খেলাধুলা

কেন পারছে না মাশরাফির কুমিল্লা?

সাদা-মাটা একটি দল। বিপিএলের তৃতীয় আসরে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সকে কেউ গোনায়ও ধরার সাহস পায়নি। তবুও সবাই আলাদা একটা চোখ রেখেছিল কুমিল্লার ওপর। কারণটা আর কিছুই নয়, মাশরাফি। বিপিএলের আগের দুই আসরে ঢাকাকে চ্যাম্পিয়ন করিয়েছেন। তার জাদুকরী নেতৃত্বে সাধারণ মানের একটি দলও হয়ে উঠতে পারে দুর্দান্ত। পরের ইতিহাস সবারই জানা। মাশরাফি সত্যি পেরেছিলেন। কুমিল্লাকে শিরোপা উপহার দিয়েই ছাড়েন তিনি।গত আসরের প্রায় অনেকেই এবারের দলটিতে রয়েছে। মাশরাফি নিজে। ইমরুল কায়েস, লিটন দাস, আসহার জাইদি, মারলন স্যামুয়েলস- অনেকেই। কুমিল্লার ফ্রাঞ্চাইজি ভেবেছিল মাশরাফির হাত ধরে এবারও বুঝি চ্যাম্পিয়নের মুকুট পরবেন তারা।কিন্তু সবার আশার গুড়ে বালি। বিপিএলের চতুর্থ আসরে এখনও পর্যন্ত ৫টি ম্যাচ খেলে একটি জয়ও নেই। একের পর এক হার- কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সকে পরিণত করেছে একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দলে। সর্বশেষ রংপুর রাইডার্সের কাছে ৯ উইকেটের বিশাল পরাজয়ের পর সংবাদ সম্মেলনেই নিজ দলের ব্যাটসম্যানদের ওপর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন মাশরাফি। জানিয়েছেন, কৈফিয়ত চাইবেন তিনি।বিপিএলের প্রথমদিনের ম্যাচগুলো ছিল লো স্কোরিং। স্লো উইকেটে লো স্কোর করেও জয়ের সম্ভাবনা ছিল; কিন্তু টি-টোয়েন্টির বিনোদন বাড়াতে উইকেটগুলো যখন ফ্লাট করে ফেলা হলো এবং রানের ফোয়ারা বইতে শুরু করে দিল, তখন আর বিপিএল লো স্কোরিং থাকলো না। ১৯০ প্লাস এখন অনায়াসেই হয়ে যাচ্ছে।সে জায়গায় কোনো দল হাতে উইকেট ধরে রেখেও যদি মাত্র ১২২ রান করে, তখন তাদের জয় পাওয়ার যে কোন সম্ভাবনাই নেই- সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। রংপুর রাইাডার্সের বিপক্ষে টস হেরে ব্যাট করতে নেমে আহমেদ শেহজাদ আর মারলন স্যামুয়েলস- দু’জনই করলেন হাফ সেঞ্চুরি। অথচ, ইনিংস শেষে দেখা গেলো কুমিল্লার স্কোরবোর্ডে রান মাত্র ১২২।এই স্কোর তো টি-টোয়েন্টির এই যুগে এক ফুৎকারেই উড়ে যায়। রংপুরও তাই করলো, এক উইকেট হারিয়ে, ৩ ওভার হাতে রেখে জয় তুলে নিলো বিশাল ব্যবধানে। একই সঙ্গে মাশরাফিদের আরও একবার ডোবালো লজ্জায় ডুবিয়ে ছাড়লো।টানা ৫টি হারের পর ক্রিকেট পাড়ায় চারদিকে গুঞ্জন, কেন একের পর এক হেরে চলেছে কুমিল্লা? কেন তারা পারছে না? কী সমস্যা এই দলটির মধ্যে? মাশরাফির সঙ্গে ফ্রাঞ্চাইজির যে দ্বন্দ্ব, সেটা কী এখনও জিইয়ে রয়েছে? দলের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব কী তবে এখনও কমেনি?