লজ্জা সংবরণের জন্য যে পোশাক পরিধান করা হয়- সেটা সহজেই আমাদের চোখে পড়ে কিন্তু চোখ এড়িয়ে যায় আছে এমন অসংখ্য ওজনদার রঙিন পোশাক! যে পোশাক নিষ্ঠা, একাগ্রতা আর ধারাবাহিক দক্ষতা প্রদর্শনের স্বীকৃতিস্বরূপ কাউকে প্রদান করা হয়, পোশাকটি ওজনের কারণে বিশাল দায়িত্বের বোঝা বইতে পারে। যাকে এই পোশাক অর্পণ করা হয়, তিনি নির্দিষ্ট কোনো সেক্টরের কিংবা কোনো কমিউনিটির প্রতি দায়িত্ব পালনে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকবেন লক্ষ্য থাকে সেটাই। মজার বিষয় হলো, পোশাকটি শাঁখের করাত, সংবেদনশীলতায় ধারালো। পোশাকের সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে তাতে হাওয়া লাগিয়ে বেড়ালে অর্পণকারী এবং পরিধানকারী দুজনেরই এদিক-ওদিক দুইদিকে কাটতে থাকে। এই পোশাকধারীদের প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৯০ জনকেই আমরা ট্রান্সভেস্টিজমে আক্রান্ত হতে দেখি! পদাধিকারবলে পাওয়া অথবা পদলেহনে পাওয়া এই পোশাকটি পরিধানের অনুভূতি ট্রান্সভেস্টিজমে ভোগা একজন ব্যক্তির বিপরীত লিঙ্গের আন্ডারওয়্যার পরিধানের অনুভূতির চেয়ে কোনো অংশেই কম আনন্দের না। ট্রান্সভেস্টিজম কী? ট্রান্সভেস্টিজম একটি রোগ। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা শারীরিক নয়, ভোগে মানসিক সংকটে। সামনাসামনি দেখে কিছুতেই এদের বোঝা যায় না অথচ মস্তিষ্কের ভেতরে এরা বহন করে চলেছে অদ্ভুত রকমের এক বিকার। এই রোগীরা বিপরীত লিঙ্গের পোশাক বিশেষ করে আন্ডার গার্মেন্টস পরিধান করে সেক্সুয়াল প্লেজার অনুভব করে থাকে। শুনে অবাক হয়েছি, এমন ট্রান্সভেস্টিক ব্যক্তির সংখ্যা নাকি আমাদের সমাজে প্রচুর। আমরা সচরাচর এদের টের পাই না, কারণ অন্দরমহল খুলে তো আর দেখা সম্ভব না! ধারে-কাছের মানুষেরা কখনো-সখনো টের পেলেও অগ্রাহ্য করে চলে। ভেবেই নেয় বিষয়টা কোনোভাবেই অস্বাভাবিক নয়, হয়তো নিরুপায় হয়েই তাকে বিপরীত লিঙ্গের পোশাক পরতে হয়েছে। হিসেবটা এভাবেই একটি গ্রহণযোগ্য সিস্টেমের মধ্যে ফেলে দেয়। সিস্টেম করে চলাফেরায় আমরা পারদর্শী, অত্যন্ত পারদর্শী। শুধু বিপরীত লিঙ্গের নয় বরং ক্ষমতার পোশাক পরে প্লেজার অনুভব করা মানুষকেও আমি ট্রান্সভেস্টিজমে ভোগা রোগী বলি। বিষয়টা অনেকের কাছে নিশ্চয়ই আপত্তিকর ঠেকবে। কেন আমি ক্ষমতার পোশাকধারীকে ট্রান্সভেস্টিকদের সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করছি! তাদের অমূল্য অর্জনকে হেয় করে আমি কি কোনোভাবে নিজের অপ্রাপ্তির খেদ মেটাতে ব্যস্ত! খেদকে বিদ্বেষে রূপান্তরিত করেছি? মোটেই কিন্তু তা নয়। ঠিক এই একটা জায়গায় আমি নিজেকে জনারণ্যে একা দেখি না, সবাইকে এক কাতারে দেখতে পাই- পদপিষ্ঠ হবে জেনেও যারা ফিঙ্গার ক্রস করে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে, যারা জানে তাদের কথায় পৃথিবীর এক চিমটি ধূলিকণাও এদিক থেকে সেদিক নড়বে না আর মানুষের তো বয়েই গেছে! তবে সান্ত্বনা এই যে- আমি ও আপনি মিলেই আমরা। আমরা মানেই সমবেত কণ্ঠস্বর, সমবেত শক্তি, বায়ান্ন, ঊনসত্তর, একাত্তর ও নব্বই। ট্রান্সভেস্টিকদের কাশফুলের মতো কোমল পোশাকের নাম নোবেল শান্তি পুরস্কার, সুড়সুড়িওয়ালা পোশাকের নাম জাতিসংঘ, উলঙ্গ পোশাকের নাম মানবাধিকার কমিশন এছাড়া আছে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত দলের রাজনৈতিক ব্যানারে প্রাপ্ত হাজারো রঙবাহারি পোশাক! এই পোশাকগুলো পরিধান করা মাত্র ব্যক্তি ট্রান্সভেস্টিজমে