গাইবান্ধায় ক্ষতিগ্রস্ত গৃহহীন সাঁওতালদের বাড়িঘর নির্মাণের আশ্বাস পাওয়া গেলো অবশেষে। গতকাল বুধবার দুপুরে সচিবালয়ে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলক্ষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এ কথা জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল। তিনি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কোনো সাঁওতাল গৃহহীন থাকবে না। আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট বিভাগ এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে। সরকারের এ সিদ্ধান্ত অত্যন্ত সময়োপযোগী। সাঁওতালদের ওপর সাম্প্রতিক হামলার প্রেক্ষাপটে তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এ অবস্থায় তাদের পাশে দাঁড়ানো জনহিতকর সরকারের জন্য অবশ্য কর্তব্য। গত ৬ নভেম্বর গোবিন্দগঞ্জের রংপুর চিনিকলের জমিতে আখ কাটাকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারীদের সঙ্গে সাঁওতালদের সংঘর্ষে পুলিশসহ উভয় পক্ষের অন্তত ২০ জন আহত হন। তাদের মধ্যে তীরবিদ্ধ হয়েছেন নয়জন এবং গুলিবিদ্ধ হন চারজন। এ সংঘর্ষের ঘটনায় তিনজন সাঁওতাল নিহত হন। এ ঘটনায় শুধু পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় গোবিন্দগঞ্জ থানায় ওই রাতে ৪২ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ৩০০ থেকে ৪০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি দেখিয়ে মামলা করা হয়। চারজন সাঁওতালকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। সাঁওতালদের ওপর হামলার ঘটনা অত্যন্ত নিন্দনীয়। মানবাধিকার সংগঠনসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গও এ ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছেন। একটি অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর ওপর এ ধরনের হামলায় নিন্দা প্রকাশ করেছেন অনেকেই। এর মধ্যেই সরকারের পক্ষ থেকে ত্রাণ দিতে গেলে, তা-ও ফিরিয়ে দেন সাঁওতালরা। পরে অবশ্য গতকাল জেলা প্রশাসনের ত্রাণ গ্রহণ করেন তারা। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিষয়টির শান্তিপূর্ণ সমাধানে সরকারের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে তারা ত্রাণ গ্রহণ করেন। গত মঙ্গলবার রাতে আওয়ামী লীগের ধানমণ্ডির কার্যালয়ে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাঁওতালদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ বৈঠকের পরই মূলত পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়ে ওঠে। তবে সাঁওতালদের জমিজমাসংক্রান্ত বিষয়টির শান্তিপূর্ণ সমাধানই কাম্য ছিল। এ নিয়ে আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারা উভয়পক্ষের জন্যই মঙ্গলজনক হতো। এখন এতোগুলো মানুষের জীবন গেলো্, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হলো- এর দায়দায়িত্ব কে নেবে?সরকার বলছে, এর পেছনে ইন্ধনদাতাদের হাত আছে। যার হাত-ই থাক না কেন, ঘটনার দায়দায়িত্ব কিন্তু সরকার কিছুতেই এড়াতে পারে না। হত্যাকাণ্ডের বিচারসহ সংশ্লিষ্ট সব অপরাধের সুষ্ঠু তদন্ত হতে হবে। ভূমিবিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধানও কাম্য। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধেও নিতে হবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।কতজনকে বাড়িঘর নির্মাণ করে দেয়া হবে- এ প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ২-১০টা যাই হোক, প্রয়োজনানুযায়ী ঘরবাড়ি তৈরি করে দেয়া হবে।দলীয় কোন্দল থেকে এ ঘটনা ঘটেছে কিনা জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, কোনো গোষ্ঠী উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এ হামলা চালিয়েছে- এমন আভাস পাওয়া গেছে। দলীয় কোন্দল থেকে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে আমি প্রধানমন্ত্রীকে জানাতাম। নাসিরনগরে যে ক্ষতি হয়েছে, তা পূরণ করা যাবে না। তবে ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে যা যা করণীয়- আমরা সব পদক্ষেপ নিয়েছি। তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেলে সব জানা যাবে, যোগ করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতাল গ্রামে আগুন, হামলা ও গুলিতে কমপক্ষে তিনজনের মৃত্যুর ঘটনার এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও কোনো মামলা হয়নি, গঠিত হয়নি তদন্ত কমিটি। আইনের আশ্রয় হয়নি সাঁওতালদের, প্রশাসনের কোনো সাহায্যও তারা পাননি। সংবিধানে সব নাগরিকের সমান অধিকারের কথা বলা হলেও সাঁওতালরা সর্বদাই তা থেকে বঞ্চিত। গত বছরও পার্বতীপুরে একটি সাঁওতাল গ্রাম জ্বালিয়ে লুটপাট করা হয় এবং যথারীতি তার বিচার হয়নি।সাঁওতালদের ওপর হামলা ও পুলিশের গুলিবর্ষণের ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের একজনের মৃত্যু হয় হাসপাতালে; বাকি দুজনের লাশ পরে ধানক্ষেতে পতিত অবস্থায় পাওয়া যায়। সাঁওতালদের অভিযোগ, বেশ ক’জন এখনো নিখোঁজ। পুলিশের গুলিতে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা চলে হাসপাতালে হাতকড়া পরা অবস্থায়।সাঁওতালদের ‘অপরাধ’, তারা পূর্বপুরুষের ভূমি উদ্ধারের আন্দোলন করছিলেন। ১৯৬৫ সালে গোবিন্দগঞ্জে চিনিকল প্রতিষ্ঠার সময় জমি অধিগ্রহণের চুক্তিতে বলা হয়েছিল, চিনিকলের জন্য আখ ছাড়া অন্য কিছুর চাষ হলে জমি সরকারের মাধ্যমে আগের মালিকদের কাছে ফেরত দেয়া হবে। ২০০৪ সাল থেকে চিনিকলটি বেশিরভাগ সময়ই বন্ধ থাকছে এবং উল্লিখিত জমি বাণিজ্যিকভাবে ইজারা দিয়ে ধান, তামাক ইত্যাদির আবাদ করা হচ্ছে। এই যুক্তিতেই ভূমিহীন সাঁওতালরা পূর্বপুরুষের জমি ফেরতের দাবি জানাচ্ছিলেন। ভূমিবিষয়ক সংসদীয় কমিটিও বিষয়টির শান্তিপূর্ণ সমাধানের সুপারিশ করেছিল। এরই ধারাবাহিকতায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধির মৌখিক প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে সাঁওতালরা তাদের ভাষায় ‘পূর্বপুরুষের জমিতে’ ঘর তোলেন।গত রোববার সন্ত্রাসী বাহিনী সাঁওতাল বসতিতে হামলা চালালে তারা তা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেন। সে সময় পুলিশ সাঁওতালদের ওপর গুলি চালায়। তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়, ট্রাক্টর দিয়ে গুঁড়িয়ে সমান করা হয় মাটির ঘরবাড়ি। পরে পাশের আরেক সাঁওতাল গ্রামেও হামলা ও লুটপাট চলে। এসব ঘটনায় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) স্থানীয় চেয়ারম্যান ও সংসদ সদস্যদের ইন্ধনের অভিযোগ গণমাধ্যমে এসেছে।যদি আইনের শাসন থাকে, মানবাধিকারের ন্যূনতম মর্যাদাও সরকার দেয়; তাহলে এই হত্যাকাণ্ড এবং ধ্বংসলীলার বিচার হওয়া উচিত। চিনিকলের অব্যবহৃত জমি আগের মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার বিপক্ষেও কোনো যুক্তি থাকতে পারে না।এইচআর/আরআইপি
Advertisement