এমন নানা গুঞ্জন আর নানা কথা-বার্তা ভেসে বেড়াচ্ছে ক্রিকেটের আকাশে। বর্তমান চ্যাম্পিয়নরা কী শেষ চারে যেতে পারবে!- তৈরি হয়েছে এমন গুঞ্জনও।ফ্রাঞ্চাইজির সঙ্গে মাশরাফির সম্পর্ক শুরুতে ভালোই ছিল; কিন্তু একের পর এক যখন দল হারতে শুরু করেছে তখনই তৈরি হয়েছে দুরত্ব। মনোমালিন্য। যদি প্রথম থেকে জয় পেতো বর্তমান চ্যাম্পিয়নরা, তাহলে সেই সম্পর্ক হয়ে উঠতো আরও মধুর, আরও সুন্দর।এখানে জয়-পরাজয়ই মূল কথা; কিন্তু কেন জয় পাচ্ছে না কুমিল্লা? সে কারণটাই আসুন খোঁজা যাক।ৎসহজ কথায় বললেন, কুমিল্লার অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা যাদের ওপর আস্থা রেখে দল সাজিয়েছেন, তারা ক্রমাগত ব্যর্থতার ঘানি টানছেন। মূলতঃ সে কারণেই মাঠে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের পারফরম্যান্স বেশ খারাপ। ঢাকায় ঢাকা ডায়নাইমটসের বিপক্ষে শেষ ম্যাচে অধিনায়ক মাশরাফির ব্যাটে (৩৫ বলে ৪৭) ভর করে প্রথমবার ১৬০-এর ( ১৬১) ঘরে পৌঁছায় কুমিল্লা। অথচ তার আগে-পরের চার ম্যাচে ১৪০ রানও করা সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ তো করেছে ১২২ রান।আসুন এক নজরে কুমিল্লার পাঁচ ম্যাচের স্কোরলাইন দেখা যাক; প্রথম ম্যাচে চিটাগাং কিংসের কাছে ২৯ রানে হার। ১৬১ রানের জবাবে ১৩১-এ গিয়ে আটকে থাকলো তারা। দ্বিতীয় ম্যাচে বরিশাল বুলসের বিপক্ষে ১২৯ রান করে ৬ উইকেটে হার। তৃতীয় ম্যাচে খুলনা টাইটান্সকে ১৪৪ রানে আটকে রেখেও ১৩ রানে পরাজয়। আবারো ১৩১-এ গিয়ে থেমে গেলেন তিনি। আর ঢাকায় শেষ ম্যাচে ডায়নামাইটসের করা ১৯৪ রানের জবাবে ১৬১ রানে ইনিংস শেষ করে ৩৩ রানে হার। সর্বশেষ চট্টগ্রামে রংপুরের বিপক্ষে ১২২ রান করে হারলো ৯ উইকেটের বিশাল ব্যবধানে।ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সেও পুরোপুরি পিছিয়ে কুমিল্লার ক্রিকেটাররা। ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের যোগফলই দলগত পারফরম্যান্স। এ ক্ষেত্রে কুমিল্লার অবস্থা আরো জীর্ণ-শীর্ণ। একজন পারফরমারও নেই যার ব্যাট ধারাবাহিকভাবে কথা বলেছে। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের দৈর্ঘ্য এত ছোট যে, প্রথম তিন-চার ব্যাটসম্যানের অন্তত এক বা দুজনর ভালো না খেললে কিংবা দীর্ঘ ইনিংস সাজাতে না পারলে স্কোরলাইন বড় করা সম্ভব নয়। কুমিল্লার একজন টপঅর্ডারও পারেনি সে অর্থে ওই কাজ করে দিতে পারেননি।একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়, এবারের বিপিএলে এখন পর্যন্ত সেই দল ভালো করেছে, যাদের ফ্রন্টলাইন ব্যাটিং বেশি ক্লিক করেছে। সবার ওপরে থাকা বরিশাল বুলসের কথাই ধরা যাক। দলটির তিন টপ অর্ডার নিয়মিত ভালো খেলছেন। রানও করছেন। বাঁ-হাতি শাহরিয়ার নাফীস ও অধিনায়ক মুশফিকুর রহীম রান তোলায় সবার ওপরে। রংপুরের মোহাম্মদ শাহজাদ, মোহাম্মদ মিথুনরা রয়েছেন দারুণ ফর্মে। ঢাকার সাঙ্গাকারা, নাসির হোসেন, মেহেদী মারুফ কিংবা মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত, বরিশালের ডেভিড মালান, রাজশাহীর সাব্বির রহমান, চিটাগাংয়ের তামিম ইকবালরা ইনিংসকে বড় করতে বেশ ভুমিকা রাখছেন।আর সেখানে কুমিল্লার চার টপঅর্ডারের অবস্থা দেখুন। ওপেনার ইমরুল কায়েস পাঁচ ম্যাচে ( ৬+০+২১+১৯+৫)= ৫১, লিটন দাস চার খেলায় (১৩+৪+৮+৪)= ২৯। ঢাকার বিপক্ষে ড্রপ হয়ে রংপুরের বিপক্ষে ফেরা মারলন স্যামুয়েলস চার খেলায় (২৩+৪৮+৩০+৫২)= ১৫৩ এবং তরুণ নাজমুল হোসেন শান্ত পাঁচ ম্যাচে (৫৪*+১৬+১০+১৬+৫)= ১০১। এখানেই আসলে অন্য দলগুলোর সঙ্গে পার্থক্য গড়ে উঠেছে কুমিল্লার।রংপুরের বিপক্ষে ম্যাচের আগ পর্যন্ত কুমিল্লার প্রথম তিনজনের কেউ পঞ্চাশের ঘরে যেতে পারেননি। রংপুরের বিপক্ষে এসে আহমেদ শেহজাদ হাফ সেঞ্চুরি করেন। তবে, সেটা ছিল ৪৫ বল খরচায়। একই দিন হাফ সেঞ্চুরি করেন মারলন স্যামুয়েলসনও। সেটাও ৪৬ বল খরচায়। এক কথায় বলা যায়, টেস্ট স্টাইলের ব্যাটিং।গত ম্যাচের আগে একমাত্র ফিফটি (চিটাগাং কিংসের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে (৫৪*) করেছেন প্রথমবার খেলা নাজমুল হোসেন শান্ত। শুরুর দিকে কেউ রান করতে পারছেন না। লম্বা ইনিংস সাজানোর প্রশ্নই ওঠে না। আর মাঝে হাল ধরার সে অর্থে বড় কোনো পারফরমারও নেই। এখানে বড় মার খেয়েছে কুমিল্লা। আগেরবার পাঁচ-ছয় নম্বরে আসহার জাইদি দারুণ সার্ভিস দিয়েছেন। এবার তিনি অনুজ্জ্বল। অকার্যকরও বটে। তার জ্বলে না ওঠা দলের ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।বোলিংয়েও একেবারে অনুজ্জ্বল পারফরম্যান্স কুমিল্লার। এই দলের হয়ে ৩ ম্যাচে সর্বোচ্চ ৪ উইকেট নিয়েছেন আফগান লেগ স্পিনার রশিদ খান। ৫ ম্যাচ খেলে ৪ উইকেট নিয়েছেন মাশরাফি বিন মর্তুজা। সোহেল তানভিরও নিয়েছেন ৪টি। টি-টোয়েন্টি যতই ব্যাটসম্যানদের খেলা হোক, বোলাররা যদি ব্রেক থ্রু এনে দিতে না পারেন, খুব প্রয়োজনীয় সময়ে যদি উইকেট না আসে তাহলে তো জয় একটি দলের জন্য সুদুর পরাহত। কুমিল্লার ক্ষেত্রে ঘটছে মূলত সেটাই। মূলতঃ দল হিসেবে কুমিল্লার প্রায় সবাই নিজেদের কাজের ক্ষেত্রে ব্যর্থ। কেউই পারছে না মাঠে প্রভাব বিস্তার করতে। ব্যাটিং-বোলিং এমনকি ফিল্ডিং- কোন ক্ষেত্রেই পারছে না কুমিল্লার ক্রিকেটাররা। পারফরম্যান্স করতে না পারলে অধিনায়ক মাশরাফির করার কিছুই নেই। তিনি কোন জাদুমন্ত্র দিয়ে পারফরম্যান্স বের করে আনতে পারবেন না। আইএইচএস/এমএস

Advertisement