মাশরাফি আর সাকিব বলেছিলেন, তিনি বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রতিভাবান ক্রিকেটার। হাতের কারুকাজে ক্রিকেট বিশ্বে পরিচিতি পেয়েছেন কাটার মাস্টার। সাতক্ষীরার এক অজপাড়া গাঁ থেকে উঠে এসে ঠাঁই করে নিয়েছেন বিশ্বদরবারে। উদয়ের লগ্নে পৃথিবীকে জানান দিয়েছেন নিজের আগমনী বার্তা। তার বাঁ-হাতেই উড়ে গেছে ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকার মত পরাশক্তি। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ কিংবা আইপিএল- সব জায়গাতেই তার সমান আলোর বিচ্ছুরণ। মোস্তাফিজুর রহমান। অভিষেকে অনেকেই হইচই ফেলে দেন। স্বাভাবিকভাবেই হইচই ফেলেছিলেন তিনিও। তবে হারিয়ে যেতে যে আসেননি, সেটা বুঝিয়ে দিয়েছেন শুরুতেই। ভক্তরা শুধু তার বোলিং দেখতেই মাঠে উপস্থিত হন। কী স্টাইল আর কী লাইন-লেন্থ। নিখুঁত কারুকাজ। ব্যাটসম্যানের কাছে দুর্বোধ্য। আইপিএলে কলকাতা নাইটরাইডার্সের আন্দ্রে রাসেল যেভাবে তার বল বুঝতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন, তা যেন হয়ে থাকলো মোস্তাফিজের বোলিংয়ের উৎকৃষ্ট এক বিজ্ঞাপন। কিন্তু উদয়ের লগ্নেই যে তার সঙ্গী হয়ে গেলো ইনজুরি! অভিষেকের এক বছর যেতে না যেতেই ইনজুরির কবলে পড়ে গেলেন ২০ বছর বয়সী এই যুবা। ঢাকায় অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপ টি-টোয়েন্টিতেই পড়েছেন ইনজুরির কবলে। যার রেশ বয়ে বেড়িয়েছেন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। শেষ পর্যন্ত বিশ্বমঞ্চে খেলেছেন মাত্র ৩ ম্যাচ। তাতেই কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন প্রতিপক্ষের ভিত। আইপিএলে তরতর করে তার দাম উঠে গেলো কোটি টাকার ওপরে। সানরাইজার্স হায়দারাবাদের হয়ে নাম লেখালেন তিনি। যেখানে পেসারের ছড়াছড়ি; কিন্তু ক্লাব আস্থা রাখলো তার ওপর। অধিনায়ক ডেভিড ওয়ার্নারের ভরসার প্রতীক হয়ে গেলেন। পুরো ফ্রাঞ্চাইজির মধ্যমনিতে পরিণত হলেন তিনি। তার ভাষা বোঝার জন্য গুগল ট্রান্সলেটর ব্যবহার করে বাংলা শিখতে শুরু করে দিলেন হায়দারাবাদের ক্রিকেটার এবং কর্মকর্তারা। ডেভিড ওয়ার্নারকে বাংলায় পর্যন্ত টুইট করতে দেখা গেলো।ইনজুরিকে সঙ্গে নিয়ে সানরাইজার্সকে চ্যাম্পিয়নের ট্রফি উপহার দিলেন দ্য ফিজ। সেখান থেকে ইনজুরি সঙ্গী করেই ফিরলেন দেশে। এরই মাঝে যে পৃথিবীর সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী ঘরোয়া ক্রিকেট, কাউন্টির নজরে পড়ে গেলেন তিনি! সাসেক্স তাকে কিনে নিলো। ইনজুরির ধকল কাটানোর চেষ্টা করতে গিয়ে দু’মাস পূনর্বাসনে কাটালেন। অনেকেই বলেছিলেন, তাকে কাউন্টিতে পাঠানো ঠিক হবে না। বিসিবিও প্রথমে একই কথা ভেবেছিল; কিন্তু আগামী বছর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির কথা ভেবে, ইংলিশ কন্ডিশনের সঙ্গে পরিচিত করার জন্য শেষ পর্যন্ত তাকে পাঠানো হলো ইংল্যান্ডে। কাউন্টিতে খেলার জন্য। সাসেক্সের হয়ে মাঠে নামার পরই নিজেকে চিনিয়ে দিলেন মোস্তাফিজ। দুর্দান্ত বোলিং করলেন। পরের ম্যাচের জন্য প্রস্তুতি নিতে গিয়েই আবার পড়লেন ইনজুরিতে। এমনই এক ইনজুরি, যা তাকে দীর্ঘ সময়ের জন্য ঠেলে দিলো মাঠের বাইরে। ঘরের মাঠে আফগানিস্তান আর ইংল্যান্ড সিরিজ হয়ে গেলো, তিনি হয়ে রইলেন দর্শক। বিপিএল অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যথারীতি তিনি দর্শক। ঢাকা ডায়নাইমাটসের শুভেচ্ছাদূত হিসেবে তাদের ডাগআউটে বসে দর্শক হিসেবেই উপভোগ করছেন বিপিএলের খেলাগুলো; কিন্তু নিয়মিত ক্রিকেটার হয়েও পারছেন না ২২ গজে ঝড় তুলতে।