সিংহ ছাড়া যেমন বন জৌলুশ হারায় আর্জেন্টিনা ছাড়াও তেমনি জৌলুশ হারাবে ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসর বিশ্বকাপ। বর্তমান যে অবস্থা তাতে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ খেলবে এমন বাজি ধরা লোকের সংখ্যা নেহাত কম বৈ কি, বেশি হবে না। ১৯৭০ সালের পর টানা বিশ্বকাপ খেলে যাচ্ছে ম্যারাডোনার দেশ। বিশ্বকাপ ইতিহাসে কেবল ওই একবারই বাছাইপর্ব খেলে উত্তীর্ণ হতে পারেনি দলটি। তারপর থেকে বিশ্বকাপ ফুটবলে নিয়মিত এই দলটি বর্তমান শতাব্দিতে রয়েছে সবচেয়ে বাজে অবস্থানে। বিশেষ করে বললে গেল তিনটি বছর যেন আর্জেন্টিনার প্রতিটি ফুটবল পাগলমানুষের কাছে বিষের মত। দু’টি কোপা আমেরিকা এবং বিশ্বকাপের ফাইনালে জিততে ব্যর্থ হয় আলবিসেলেস্তেরা। অথচ এই দলেই খেলেন কি না বিশ্বের অন্যতম সেরা, পাঁচবারের ব্যালন ডি’অর জয়ী ফুটবলার লিওনেল মেসি! মেসি খেললেই যে আর্জেন্টিনা জিতে যাবে এমনটা ভাববার অবকাশ নেই। মেসি খেললেও আর্জেন্টিনার বাকি সদস্যরা মাঠের ভেতর অনেকটা হাত গুটিয়ে বসে থাকার মত অবস্থায় থাকে। ভাবটা এমন যেন মেসি একাই একটা দলকে জিতিয়ে দিবে; কিন্তু ফুটবল যে ১১জনের খেলা এটা প্রতিনিয়ত ভুলে যাচ্ছে দিয়েগো ম্যারাডোনার দেশ। ক্লাব পর্যায়ে গন্ডায় গন্ডায় গোল করা আগুয়েরো, হিগুয়াইনরা আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে চাপলেই যেন খেলা ভুলে যান। এমন অবস্থায় খেলোয়াড়দের পাশে সবথেকে বেশি দরকার ছিল আর্জেন্টিনার ফুটবল ফেডারেশনকে (এএফএ)। অথচ তাদের ভূমিকা আরো শোচনীয়। মেসিদের বর্তমান এই নাজুক অবস্থার জন্য আর্জেন্টিনার ফুটবল ফেডারেশনও কম দায়ী নয়। অব্যবস্থাপনায় ঠাঁসা আর্জেন্টিনার ফুটবলাররা নামমাত্র পারিশ্রমিকেই দেশের হয়ে খেলতে মাঠে নামেন। এই ফেডারেশনের এতই বাজে অবস্থা যে, আর্জেন্টিনার দলকে নিরাপত্তা দেওয়া কর্মীদের ছয়মাসের বেতন দিতে পারেনি। মেসির কাছে এই ব্যাপারে নিরাপত্তাকর্মীরা জানালে মেসি নিজ উদ্যোগে তাদের সকল বেতন পরিশোধ করে দেন। এই হচ্ছে আর্জেন্টিনার ফুটবল ফেডারেশন। বিতর্কে ঠাসা আর্জেন্টিনা দলের খেলোয়াড় নির্বাচন নিয়েও রয়েছে ধুম্রজাল। আর্জেন্টাইন মিডিয়ার দাবি মেসির নির্দেশেই নাকি দল নির্বাচন করে থাকেন এদগার্দো বাউজা। এমন উদ্ভট খবরে বেশ নড়েচড়ে বসেছেন মেসি এবং বাউজা। দু’জনেই মিডিয়ার এই বানোয়াট কথা তৎক্ষণাৎ অস্বীকার করেন। বাউজা তো বলেই দিয়েছেন, ‘যারা বলে মেসি আর্জেন্টিনা দল গঠন করে দেয় তারা মিথ্যাবাদী। এটি কেবলমাত্রই মিডিয়ার সৃষ্টি একটি ভুল খবর।’ মেসির দল নির্বাচন নিয়ে সংশয়ের ইতি ঘটলেও আর্জেন্টিনার সমর্থকদের সমালোচনার তীর কোচ বাউজার উপর। কেননা তার খেলানো ভুল কৌশলেই আর্জেন্টিনা হেরেছে চিরপ্রতিদ্ব›দ্বী ব্রাজিলের কাছে। ৩-০ গোলের সেই হার আর্জেন্টাইনদের আজও মেনে নিতে কষ্ট হয়। কষ্ট হবেই না কেন! এদিন যে অনেকদিন পর আবারো জাতীয় দলের জার্সি গায়ে মাঠে নেমেছিলেন মেসি! ক্লাব সতীর্থ নেইমারের সঙ্গে একই বিমানে ব্রাজিলে এসে এমন তিক্ত পরাজয়ের স্বাদ পাবেন মেসি এটি বোধহয় তিনি নিজেও কল্পনা করেননি। অথচ ডিফেন্ডারদের ভুল এবং মিডফিল্ড নিয়ন্ত্রণ না নেওয়ার কারণেই ব্রাজিলিয়ানদের দেওয়া তিনটি গোল খেতে