বিশেষ প্রতিবেদন

‘আরা জান্নান বাঁচাইতে আইছিদে’

বিশ্বের অন্যতম নিপীড়িত এক জনগোষ্ঠী মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের মুসলিম রোহিঙ্গা। দেশটির সেনাবাহিনীর হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশ ছাড়ছেন তারা। দিনের পর দিন খেয়ে না খেয়ে খোলা আকাশের নিচে থাকতে হচ্ছে তাদের। হন্যে হয়ে এদিক-সেদিক ঘুরছেন একটু আশ্রয়ের আশায়। ঢুকে পড়ছেন পার্শ্ববর্তী দেশ বাংলাদেশেও।নির্যাতিত এই জাতিগোষ্ঠীর খবর জানাতে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকা দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ঘুরে বেড়াচ্ছেন জাগো নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক শাহেদ শফিক। তার ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে প্রথম পর্ব।‘আওয়াজ শুনিলে আরাতো ডরল্লাগে (শব্দ শুনলে আমাদের ভয় লাগে)। এদিন রাইতে আরারে গুলি করে (সেদিন রাতে আমাদের গুলি করে)। ঘরের দরজা ভাঙি আর জামাইর মুখের মধ্যে ফ্লাস্টার লাগাইয়ের গাড়িত তুলি ফালাইয়্যে (ঘরের দরজায় এসে স্বামীর মুখে প্লাস্টার লাগিয়ে গাড়িতে উঠিয়ে নেয়)। আর চোখের সামনে কোলের ফুয়ারে পইরত ফ্যালাই দিয়ে (চোখের সামনে কোলের শিশুকে পুকুরে ফেলে দেয়)। হরে আরে গছের মধ্যে বাঁধি রাখিয়েরে ঘরত ঢুইক্ক্যে (আমাকে গাছের সঙ্গে বেঁধে ঘরে ঢুকে)। জামাইরে আর্মি অলে গুরি অইজ্জে মাইয়া…(জামাইকে গুলি করে মেয়েকে…)। আরা জান্নান বাঁচাইতে আইছিদে(তাই আমরা জীবন বাঁচাতে পালিয়ে এসেছি)।’দীর্ঘশ্বাস নিয়ে কথাগুলো বলেন মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাতে নির্যাতিত হয়ে পালিয়ে আসা চার সন্তানের জননী রোকেয়া (৩৩)। তিনি এখন টেকনাফের লেদা ক্যাম্পে পরিচিত একজনের ঘরে উঠেছেন।প্রথমে কথা না বলতে চাইলেও সাংবাদিক শুনে হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠেন তিনি।তার বাড়ি মিয়ানমারের জামুন্না গ্রামে।রোকেয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘সৈন্যরা ছেলের সামনে মাকে, বাবার সামনে মেয়েকে ধর্ষণ করে। গুলি করে ঘর-বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। নির্যাতন সইতে না পেরে সীমান্তে রাত কাটিয়েছি। গতকাল (সোমবার) এক দালালকে ৬ হাজার টাকা দিয়ে বাংলাদেশে আসি।’রোকেয়া আশ্রয় নিয়েছেন লেদা ক্যাম্পের ‘এ’ ব্লকের এক সময়ের প্রতিবেশী লায়লা বেগমের ঘরে। শুধু রোকেয়ার পরিবার নয়, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে লায়লার ঘরে আশ্রয় নিয়েছেন আরো ৩৫ জন। মানবতার খাতিরে তাদের আশ্রয় দিয়েছেন লায়লা।লায়লা জানান, গত কয়েক দিনে ক্যাম্পে অন্তত দেড় শতাধিক রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছেন। প্রতিটি ঘরে ধারণক্ষমতার চেয়ে এতো  বেশি মানুষ যে, ঘুমানো তো দূরের কথা ঘরে ঠিকমতো শরীরও নাড়াচাড়া করা যায় না।ধারদেনা আর দান খয়রাতেই চলছে তাদের জীবন।মিয়ানমারের উত্তর জামুন্না গ্রাম থেকে পালিয়ে আসা হায়ের মোহাম্মদ বলেন, ‘সেনারা চোখের সামনে মানুষকে জবাই করছে।পিটাইতে পিটাইতে রক্তাক্ত করে ফেলে। কথা বললেই গুলি করে।লাশের গন্ধে কয়েকদিন ঘুমাতেও পারিনি।’নির্যাতনের কবলে পড়ে বহু আগেই বাংলাদেশে পালিয়ে আসা লায়লা বেগম বলেন, অনেকেই সহযোগিতা করতে চায়। কিন্তু পারে না। সহযোগিতা নিয়ে এলেই পুলিশ-বিজিবি চার্জ করে।আবুল হাসেম নামে এক রোহিঙ্গা বলেন, আমাদের একটু থাকার জায়গা দেন। দেশ শান্ত হলে আবার চলে যাবো।পায়ে গুলির কারণে ক্ষত হওয়ায় এখনো ভালোভাবে হাঁটতে পারেছেন না মো. তৈয়ব আলী। তিনি বলেন, রাখাইন ও সেনাবাহিনীর নির্যাতনের অতিষ্ঠ হয়ে পালিয়ে এসেছি। শখ করে কেউ পরবাসী হয় না। সেনাবাহিনী যুবক ও শিশুদের হত্যা করছে। যাতে তারা বড় হলে এ অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে না পারে।মিয়ানমারের ইক্কাপ জেলার মন্ডু থানার কয়ারি গ্রামের বাসিন্দা সৈয়দুর রহমান বলেন, নদীতে মাছ শিকার করেই চলতো তার সংসার। দুই মাস ধরে নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় সেনাবাহিনী। বিশেষ করে গত ৯ নভেম্বর থেকে এর মাত্রা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে।১২ নভেম্বর তার দুই ছেলেকে ধরে নিয়ে একজন জবাই করে।অপরজনের সন্ধান এখনো পায়নি।তিনি আরো জানান, প্রাণ রক্ষায় এক দালালকে জনপ্রতি ১৫০০ টাকা দিয়ে সীমান্ত পার হই। মৃত্যু ভয়ে যে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবেই আসছে।মিয়ানমারের কোয়ারি পাড়ার বাসিন্দা এক নারী বলেন, সৈন্যরা বাড়িতে ঢুকে তার স্বামীকে ঘরে আটকে রাখে বাকিদের বের করে দেয়।  পরে মালামাল লুট করে যাওয়ার সময় ঘরে আগুন দেয়। চোখের সামনে পুড়ে যায় স্বামীসহ বসতঘর। শুধু তার স্বামীকে নয়, এমন শত শত মানুষকে নিজ  ঘরেই আটকে আগুনে পুড়িয়ে মারছে তারা।তাই প্রাণের ভয়ে পালিয়ে এসেছি।এদিকে মিয়ানমারের নাগরিকদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে টেকনাফ সীমান্তে নজরদারি আরও বাড়িয়েছে বিজিবি, কোস্টগার্ড ও পুলিশ।এমএসএস/জেএইচ/এএইচ/বিএ

Advertisement