একটি চুলায় আঠার শিরনি রান্না করছেন এই বৃদ্ধা। পাশে গেলেই দু’হাত দেখিয়ে ইশারায় নির্যাতনের চিহ্ন দেখান তিনি। পাশে দাঁড়িয়ে আছেন স্বামী নূর মোহাম্মদ। কান্নার সুরে ওই বৃদ্ধার স্বামী নিজ ভাষায় বলে ফেললেন অনেক কথা। তার ভাষাগুলো জাগো নিউজকে বুঝিয়ে বলেন ক্যাম্পের স্থানীয় ইউনিট মেম্বার ইলিয়াছ। তিনি জানান- বৃদ্ধটি বলছে, ‘মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা মুসলিম দেখলেই নির্বিচারে গুলি ছোড়ে। ঘরে আটকে রেখে বাইরে আগুন ধরিয়ে দেয়। সুন্দর সুন্দর মেয়েদের দেখলে উঠিয়ে নিয়ে ধর্ষণ করে। সেনাদের দেয়া আগুনে নিজ ঘরের মধ্যেই তার চার ছেলে পুড়ে যায়। লাশগুলোও আনতে দেয়নি। সেই আগুন এখনো তাড়িয়ে বেড়ায় তাকে। সন্তানদের শোকে তার স্ত্রী এখন বাকরুদ্ধ। কোনো কথাই বলতে পারেন না।’ শুধু সত্তরোর্ধ্ব লায়লা বেগম নন, পুড়িয়ে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে তার অবুঝ নাতিকেও। সেই পোড়া চিহ্ন এখনো রয়েছে শিশুটির শরীরে। নাতিকে নিয়ে এখন তিনি দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। খেয়ে না খেয়ে তারা অবস্থান করছেন এই ক্যাম্পে। জানতে চাইলে ক্যাম্পের ইউনিট মেম্বার হুসাইন জোহার জাগো নিউজকে বলেন, ‘মিয়ানমারের সুচি সরকারের সেনাবাহিনীর নির্মম নিষ্ঠুরতার বলি হয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। নারী-পুরুষ, শিশু-যুবক -সবাইকে হত্যা করে তারা। বিশেষ করে যুবতী নারী দেখলেই ধর্ষণ। জীবন রক্ষার্থে তারা নাফ নদী পাড়ি দিয়ে এ দেশের দিকে চলে আসছে। আসার পথেও নানা নির্যাতন। দালাল চক্র এই বাস্তুহারা জাতি থেকে সব হাতিয়ে নিচ্ছে।’ মিয়ানমারের কেয়ারিপাড়া থেকে পালিয়ে আসা সৈয়দুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, বাড়ি-ঘর, ধন-সম্পদ -সব হারিয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন। আসার পথে তার এক ছেলেসহ দুজনকে ধরে নিয়ে যায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী। এখন পর্যন্ত তাদের কোনো হদিস নেই। যুবকদের ধরে ধরে মেরে ফেলে। মেয়েদের ধর্ষণ করে।’ গত বুধবার সীমান্ত এলাকা অতিক্রম করার সময় একটি ট্রলার আটকায় বিজিবি। এ ফাঁকে আরো একটি ট্রলারে করে ২৫ জন রোহিঙ্গা ঢুকে পড়ে বাংলাদেশে। তারা এখন আশ্রয় নিয়েছে টেকনাফের লেদা ক্যাম্পে। এদের নিজ ঘরে উঠিয়েছেন ‘এ’ ব্লকের লায়লা বেগম। তার ঘরে এখন পর্যন্ত ৩৫ জন অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা রয়েছে।তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘নিজের চলতে কষ্ট হয়। কিন্তু যখন দেখি নিজ জাতির এমন করুণ পরিস্থিতি তখন নিজের খাবার আর একা একা খেতে ইচ্ছে করে না। ক্যাম্পের অন্য বাসিন্দাদের কাছ থেকে চাল-ডাল চেয়ে কোনোরকমে চালাচ্ছি। একজনের খাবার খাচ্ছি পাঁচজনে। দিনের পর দিন থাকতে হচ্ছে একই কাপড়ে।’দেখা গেছে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ সীমান্তে অনুপ্রবেশ রোধে কঠোর অবস্থান নিলেও গত দু’দিনে বিজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে টেকনাফের এই অনিবন্ধিত ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন শত শত রোহিঙ্গা। এদের বেশিরভাগই নারী। মিয়ানমারের রাখাইন বা সেনাবাহিনীর হাত থেকে যারা কোনোমতে বেঁচে যান, তারা ছুটে আসছেন বাংলাদেশে। আশ্রয় নিচ্ছেন রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন বাসাবাড়ি কিংবা অনিবন্ধিত ক্যাম্পে। নিবন্ধিত ক্যাম্পগুলোর রোহিঙ্গারা জাতিসংঘের উদ্বাস্তুবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরসহ স্থানীয় বিভিন্ন এনজিও এবং দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে অনেক ধরনের সহায়তা পান। কিন্তু অনিবন্ধিত ক্যাম্পগুলোর রোহিঙ্গারা সহায়তা পাচ্ছেন না। সেখানে আগের আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ঠিকমতো জায়গা হচ্ছে না। এক পরিবারে ১০ থেকে ১২ জন রোহিঙ্গা থাকেন। ছোট্ট ঘরে এতোগুলো মানুষের একসঙ্গে থাকা যেন জেলখানার মতো।এমএসএস/জেডএ/এনএইচ/পিআর
Advertisement