মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে নিধনযজ্ঞ চালাচ্ছে দেশটির সরকারি বাহিনী। জীবন বাঁচাতে রাখাইন রাজ্যের হাজার হাজার রোহিঙ্গার দৃষ্টি এখন বাংলাদেশ সীমান্তে। মাথায় একটাই চিন্তা। কীভাবে নরককুণ্ড থেকে বেরিয়ে আসা যায়? সেই নরক থেকে বেরিয়ে আসা একজন মিয়ানমারের মংডুর জামবুনিয়া রাঙ্গাবালি গ্রামের বিধবা ফাতেমা খাতুন (৫৩)। স্বামীকে হারিয়েছেন অর্ধযুগ আগে। মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে বসবাস হলেও নাগরিকত্ব মিলেনি। এরপরও সন্তান ও নাতি-নাতনি নিয়েই দিন কাটছিল। কিন্তু সেই সুখ তাদের শোকেই পরিণত হয়েছে।সবকিছু হারিয়ে তিন নাতনিকে নিয়ে তিনি এখন দেশান্তরি। স্বীকৃতি মিলেছে অবৈধ অভিবাসীর। ওপারে নিরাপত্তা নেই। এপারে নেই আহারের সংস্থান। জীবন এখন তার কাছে বিভীষিকাময়। তার ভাষায়, ‘জন্মটাই যেন আমাদের আজন্ম পাপ।’
Advertisement
কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা বস্তিতে আশ্রয় নেয়া ফাতেমা তাদের ওপর বয়ে যাওয়া বিভৎস নির্যাতনের কথা বলতে গিয়ে আতকে ওঠেন। তিনি বলেন, গ্রামে সেনাসদস্যরা আক্রমণ চালায় ১৫ নভেম্বর রাতে। অতর্কিত বাড়িতে ঢুকে তিন ছেলে শাহ আলম (৩০), নুর ছালাম (২৭), আমান উল্লাহ (২৫) ও হামিদ হোসেনকে (১৬) বেঁধে ফেলে। এরপরই চলে তার দুই মেয়ের ওপর পাশবিক নির্যাতন। একে একে সেনারা তাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। ফাতেমা বলেন, ‘নির্যাতনে বাধা দেয়ায় সেনারা এলোপাতাড়ি মারধর শুরু করে। মেয়েদের ওপর নির্যাতন শেষ হলেই চার ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে ঘরে আগুন দেয় সেনা সদস্যরা। এ সময় প্রাণ বাঁচাতে কে কোথায় গেছে আমি জানি না।’ রাতে এক স্থানে আমার তিন নাতনি নূর ফাতেমা (৭), সাহেনা (৬) ও হাসিনাকে (৫) পেয়ে যাই। তাদের নিয়ে পাহাড়ের আড়ালে আশ্রয় নেই। ভোর হলে দেখি আমাদের প্রতিবেশীসহ কারো বাড়িঘর নেই। মানুষজনও নেই। এ অবস্থায় সেখান থেকে পালিয়ে সীমান্তের দিকে চলে আসি। তবে কীভাবে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছি তা আমার জানা নেই। পরে পালিয়ে আসা লোকদের সঙ্গে পালংখালীর ঝিমংখালী হয়ে চলে আসি কুতুপালং বস্তিতে। তার মতো অসংখ্য ফাতেমা এখানে আশ্রয় নিয়েছেন। কারো স্বামী, কারো সন্তান, কারো বাবা বর্বরতায় হারিয়ে গেছে। শুক্র ও শনিবার সকালে কুতুপালং রোহিঙ্গা বস্তিতে নতুন করে ঢুকেছে ২৫টি পরিবারের শতাধিক নারী-পুরুষ-শিশু।
গত ৯ অক্টোবর সে দেশের বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) ৩টি চৌকিতে দুর্বৃত্ত হামলার ঘটনায় জড়িতদের আশ্রয় দেয়ার অভিযোগে চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে রোহিঙ্গা মুসলিম অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যের ১৫টি গ্রামে দফায় দফায় নারকীয় হামলা চালানো হয়। সেনাদের হামলায় গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলমানের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। পোশাকি অস্ত্রধারীদের হাতে ধর্ষিত হয়েছে অসংখ্য নারী। তাদের মাঝেই মংন্ডু পোয়াখালী নয়াপাড়া থেকে আসা মোহাম্মদ ইসমাইল (২৫)।