ভুগতে থাকে এবং চরিত্র ধুতুরা ফুলের মতো পবিত্র হয়ে যায়। সেই ধুতুরার নির্যাসে বেগুনি থেকে নীল, নীল থেকে কালো বর্ণ ধারণ করে দেশে দেশে সংখ্যালঘু জাতিসত্ত্বা ও ভূমিপূত্ররা যাদের পায়ের নিচে টলায়মান মাটি অনবরত কাঁপতে থাকে, যাদের জীবনের নিরাপত্তা মনুষ্য প্রজাতির নিরাপত্তার হিসেব থেকে আলাদা, হুট করেই যারা একসময় নিজের নামের আগে উদ্বাস্তু ট্যাগ আবিষ্কার করে। বোধ হয় পৃথিবীতে সবচেয়ে আনন্দের দৃশ্য হলো, সব হারানো মানুষের বুক চাপড়ানো হাহাকার। এটা বিকৃত মানুষের বিকৃত আনন্দ উদযাপনের মাধ্যম ‘পিপ শো’ দেখার মতোই উপভোগ্য। ক্ষমতার পোশাক পরিধান করে বিশ্বব্যাপী ট্রান্সভেস্টিকেরা আজ ‘পিপ শো’ দেখায় ব্যস্ত।প্রতিটা বিষয়েরই প্রাসঙ্গিক ও অপ্রাসঙ্গিক দুই দিকই থাকে। তাই এক্ষেত্রে আমি বিষয়টিকে জেনারালাইজ করতে চাই না। সবাইকে এক ছাঁচে ফেলে গড়পড়তা হিসাব করলে যৌক্তিক বিড়ম্বনায় পড়ার আশঙ্কা আছে, কারণ ট্রান্সভেস্টিক নির্ধারণ করা কিছুটা কঠিন। কিছু সমাজ ব্যবস্থায় পোশাক পরিধানের চর্চা সমন্বিত, অর্থাৎ নারী ও পুরুষের একইরকম পোশাক। পোশাক পরিধানের আচরণগত সমস্যার প্রকটতা নির্ণয়ের নিশ্চয়ই কোনো শক্তিশালী মাপকাঠি আছে, যার কারণে আমি বিপরীত লিঙ্গের পোশাক পরিধান করেও ট্রান্সভেস্টিক নই কিন্তু তিনি একজন- সেটা খুব সহজেই জানা সম্ভব। একইভাবে ক্ষমতার পোশাক পরিহিত অনেকের মধ্যেই নিরানন্দবোধ প্রকটভাবে কাজ করে। যারা পোশাক পরিধানের পর বুঝতে পেরেছেন- এটার ভার বহন করা কতটা কঠিন! যখন বুঝতে পেরেছেন সর্বোচ্চ পদাধিকার থাকার পরেও তারা কাজ করতে অপারগ, অর্থাৎ কোনো না কোনোভাবে তাদের কাজ করতে দেয়া হচ্ছে না। ক্ষমতাধারী এরকম কতিপয় ব্যক্তি আছেন, যারা প্রতিনিয়ত কাউন্টার সিন্ডিকেটের মাঝখানে পরে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা হারাচ্ছেন। আবার আত্মবিশ্বাসের বলে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেও পোশাক অর্পণকারীর রোষানলে পড়ছেন। এখানেও আছে শাঁখের করাত!ঐতিহ্যের পরম্পরায় পোশাক টানাটানির নোংরা গুঁতোগুঁতি চর্চা এখন তো প্রায় প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির পর্যায়ে চলে গেছে। মহান স্বাধীনতালাভের পর থেকে দেশে যতগুলো রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, সেগুলোর বিচারের ক্ষেত্রে সবসময় অনুভূতিপ্রবণ কিছু পোশাকধারীকে রক্ষার চেষ্টা চলেছে। যেদেশে নির্দ্বিধায় একজন নারীকে আমরা দেশ শাসনের দায়িত্বভার অর্পণ করতে পারি, সেই দেশে পূর্ণিমা রানী শীলের পূর্বসূরি থেকে শুরু করে তনু ও তার উত্তরসূরিরা যখন বীভৎস নির্যাতনের শিকার হয়ে মরে তখনও আমরা কারো না কারো অনুভূতিওয়ালা পোশাক রক্ষা করে চলি। যে দেশের সংবিধান অসাম্প্রদায়িকতার পোশাকে আবৃত সেদেশে সংখ্যাগুরু, সংখ্যালঘু আর ভূমিপুত্রদের চলার সীমানা নির্ধারণ করে সুড়সুড়ি অনুভব করা মানুষের অভাব নেই। ক্ষমতার প্রতাপধারণকারী চাকচিক্যময় পোশাকের বিষয়টি পৃথিবীজুড়েই মহামারী। যুগে যুগে এরকম পোশাকের উত্তরাধিকার বাপ তার ছেলেকে দিতে রাজি হয়নি, ভাই তার ভাইকে দেয়নি। পোশাক রক্ষার্থে প্রয়োজনে হত্যাকাণ্ডকে জায়েজ করা হয়েছে। সংখ্যালঘুর ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ভূমি দখলও জায়েজ করা হয়েছে। সব জায়েজের দেশে বাস করে আমার এখন নিজেকে নাজায়েজ লাগে। লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক।এইচআর/এনএইচ/এমএস
Advertisement