মতামত

বিদ্বেষ আর হিংসার চর্চা

মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আইয়ুব খান, বাষট্টি বছর বয়সে বিষপান করে আত্মহত্যা করেছিলেন। ঘটনাটি গত বছরের। মৃত্যুর আগে আইয়ুব খান ঢাকার জেলা প্রশাসকের বরাবরে চার পৃষ্ঠার একটি চিঠি লিখেছিলেন। তাতে তিনি লিখেন, মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এ হান্নান তাঁকে বাসা থেকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছেন। এই অপমান সইতে না পেরে তিনি আত্মহত্যা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার ক্ষমতায়। কিছু কি হয়েছিল সেই সচিবের? কিছু কি হওয়ার কথা? মুক্তিযোদ্ধা আইয়ুব খান মরে বেঁচেছেন। না হয় তাকে দেখতে হতো ঝিনাইদহের শৈলকূপায় আওয়ামী লীগের লোকজন কি করে পিটিয়ে শায়েস্তা করে প্রৌঢ় মুক্তিযোদ্ধা মোক্তার আহমেদ মিজানকে। এই ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে, একটি দোকানের সামনে চেয়ারে বসে আছেন সেই প্রৌঢ় মুক্তিযোদ্ধা। হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই, তাকে এসে নির্বিচারে পেটাতে শুরু করল একদল যুবক। তাদের হাতে লাঠি, স্টিলের রড। অন্তত তিনজন পেটাচ্ছিল। দলে তারা আরো কয়েকজন।একজন এগিয়ে এসে আরেকজনের হাত থেকে লাঠি কেড়ে নিয়ে আবার পেটাতে শুরু করলেন। দৃশ্যটি ধরা পড়েছে সেই দোকানের ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরায়।পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনে রিপোর্ট হয়েছে। কিন্তু কিছুই হয়নি আক্রমণকারীদের। পুলিশ মামলা নিতেই গড়িমসি করেছে। অবশেষে নিয়েছে ছয়দিন পর। এখন পর্যন্ত একটিই খবর পাওয়া গেলো যে, প্রধানমন্ত্রী তার চিকিৎসার দায়িত্ব নিচ্ছেন। কিন্তু দলের যে নেতা আর অনুসারীরা এমন একটি ঘটনা ঘটালো তাদের কোন শাস্তির ব্যবস্থা নেই, তারা দিব্বি ঘুরে বেড়ায়। হয়তো তারা আরো নতুন শিকারি খুঁজে কার উপর হামলে পড়া যাবে। এই ঘটনা মিইয়ে যেতে না যেতেই খবর এলো ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার আমতলা বাজারে আবদুস ছালাম খান (৬২) নামে এক মুক্তিযোদ্ধাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এখানেও অভিযুক্তরা সরকারি দলের সাথে সংশ্লিষ্ট। মামলায় স্থানীয় ইউপি সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান বাচ্চু ও শাহ আলমকে মূল আসামি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তারা দু’জনই যুবলীগ নেতা।নাসিরনগরে হিন্দুদের উপর দফায় দফায় হামলা হচ্ছে, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের বাড়িঘর পুড়িয়ে, হত্যা করে তাদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। কোন প্রতিকার নেই। এমন করে প্রায় প্রতিদিন হয় মুক্তিযোদ্ধাকে অপমান বা হত্যা করা হয়, প্রতিদিন খুন হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। মাত্র ক’দিন আগে শেষ হলো আওয়ামী লীগের কাউন্সিল। নতুন সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দলীয় ঐক্য, সংহতি আর শৃঙ্খলা নিয়ে অনেক হুংকারই প্রতিদিন দিচ্ছেন। কিন্তু এতে কোন কাজ হচ্ছে বলে মনে হয় না। সেতুমন্ত্রী সাধারণ সম্পাদকের হুমকির মধ্যেই জানা গেলো মাদারীপুরে নবীনবরণ অনুষ্ঠানে দাওয়াত না দেয়ার অজুহাতে সরকারি নাজিমউদ্দিন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অধ্যক্ষ হিতেন চন্দ্র মণ্ডলের ওপর হামলা এবং অধ্যক্ষ ও উপাধক্ষ্যের কক্ষ ভাঙচুর করেছে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। কাউন্সিলের পর থেকেই কেমন যেন এক উত্তাল অবস্থা সরকারি দলের