বাম কাঁধের ইনজুরি এবং সেখানে অস্ত্রোপচার। গত ১১ আগস্ট লন্ডনে শল্যবিদ অ্যান্ড্রু ওয়ালেসের ছুরির নিচে যেতে হয় মোস্তাফিজকে। অস্ত্রোপচারের পর বিসিবির পক্ষ থেকে জানা গিয়েছিল, পাঁচ থেকে ছয় মাস সময় লাগতে পারে তার সম্পূর্ণ ফিট হয়ে উঠতে। তবে আশার কথা হলো, এত বেশি সময় কিন্তু তার লাগছে না। তারও আগে সম্পূর্ণ ফিট হয়ে উঠছেন কাটার মাস্টার। এই মাসেরই (নভেম্বর) শেষদিকে কিংবা ডিসেম্বরের শুরুর দিকে মোস্তাফিজ পুরোপুরি ফিট হয়ে উঠবেন বলে জানিয়ে দিয়েছেন বিসিবির চিকিৎসক দেবাশীষ চৌধুরী। মোস্তাফিজের ফিট হয়ে উঠবেন, এই আশায় ইতিমধ্যে তাকে রাখা হয়েছে নিউজিল্যান্ড সফরের ২২ সদস্যের দলে। কিউই পেস কন্ডিশনে মোস্তাফিজের বড়ই প্রয়োজন। সে লক্ষ্যে বিসিবিও চেষ্টার ত্রুটি রাখতে নারাজ। ফিজিও বায়েজেদুল ইসলামের অধীনে নিয়মিতই চলছে তার ফিটনেস ট্রেনিং। ইতিমধ্যে শুরু করেছেন হাত ঘোরানো। কাঁধের কী অবস্থা তা দেখার জন্য অ্যাপোলো হসপিটালে এমআরআই করানো হয়েছে। চিকিৎসক দেবাশীষ চৌধুরী জানিয়েছেন, সবই ভালো এবং ঠিক-ঠাক চলছে। দ্রুতই সুস্থ হয়ে উঠতে পারবেন তিনি। এরই মধ্যে ছুটি নিয়ে মোস্তাফিজ গেলেন গ্রামের বাড়ি। সেখানে পাঁচ দিন ছুটি কাটিয়ে ফিরেছেন ঢাকায়। গত মঙ্গলবার মিরপুরের জিমে ট্রেনারের সঙ্গে কাজ করেছেন। বুধবার থেকে শুরু করেছেন বোলিং অনুশীলন। ৬০ শতাংশ ইনটেনসিটিতে নেটে বোলিং করবেন চার ওভার। ট্রেনারের সঙ্গে থাকবেন বাংলাদেশ দলের নতুন ফিজিও ডিন কনওয়ে।এর আগে মোস্তাফিজ কাজ করেছেন বোলিং কোচ কোর্টনি ওয়ালশের অধীনে। ৫০ ভাগ ইনটেনসিটিতে ছোট রানআপে বোলিং করেন তিনি। মোস্তাফিজের শেষ ধাপের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া নিয়ে গত মঙ্গলবার মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলেছেন দেবাশীষ চৌধুরী, ‘ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার আগে মোস্তাফিজের কাঁধের যে রুটিন স্ক্যান করা হয়েছিল সেই রিপোর্ট ছিল বেশ সন্তোষজনক। অস্ত্রোপচারের পর থেকে এখন পর্যন্ত উন্নতি সন্তোষজনক পর্যায়ে আছে। আজ থেকে আবার রিহ্যাব (পুনর্বাসন) প্রোগ্রাম শুরু হয়েছে। প্রথম দিনে বোলিং অনুশীলনে যায়নি। প্রথম দিনটা ট্রেনারের সঙ্গে জিম সেশন করেছে। আগামীকাল (গত বুধবার) ট্রেনার এবং বাংলাদেশ দলের যে নতুন ফিজিও আছেন তার তত্ত¡াবধানে বোলিং সেশন শুরু করবে সে।’ওই সময় পুরো প্রক্রিয়া নিয়ে দেবাশীষ চৌধুরী আরও জানান, ‘আগামীকালের (বুধবার) যে প্ল্যান তাতে ৬০ শতাংশ ইনটেনসিটিতে চার ওভার বোলিং করবে। এভাবে প্রতিদিনই ইনটেনসিটি বাড়াতে থাকবে। কোনো ধরণের সমস্যা দেখা না দিলে প্রতিদিনই অল্প অল্প বাড়াবে। আশা করা যায়, এভাবে চলতে থাকলে এ মাসের শেষে বা সামনের মাসের শুরুর দিকে সে পুরো ফিটনেস ফিরে পাবে। সর্বোচ্চ দুই সপ্তাহ লাগতে পারে।’ তাহলে তো নিউজিল্যান্ড সফরে খেলতে পারবেন মোস্তাফিজ? দেবাশীষ চৌধুরী এ বিষয়ে কিছু বলতে নারাজ। তিনি শুধু জানিয়েছেন, ফিটনেসের জন্য ম্যাচ খেলতে হবে তাকে। নিউজিল্যান্ড সফরে খেলানো যাবে কি না সেটি নির্ভর করবে টিম ম্যানেজমেন্টের উপর। ম্যাচ না খেললে তো আসলে ফিটনেস পাওয়া যাবে না। মোস্তাফিজ ফিরে পাবে ওর গতি ও অ্যাকুরেসি। শারীরিক সক্ষমতা ফিরে পাবে; কিন্তু ম্যাচ সিচুয়েশনে কেমন করছে সেটা ম্যাচ খেললেই বোঝা যাবে। আমাদের কাজ হচ্ছে ম্যাচের জন্য ফিট করে টিম ম্যানেজেমেন্টের কাছে ওকে হস্তান্তর করা। তখন ম্যানেজমেন্ট সিদ্ধান্ত নেবে ওকে কখন, কিভাবে ব্যবহার করবে।’মোস্তাফিজের জন্য আপাতত সে পর্যন্ত অপেক্ষা।জাগো চ্যাম্পিয়নের ১৬তম সংখ্যা পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে…আইএইচএস/পিআর
Advertisement