মতামত

শহীদ ডা. মিলন ও গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা

২০১৬ সালের ২৭ নভেম্বর শহীদ ডাক্তার মিলন দিবস এমন সময় পালিত হচ্ছে, যখন বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও উন্নয়নের রোল মডেলের রূপকার হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, জননেত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হচ্ছেন। চিকিৎসকদের একমাত্র জাতীয় সংগঠন, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন হাজারো সংগ্রাম, অসংখ্য আত্মত্যাগ, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্রের সংগ্রামে মানবতার সেবায় নিয়োজিত সুপরিচিত ঐতিহাসিক পেশাজীবী প্রতিষ্ঠান। চিকিৎসক ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এবং মুমূর্ষু মানুষের সেবায় নিয়োজিত আছেন- এ সংগঠনের অকুতোভয় সদস্যরা। এ দেশের মানুষের কাছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের পথিকৃৎ বিএমএ। ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শহীদ ডা. শামসুল আলম খান মিলনের আত্মাহূতি নির্বাসিত গণতন্ত্রের পুনঃউত্থানে চিকিৎসক সমাজকে অত্যন্ত সম্মানের আসনে আসীন করেছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঢাকা মেডিকেলের পাশে সুউচ্চ শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠা, ৬৯-এর গণআন্দোলন এবং ’৭১-এর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে এ সংগঠনের সংগ্রামী সদস্য সেনারা নির্ভীক আত্মত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত। ১৯৯৬ সালের ভোট ও ভাতের অধিকার এবং ১/১১-এর আন্দোলনে জননেত্রী শেখ হাসিনার মুক্তির আন্দোলনে চিকিৎসক সমাজ বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছে। পেশাজীবীদের মধ্যে সর্বোচ্চ রক্তদানকারী শহীদ চিকিৎসকেরা অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে এনেছেন। সেই গৌরবময় ইতিহাস ও পূর্বসূরিদের অনুপ্রেরণায় বিএমএ’র সদস্যরা গর্বিত। ডা. মিলন হত্যার সঙ্গে সঙ্গে দেশের সব চিকিৎসক সমাজ রাস্তায় বেরিয়ে আসে এবং এরশাদ সরকারের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ডা. মিলনের রক্ত ছুঁয়ে শপথ করে এরশাদ সরকার পদত্যাগ না করা পর্যন্ত তারা কাজে যোগদান করবেন না বলে ঘোষণা দেয়। এরশাদ সরকারের অধীনে চাকরি না করার অঙ্গীকার করে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন চিকিৎসকেরা। ১৯৯০ সালের ২৮ নভেম্বর এ দেশের চিকিৎসক সমাজ সারাদেশে হরতালের ডাক দেন। স্বৈরাচারবিরোধী বিভিন্ন জোট এই হরতালকে সমর্থন দান করেন এবং তারাও নতুন করে স্বৈরাচারের জরুরি আইন ও কারফিউ আইন অমান্য করার কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ডা. মিলনের আত্মাহূতির মধ্য দিয়ে দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে। লক্ষ্মীপুরের মো. সাজুদ্দিন খানের ছেলে মিলন জন্ম নেয় ১৯৫৭ সালের ২৯ জানুয়ারি। মিলন ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজে প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়ে ১৯৮৩-এ চিকিৎসক হয়ে বের হন। এর পরে ইন্টার্নি চিকিৎসকদের আহ্বায়ক, বিএমএ’র সক্রিয় সদস্য ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ শিক্ষক সমিতির কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। শহীদ ডাক্তার শামসুল আলম খান মিলনের সঙ্গে বিএমএ’র অফিস সেক্রেটারি হিসেবে একত্রে কাজ করার সুযোগ হয় ১৯৮৮ সাল থেকে। বিএমএ দুটি প্যানেলে নির্বাচন করে ডা. মাজেদ-ডা. মাহবুব ও ডা. সারোয়ার-ডা. জালাল পরিষদে একটি প্যানেলের মাত্র দুজন জয়ী হয়। ডা. এমএ মাজেদ সভাপতি ও ডা. শামসুল আলম খান মিলন যুগ্ম সম্পাদক। ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন মহাসচিব নির্বাচিত হলে আমি দপ্তর সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করি। একই কার্যকরী পরিষদে আমরা সবাই অভিন্ন মনোভাব নিয়ে কাজ করতে থাকি। জেল-জুলুম-হুলিয়া আমাদের কোনো আন্দোলন থেকে পিছু হটাতে পারেনি। চিকিৎসক তথা জনতার দাবি আদায়ে মিলন ও আমরা ছিলাম নির্ভীক।নয় বছরের স্বৈরশাসনে সবার মতো চিকিৎসকেরাও দুঃশাসনে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। তার সঙ্গে গণবিরোধী স্বাস্থ্যনীতি চাপিয়ে দেয়া হলে সরাসরি সরকারবিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়া ছাড়া আমাদের কোনো গত্যন্তর ছিল না। ১৯৯০ সালের ২৭ জুলাই বিশেষ বার্ষিক সাধারণ সভায় সব চিকিৎসক পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। মঞ্চ থেকে বাইরে এসে দাঁড়িয়ে কথা বলছি আমি আর মিলন। ওই সময় বিএমএ নেতাদের বিবিসিতে সাক্ষৎকার গ্রহণ করে টেলিফোনে। আমার যে সাক্ষাৎকারটি ১৯৯০ সালের ২৭ জুলাই রাত্রে বিবিসিতে প্রচার হয়, তাতে ডা. মিলন পাশে থেকে বিভিন্ন বিষয়ে বলতে সাহায্য করেছিল। সেদিন আমাকে বলা তার একটি কথা আজও মনে ভাসে তা হলো, ‘বলুন আমরা দাবি আদায়ে মৃত্যুকেও ভয় পাই না।’ সত্যি এমন নির্ভীক দেশপ্রেমের অকুতোভয় বীর খুব কমই জন্ম নেয়। বিএমএ কার্যক্রমে মিলন সর্বদাই অবদান রাখার চেষ্টা করেছেন। বিএমএ-তে প্রতিনিয়ত হাজির থেকে দূরদূরান্ত থেকে আগত চিকিৎসকদের সঙ্গে সর্বদা হাস্যোজ্জ্বল সদালাপি ছিলেন ডা. মিলন। ২৭ নভেম্বর ’৯০ তৎকালীন পিজি হাসপাতালে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) সরকারবিরোধী সমাবেশে যোগ দিতে গিয়ে টিএসসি-এর গোল চত্বরে স্বৈরাচারের ভাড়াটে গুণ্ডাদের হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন ডা. মিলন। চিকিৎসক মিলনের রক্তে ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচারী এরশাদ শাহীর পতন ত্বরান্বিত হয়। বিএমএ প্রেসিডেন্ট অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। সময়ের পরিক্রমায় বিএমএ হয়ে উঠবে চিকিৎসক সমাজের আশ্রয়স্থল- সামনের দিকে পথ চলার কাণ্ডারি। জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পৌঁছানোসহ বর্তমান সরকার প্রায় ১২ হাজার চিকিৎসকের নিয়োগদান ও পাঁচ হাজার চিকিৎসককে পদোন্নতি দিয়ে আমাদের অনেক দাবি পূরণ করেছেন। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাসহ দেশের মানুষের ভাগ্যের আমূল পরিবর্তন ও উন্নয়ন সাধনে বিএমএ-এর ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। চিকিৎসকদের মাধ্যমে এস.ডি.ডস ২০৩০ বাস্তবায়নে সরকার আরও আন্তরিক হবে- এটা আমাদের প্রত্যাশা। দেশে জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান এবং গণতন্ত্রের নামে মানুষ পুড়িয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড যেভাবে পরিচালিত হয়েছে, তা গণতন্ত্র ধ্বংস করে তৃতীয় শক্তির উত্থানের অপচেষ্টা বলে মনে হয়েছে। সাংবিধানিকভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র রক্ষার ক্ষেত্রে বাঙালি জাতিকে ৯০-এর মতো ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যাওয়ার শপথ নিতে হবে। ৭১-এর মতো স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার, আলবদর ও তাদের দোসর এবং রাজনৈতিক দলগুলো বর্জন করে বাংলাদেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা অতীতের মতো ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যাবেন- এটাই এবারের মিলন দিবসের শপথ হোক। লেখক : প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। সাবেক মহাসচিব, বিএমএ।এইচআর/এনএইচ/এমএস

Advertisement