নানা স্তরে। রাজনীতিতে যোগ দিয়ে যেন মানুষ শিখে বিদ্বেষ আর হিংসার চর্চা। চেতনা বা আদর্শ যাই বলা হোক না কেন, পেশাদার রাজনীতি মানেই এখন ক্ষমতা আর লোভের গল্প। বাংলাদেশের রাজনীতির অন্তহীন দুর্নীতি আর ক্রমবর্ধমান অন্যায়প্রবণতার সঙ্গে এক নতুন প্রথা যোগ হয়েছে। আগে ক্ষমতাসীন দলের আক্রমণের লক্ষ্য ছিল বিরোধী দল, এখন নিজেরাই নিজেদের দলের যত সর্বনাশ করা যায় করছে। মুক্তচিন্তার গতিকে স্তব্ধ করতে লাগাতার আক্রমণের ফলে দীর্ঘ মৃত্যুমিছিল আমরা দেখেছি। লেখক, প্রকাশক, সাংবাদিক থেকে সংখ্যালঘু ধর্মগুরু, বিদেশি নাগরিক কেউই বাদ যায়নি। তারপর হলি আর্টিজানের সেই ভয়ংকর ঘটনা। পুলিশ ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনী তাদের মতো করে সেই অপশক্তিকে মোকাবেলা করছে। কিন্তু সরকারি দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে যদি হিন্দুর জীবন আর সম্পদ পুড়ে, যদি নিরীহ সাঁওতালদের উচ্ছেদ করতে রাষ্ট্রীয় বাহিনী নেমে যায়, যদি পুলিশের সামনেই এমন করে তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়, তাহলে কি করে আর গাই ‘আমারই দেশ সব মানুষের’?মনে হচ্ছে ক্রমেই এই দেশ শুধু এক ধর্মের, এক গোষ্ঠির দেশে পরিণত হবে। অথচ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এজন্য হয়নি। ধর্মান্ধতা, মৌলবাদের মতো অর্থলোভ, আধিপত্যের আকাঙ্খা এক ভয়ানক ব্যাধি। আর সেই ব্যাধির কারণেই মুক্তিযোদ্ধাকে পেটানো হয়, হত্যা করা হয়, নিরীহ মানুষের বাড়িঘরে পুড়িয়ে দেয়া হয়। রাষ্ট্রের রাজনীতিতে বিভিন্ন দল ও আদর্শের প্রতিযোগিতামূলক দ্বন্দ্ব থাকে। কিন্তু যে দল স্বাধীনতার চেতনা আর আদর্শের কথা বলে সেই দলের ভেতর বিরোধের এমন প্রবল প্রকাশ সবাইকে বিস্মিত করে। একটি উদার ও অসম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার যুদ্ধে, পরাজয়ের ঠিক আগে পাক-বাহিনী ও তাদের ইসলামপন্থী দোসররা এক মরণকামড় দিয়েছিল। বেছে বেছে মুক্তচিন্তার লেখক-কবি-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হল। সদ্য স্বাধীন দেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে স্পষ্ট অবস্থান নিল।  কিন্তু মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় জাতির জনককে হত্যা করে পাকিস্তান ধারাকে ফিরিয়ে আনলো চক্রান্তকারীরা। ঘোষিত হল ইসলামই রাষ্ট্রধর্ম। রাষ্ট্রের কোনও ধর্ম থাকে না, তবুও রক্তে কেনা বাংলাদেশের উপর একটি নির্দিষ্ট ধর্মকে চাপিয়ে দেয়া হলো। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ১৯৯৬ পর্যন্ত যারা ক্ষমতায় ছিল তারা সবাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে গিয়ে ধর্মভিত্তিক এক বিভক্ত সমাজের বিকাশ ঘটালো। স্বাধীনতার জন্য যে দেশ এত বড় ত্যাগ স্বীকার করলো, আজ আর সেই চেতনার কিছুই নেই। রাষ্ট্র ও প্রচলিত রাজনীতির বিনিয়োগ হল ইতিহাসের ঠিক উল্টো পথে যে পথ অন্ধকারের পথ। সেই একাত্তরের কায়দায় আবারো বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে জড়িত সেক্যুলার মানুষদের হত্যার উৎসবে মাতলো একই গোষ্ঠি। শেখ হাসিনার চাওয়া আছে, অঙ্গীকার আছে মুক্তচিন্তার বিকশিত বাংলাদেশ গড়ার। কিন্তু তার দলের ভেতর যদি এমন শক্তি থাকে যারা প্রৌঢ় মুক্তিযোদ্ধাকে এমনভাবে পেটাতে পারে, দলীয় কোন্দলের কারণে যেখানে সেখানে আগুন দিতে পারে, তাহলে ভাবনার কারণ আছে। প্রশ্ন জাগে, তাহলে মুক্তির পথ কতদূরে? শাসক দলকে মনে রাখতে হবে, বিদ্বেষ আর হিংসার চর্চা একাত্তরের চেতনা নয়।   লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি। এইচআর/এমএস

Advertisement