মতামত

পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের পাওনা

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিশ্বের নবীনতম একটি দেশ;  বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশও। ২৫ মার্চ কালরাত্রির পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞের পর বিশ্বব্যাংকের একটি বিশেষজ্ঞ দল কয়েকটি শহর পরিদর্শন শেষে মন্তব্য করেছিল, এগুলো দেখতে ‘পারমাণবিক হামলার পরের একটি সকালের মতোই।’ এরপর থেকে ধ্বংসযজ্ঞ আরো তীব্র হয়েছে। প্রায় ৬০ লাখ বাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে। ১৪ লাখ কৃষক পরিবার চাষবাসের হালহাতিয়ার ও পশু হারিয়েছে। পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেতু বিধ্বস্ত এবং অভ্যন্তরীণ জলপথ অবরুদ্ধ হয়েছে।পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের আগ পর্যন্ত দেশটির ধ্বংসযজ্ঞ শুধুই বেড়েছে। যুদ্ধের শেষ দিনগুলোতে পশ্চিম পাকিস্তানি ব্যবসায়ীরা (যারা ছিল দেশের প্রায় সব ব্যবসার মালিক) তাদের সর্বশেষ কড়িটিও পশ্চিমে নিয়ে যায়। পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স বন্দরনগরী চট্টগ্রামে তাদের অ্যাকাউন্টে মাত্র ১১৭ টাকা রেখে যায়। সেনাবাহিনী ব্যাংক নোট ও ধাতব মুদ্রা ধ্বংস করে যাওয়ায় অনেক জায়গায় নগদ অর্থের সংকট দেখা দিয়েছিল। বন্দর বন্ধ করে দেওয়ার আগে রাস্তা থেকে প্রাইভেটকার তুলে নয়তো ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কেড়ে পাকিস্তানে  চালান করে দেওয়া হয়। সেই পাকিস্তান এখন নির্লজ্জের মতো বলেছে, বাংলাদেশের কাছে তারা ৭০০ কোটি পাবে!   বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও পাকিস্তানিরা কখনও ষড়যন্ত্র বন্ধ করেনি। ভুট্টো তখনো বলে চলেছেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের ভূখণ্ড।’ এরূপ এক প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘এরূপ দাবিতে তারা যদি অনড় থাকে, তাহলে জাতীয় সংসদের সভা ডেকে আমি ঘোষণা করতে পারি, যেহেতু আমি সংখ্যাগরিষ্ঠ- তাই গোটা দেশের নাম হবে বাংলাদেশ। পশ্চিম পাকিস্তানও হবে আমার এলাকা। আমি ভুট্টোকে বিদায় নিয়ে বলতে পারি পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তানের গভর্নর আমি নিয়োগ করছি। আমি তাকে বলতে পারি, এটা আমার ভূখণ্ড এবং আপনি বিদায় হোন, নতুবা মিত্রবাহিনীসহ আমি আমার সৈন্য পাঠাবো ও পশ্চিম পাকিস্তান দখল করবো।’ সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক ১৯৬৯ সালে যুক্তরাজ্যে সফরের সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে সৈয়দ হক ছয়দফা সহজ করে বুঝিয়ে দিতে বলেছিলেন। বঙ্গবন্ধু তিন আঙুল দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘আমার আসলে তিন দফা। কত নিছো, কবে দেবা, কবে যাবা।’ পাকিস্তানের কাছে আমাদের অনেক পাওনা। অথচ এ কথা কাউকে বলতে শুনি না।  সেই সময়ের এক হিসাব অনুযায়ী যুদ্ধের অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি ২১ থেকে ২৩ বিলিয়ন ডলার বলে ধারণা করা হয়েছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে দাতাদের অব্যাহত চাপের ফলে বাংলাদেশ পাকিস্তানের ঋণের এক অংশের দায় মেনে নিতে বাধ্য হয়।  অধ্যাপক নুরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর সময়ে জাতীয় পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান ছিলেন । তিনি ‘বাংলাদেশ জাতি গঠনকালে এক অর্থনীতিবিদের কথা’ নামে এক অসাধারণ বই লিখেছেন। স্পষ্ট বোঝা যায়, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কাছে পাওনা আদায়ের  ব্যাপারে  ভীষণরকমের সোচ্চার ছিলেন। সর্বশেষ  ১৯৭৪ সালে নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছিল- কীভাবে পাকিস্তান আমাদের পাওনা পরিশোধ করবে। পাকিস্তান এটা মোটেই ভালোভাবে নেয়নি। যে কারণে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছিল।   (ক) পাকিস্তান নীতিগতভাবে সব সম্পদ ও দায় সমানভাবে ভাগ করে নেবে, (খ) একটি যৌথ কমিশন এ বিষয়ে বিস্তারিত পরীক্ষা করে দেখবে, এবং (গ) পাকিস্তান দুই মাসের মধ্যে কিছু অর্থ তার সদিচ্ছার প্রতীক হিসেবে বাংলাদেশকে প্রদানের উদ্যোগ নেবে। প্রথম কিস্তিতে সহজে হিসাবযোগ্য সম্পদ দিয়ে পরিশোধ করা হবে, যেমন, স্বর্ণ ও বৈদেশিক মুদ্রা, বেসামরিক বিমান ও জাহাজ। এই প্রতীকী অর্থ প্রদানের পরিমাণ ২০০ থেকে ৩০০ মিলিয়ন ডলার ধার্য করা হয়। এটি ছিল সমগ্র পরিশোধ ও বণ্টনযোগ্য সম্পদের একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। তাছাড়া অন্যদিকে বাংলাদেশ এরই মধ্যে পাকিস্তানের বৈদেশিক দায় ভাগ করে নিয়েছিল। ১৯৭৫ সালে কমনওয়েলথ রাষ্ট্রের প্রধানদের কনফারেন্সেও তিনি এই ইস্যু উত্থাপন করেন। এমনকি ১৯৭৫-এর জুলাই মাসে ইসলামি পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলনেও প্রসঙ্গটি আলোচিত হয়।বাংলাদেশ এ বিষয়ে আগাম আশ্বাস দিয়ে রাখতে রাজি, সে মধ্যস্থতাকারীর প্রস্তাব মেনে নেবে। বাংলাদেশ এর আগেও পাকিস্তানের নিকট-বন্ধু আরব আমিরাতের নাম মধ্যস্থতাকারী হিসেবে প্রস্তাব করে। কিন্তু পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা সম্মেলনে এ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনায় রাজি ছিলেন না। বাংলাদেশের উদাত্ত আহ্বানে তারা সাড়া দেননি। ইসলামাবাদ ফিরে গিয়ে পাকিস্তান সরকার এ বিষয়ে উত্তর জানাবে বলে আশ্বাস দেয়। সেই উত্তর কখনোই আসেনি। পাকিস্তান বুঝে গিয়েছিল শেখ মুজিব বেঁচে থাকলে পাওনা টাকা আদায় করে ছাড়বে। অধ্যাপক নুরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘১৯৭৫-এর আগস্ট মাসে বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসে। ক্ষমতা দখলের সঙ্গে সঙ্গেই অভ্যুত্থানকারী সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে। অনিষ্পন্ন বিষয়গুলোর সুরাহা না করেই ওই পদক্ষেপ নেয়া হয়।’ এজন্য বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের আগে ও পরে পাকিস্তান দূতাবাস নানাভাবে সক্রিয় ছিল। এখনও অনেকের ঘাড়ে পাকিস্তানি ভূত চেপে বসে আছে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিকদের দায়িত্ব- এদের শিকড় উপড়ে ফেলার। লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক।এইচআর/এনএইচ/এমএস

Advertisement