মতামত

নারী পুরুষের নিচে?

অনেকেই ভাবেন ‘অসমান’ শব্দের সমার্থক ‘আলাদা’। কেউ কেউ ভাবেন ‘আলাদা’ শব্দের সমার্থক ‘অসমান’। দুটো একই বিষয়, তবে ভাবগত আলাদা অর্থ নিশ্চয়ই আছে। তো ধরে নিলাম সমার্থক, এখন প্রশ্ন আসছে ডাক্তার এবং ইঞ্জিনিয়ার দুটো আলাদা পেশা। বলুন তো কোন পেশা বড়? ডাক্তার আপনার আমার নাড়ি দেখে কাগজে ওষুধের নাম লিখে দেন, প্রয়োজনে শরীর কাঁটাছেঁড়া করে আপনার আমার শারীরিক সুস্থতা নিশ্চিত করেন। আর ইঞ্জিনিয়ারের আপনার বাড়ির সব প্রযুক্তির পেছনে অবদান। তাদের জন্যই আজকে আপনি সুইচ টিপলে আলো জ্বলে, এক সুইচে খাবার গরম হয়, ঠাণ্ডা হয়, ঘর গরম বা ঠাণ্ডা হয়। দুটো পেশাকেই কিন্তু গুরুত্ব দিতে হবে। আপনি বলতে পারেন না ডাক্তার সবসময় উপরের বা বলতে পারেন না ইঞ্জিনিয়ারই উপরের সারির পেশা।তাহলে কীভাবে বলেন পুরুষ নারীর প্রভু? নারীর স্থান সবসময় পুরুষের নিচে? নারী-পুরুষ উভয়ই মানুষ, একে অপরের পরিপূরক।  নারীর আলাদা শারীরিক বৈশিষ্ট্য, পুরুষের আলাদা। এই আলাদা বৈশিষ্ট্যের কারণে স্বাভাবিকভাবেই নারীর শরীরের কার্যপদ্ধতি আলাদা। পুরুষের শরীর যা করতে পারে, নারী তা করতে পারে না আবার নারী যা যা করতে পারে পুরুষ তা করতে পারে না। কিন্তু এর সঙ্গে কেউ প্রভু আর কেউ প্রজা- এমন কথা বলার তো প্রশ্নই আসে না। তার পরেও শুনতে হয় নারীরা একা চলতে পারে না, চলতে দেয়া উচিত নয়। তাদের প্রকৃতিই আরেকজনের সঙ্গে চলার জন্য তৈরি করেছেন। নারীদের ঘরের বাইরে কিছু করতে দেয়া উচিত নয়, তাতে তারা স্বভাবে বেয়াড়া হয়ে যান। নারীরা দুর্বল, কাজেই পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দেয়া তাদের উচিত নয়। কেন দুর্বল এই প্রশ্নের উত্তর ভয়াবহ বিরক্তিকর। পুরুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে তরল নিষ্কাষণ করতে পারেন, নারীরা কেন পারেন না? এর উত্তরে নিশ্চয়ই বলা যায়, নারীরা গর্ভধারণ করতে পারেন; পুরুষরা কেন করতে পারেন না? কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে পুরুষের অপারগতাকেও সমাজ এবং পুরুষ দুয়ে মিলে গর্বের কারণ বানিয়ে ফেলেছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে রাস্তা নোংরা করার ব্যাপারে যেমন তারা গর্ব করেন, গর্ভধারণ করতে না পারার ব্যাপারেও তারা একইরকম গর্বিত! তার মানে নারীকে তারা ঠিক কতখানি ছোট, অপারগ মনে করলে তার সব যোগ্যতাকে অস্বীকার করে তাকে দুর্বল ও নীচুস্তরে নামিয়ে এনে দ্বিতীয় লিঙ্গের মর্যাদা দিতে পারেন- সেটা বলাই বাহুল্য!অনেকেই বলেন, ছেলেদের শরীরে শক্তি বেশি, তাই তারা মানুষের স্ট্যান্ডার্ডে এগিয়ে থাকবেন- সেটাই স্বাভাবিক। এখানে আরেকটা বিষয় মনে রাখা ভালো, মাতৃতান্ত্রিক কয়েকটা উপজাতি রয়েছে, যাদের নারীরা বাইরে কাজ করেন আর পুরুষেরা ঘরে কাজ করেন। তাদের নারীরা মাটি কাটেন, বড় বড় বস্তা মাথায় তুলতে পারেন, ইটের ভাটায় কাজ করেন। এই শহরের শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত বড় বড় ঘরে বসে থাকা সাহেবদের যদি তাদের কাজ করতে দেয়া হয়, তাহলেই টের পাওয়া যাবে গায়ের জোর কার কতখানি।  বা সবকিছু বাদ দিলাম। ভারোত্তলনে স্বর্ণ জেতা মেয়েটা যতখানি শক্তি-সামর্থ্যের অধিকারী, তার সঙ্গে পুরুষের পাল্লা দিয়ে আসলে কী লাভ? তারও পরের কথা, অধিকারের প্রসঙ্গে কার গায়ে কতো শক্তি তা নির্ণয়ে কী লাভ হয়? পুরুষের গায়ে শক্তি বেশি বলে গায়ের জোরে সবকিছু দখল করা তো সভ্যতার অংশ হতে পারে না। নারী হবে নিয়ন্ত্রিত আর পুরুষ নিয়ন্ত্রক এমন সমাজ দিয়ে কতখানি, কী উদ্ধার হতে পারে- তাও আমার জানা নেই। যারা অন্যকে ছোট করে দেখে, নিজের সমান ভাবতে পারেন না, তারা মানুষকে কি আদৌ সম্মান করতে পারেন? সম্মান করতে পারেন না বলেই ‘ভিক্টিম ব্লেমিং’ সংস্কৃতির মানসিকতা দিনদিন বেড়ে চলেছে। কেউ কম, কেউ বেশি কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই সবকিছুতে নারীর দোষ খুঁজে বেড়ান। আর ভাবেন নারীরা দুর্বল, এরচেয়ে বেশি কিছু করার ক্ষমতা তাদের নেই। ক্ষমতা যদি না থাকে তবে সেই অক্ষমতাকে প্রশ্রয় না দিয়ে সক্ষমতা তৈরি করলেই তো সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। যে আপনি কন্যাসন্তান জন্ম দেয়ার অপরাধে কন্যার মায়ের দিকে চোখ তুলে তাকান না, সেই আপনিই যে কিছুক্ষণ আগে হন্যে হয়ে নারী ডাক্তার খুঁজে এসেছেন- সেটা ভুলে গেলে চলবে কী করে? নারীর জন্ম না হলে, নারীকে দুর্বল বলে পড়াশোনার সুযোগ না দিলে নারী ডাক্তার তো আর আকাশ ফুঁড়ে আবির্ভূত হবেন না। সর্বোপরি, নারীদের শারীরির-মানসিক গঠন আলাদা বলে যে নারীকে ছোট বলে চলেছেন, সে নারীই যে আপনাকে নিজের নাড়ির সঙ্গে বেঁধে শরীরে ভেতর বড় করেছেন- তাকে অস্বীকার করলে আপনার জন্ম মিথ্যে হয়ে যায়, সেকথা কেন ভাবেন না? লেখক : সাংবাদিক।এইচআর/এনএইচ/পিআর

Advertisement