তিনি বলেন, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে রাতে খেতে বসছিলাম। হঠাৎ সেনারা গ্রামে ঢুকে গুলিবর্ষণ শুরু করে। একপর্যায়ে ঘরে আগুন দেয়। প্রাণভয়ে আমার স্ত্রী তসলিমা সন্তান মোহাম্মদ ইদ্রিস (৪) ও হাবিবাকে (৩) নিয়ে ধানখেতে লুকান। পরদিন রাতের আঁধারে টেকনাফের হোয়াইক্যং এলাকার ঘাট দিয়ে জনপ্রতি ৩০ হাজার কিয়াত (মিয়ানমারের টাকা) দিয়ে নাফনদী পার হই। সেখান থেকে সড়ক পথে কুতুপালং আসি। পার্শ্ববর্তী খেয়ারীপাড়ার বয়োবৃদ্ধ আলি আহমদ (৬০) জানান, তাদের পাড়াটি জ্বালিয়ে দেয়ার পর পাশের গ্রাম জাম্বনিয়ায় সপরিবারে আশ্রয় নেই। পরে সেখানেও সেনাবাহিনী বর্বর হামলার পর পরিবারের ৭ সদস্যের খোঁজ পাননি। একইভাবে প্রাণভয়ে পালাতে গিয়ে নিজ সন্তানসহ স্ত্রীকে হানার একই এলাকার আব্দুল হামিদ (২৬)। নিজে বর্বরতা থেকে বাঁচলেও সন্তানদের নিয়ে স্ত্রী ছেনুয়ারা কোথায় কীভাবে আছে এ নিয়ে চরম উদ্বিগ্ন তিনি। শনিবার সন্ধ্যায় টেকনাফের লেদা বস্তিতে ছয় ভাইবোনের সঙ্গে দেখা হয়। তাদের মুখে কোনো কথা নেই। তিন ভাইবোন বয়সে ছোট। বড় বোনের স্বামী সাকেরের হাত ধরেই এপারে এসেছে তারা।
কীভাবে বাংলাদেশে ঢুকেছ জানতে চাইলে করুণ দৃষ্টিতে তাকায়। কিশোরী ও তরুণীদের ওপর বর্বর নির্যাতনের অল্প বিবরণ দিয়ে লজ্জায় মাথা নিচু করে কেঁদে ফেলে।সাকের বলেন, সেনাবাহিনী সন্ত্রাসী ধরতে অভিযানের নামে ধর্ষণ-নির্যাতনে লিপ্ত। তারা খেয়াল-খুশিমতো রাতে পাড়ায় ঢুকে কিশোরী যুবতীদের নির্যাতন চালাচ্ছে। স্বর্ণালংকার ও টাকা লুট করছে। তারপর ঘরে আগুন দিচ্ছে। প্রতিবাদ করলে গুলি বা জবাই করে হত্যা করছে। সরকার সব জেনেও চুপ।তিনি আরো বলেন, এপারে এসেও আমরা টিকতে পারছি না। ওখানে নির্যাতন থেকে পালাতে গিয়ে অভুক্ত ছিলাম আর এপারে নির্যাতন নেই কিন্তু অনাহারে আছি।গত বুধবার ভোররাতে উখিয়া থানা পুলিশের হাতে আটক হয় অর্ধশতাধিক রোহিঙ্গা। থানা প্রাঙ্গণেই তাদের জন্য দুপুরের খাবারের আয়োজন হয়।তিনদিন ধরে অভুক্ত বেশিরভাগ রোহিঙ্গা হুমড়ি খেয়ে খাবার গ্রহণ করে। তবে দুই কিশোরীকে একাধিকবার অনুরোধের পরও খাবার খেতে রাজি করানো যায়নি। কোন কিছু জানতে চাইলেও নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তারা।উখিয়া থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল খায়ের ও টেকনাফ থানা পুলিশের ওসি আবদুল মজিদ বলেন, রাখাইন প্রদেশে নির্যাতনের শিকার অসংখ্য রোহিঙ্গা সহানূভুতির সঙ্গে সীমান্তে আশ্রয় পেয়েছে। মানবিক দিক বিবেচনায় তাদের আমরা তাতক্ষণিক বিতাড়নের প্রক্রিয়া নিচ্ছি না। তবে তারা যেন অবস্থান নেয়া স্থান থেকে অন্যত্র সরে যেতে না পারে বিজিবির পাশাপাশি পুলিশও সে দিকে নজর রাখছে। এ বিষয়ে স্থানীয় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেছেন, রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশকে সীমান্ত খুলতে যে অনুরোধ করছে তা মোটেও যৌক্তিক নয়। বরং মিয়ানমার সরকারকে এ বিষয়ে কঠোর চাপ দেয়া উচিত।সায়ীদ আলমগীর/এএম
Advertisement