হয় আর্জেন্টিনাকে। এই হারে দক্ষিণ আমেরিকা অঞ্চলের বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের তালিকাতে ছয় নম্বরে নেমে যায় আর্জেন্টিনা। হাতে রয়েছে ৭ ম্যাচ। যেখানে প্রতিপক্ষ হিসেবে রয়েছে চিলি, উরুগুয়ে, কলম্বিয়া এবং ইকুয়েডরের মত লাতিন পরাশক্তিরা। আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ স্বপ্ন অনেকটা হাওয়ায় দোদুল্যমান। এর থেকেও বাজে অবস্থা ছিল ২০১০ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের সময়। একদম শেষ ম্যাচে পেরুর বিপক্ষে অন্তিম সময়ের গোলে বিশ্বকাপে সরাসরি খেলার টিকিট পেয়েছিল আর্জেন্টিনা। বৃষ্টির ভেতর কোচ দিয়েগো ম্যারাডোনার শুয়ে স্লিপ কাটার সেই দৃশ্য আজও আর্জেন্টাইন সমর্থকের চোখে উজ্জ্বল। সমর্থকদের মনে আবারো সেরকম কিছু ঘটার শঙ্কা জাগে। ব্রাজিলের পরেই প্রতিপক্ষ হিসেবে আরেক শক্তিশালি দল কলম্বিয়া। ব্রাজিলের সঙ্গে হারের পরেই কিছুটা টনক নড়ে কোচ বাউজার। ক্লাবে গোলের পর গোল করা আগুয়েরো এবং হিগুয়াইনকে বেঞ্চে বসিয়ে কলম্বিয়ার বিপক্ষে মাঠে নামান দেশের ক্লাবে খেলা প্রাতোকে। এদিন যেন নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার মিশনে নেমেছিলেন যাদুকর মেসি। দর্শনীয় এক ফ্রি কিক থেকে তো গোল করেছেনই সতীর্থদের দিয়ে করিয়েছেন দুই গোল। আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের শেষ ১৩টি গোলের ভেতর ১১টি গোলেই রয়েছে মেসির অবদান। ১২টি ম্যাচের ভেতর মেসিকে ছাড়া যেখানে আর্জেন্টিনা ৭টি ম্যাচের ভেতর জিততে পেরেছে মাত্র ১টি ম্যাচে সেখানে মেসি খেলেছেন এমন ৫টি ম্যাচের ৪টিই জিতেছে আর্জেন্টিনা। ৩-০ গোলের জয়ে পয়েন্ট তালিকার পঞ্চম স্থানেই উঠে আসে আর্জেন্টিনা। স্বস্তি নিয়ে মাঠ ছাড়ে মেসির দল। কিন্তু ম্যাচ শেষেই সেই স্বস্তি রূপান্তরিত হয় অভিনব এক বিদ্রোহে। সেই বিদ্রোহ আর্জেন্টিনার বেরসিক মিডিয়ার বিপক্ষে। বিশ্বকাপ এবং কোপা আমেরিকার ফাইনালে হারার পর থেকেই আর্জেন্টিনার সমালোচনা করতে পিছপা হয় আর্জেন্টাইন মিডিয়াগুলো। এই সমালোচনাকেও স্বাভাবিকভাবে নিয়েছিল মেসিরা। অথচ কলম্বিয়ার বিপক্ষে ম্যাচের আগে আর্জেন্টিনার অনুশীলনে লাভেজ্জির নিষিদ্ধ মারিজুয়ানা নেওয়ার খবর ঢালাওভাবে প্রচার করে মিডিয়া। আর সেটিকেই এক হাত নেন মেসি। মিথ্যে খবর প্রচারের জন্য সংবাদ সম্মেলন বয়কট করেন মেসিসহ আর্জেন্টিনা দলের অন্য সদস্যরা; কিন্তু আদতে কি এটাতে কোন কাজ হবে আর্জেন্টিনার? আর্জেন্টিনার কোচ দ্রুতই এই সমস্যা মিটিয়ে ফেলার তাগিদ দিলেও সংশয় যে থেকেই যাচ্ছে! সেটি আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপে খেলতে পারা না পারা নিয়ে। কেননা আর কয়েকটি ম্যাচ হারলেই আর্জেন্টিনাকে জলাঞ্জলি দিতে হবে বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন। পঞ্চম হয়ে প্লে-অফ খেলার সুযোগ থাকলেও দুইবারের বিশ্বকাপ জয়ীদের প্লে-অফ খেলে বিশ্বকাপে জায়গা করে নেওয়াটাও অনেকটা অপমানজনক। এই অপমানের হাত আর্জেন্টিনার সমর্থকদের বাঁচানোর কাজ একজনই করতে পারেন। সেটি আর কেউ নন, লিওনেল মেসি।জাগো চ্যাম্পিয়নের ১৬তম সংখ্যা পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে…আইএইচএস/পিআর
Advertisement