মতামত

নিউ ইয়র্ক বা মিয়ানমারে আপনি যা ওরা এদেশে তাই

ভেবেছিলাম বাংলাদেশে অমুসলিমদের ওপর নির্যাতন বিষয়ে আর কিছুই লিখবো না, কারণ লিখে কিছু হয় না। ৪৬-সালে দেশভাগের পর থেকে এ পর্যন্ত এদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন নিয়ে কম লেখালেখি হয়নি, কম আলোচনা, গোল-টেবিল কিংবা আন্দোলন হয়নি, কিন্তু থামানো গেছে কি এই ‘মাস এক্সোডাস’  বা গণ দেশত্যাগের প্রবাহ? যায়নি। পূর্ব বাংলা রুখিয়া দাঁড়াও বলে যে আহ্বানের কথা জানি সেই ষাটের দশকে, কই সে রুখিয়া দাঁড়ানোর চিত্র তো দেখতে পাইনি, তখন কিংবা এখন কোনোকালেই। যদি রুখিয়াই দাঁড়াতো, তাহলে একটি ভূখণ্ড থেকে এতো বিশাল আকারে জনসংখ্যার নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার কোনো কারণ ঘটতো কি? বিশ্বাস না হয় একবার সরকারি পরিসংখ্যান বা আদম শুমারির তথ্য ঘেঁটে দেখুন, দেশ থেকে অমুসলিম জনসংখ্যা কেবল কমেছে আর মুসলমানের সংখ্যা বেড়েছে পঙ্গপালের মতো। এখন এই ছোট্ট দেশে, বিপুল জনসংখ্যা নিয়ে যে দেশ হিমশিম খাচ্ছে, সে দেশের কি দায় পড়েছে সংখ্যালঘু, অমুসলিমকে তোয়াক্কা করার? বরং নিজের এবং পাল পাল ভবিষ্যৎ বংশধরের জীবনের নিশ্চয়তার জন্য অমুসলিম মানুষটার জমি দখল করবে, ভিটেমাটি দখল করবে, একটুখানি তেড়িবেড়ি করেছো কী তার স্ত্রী-কন্যাকে তুলে এনে ধর্ষণ করো, দেখবে সুর সুর করে এ দেশ ছেড়ে চলে যাবে। এর বাইরে আর কোনো রসায়ন কাজ করছে না আজকাল। আর সে কারণেই হয়তো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহরুর সঙ্গে একটি প্যাক্ট করেছিলেন যে, দু’দেশের সংখ্যালঘুদের দু’দেশ গ্রহণ করবে, কোনো কারণে সে প্যাক্ট পালিত হয়নি, কিন্তু সেটাই কি ভালো ছিল না? তাহলে সংখ্যাগুরুর এই নির্যাতন-নিপীড়ন সংখ্যালঘুকে আর সইতে হতো না? বাঙালি মুসলমানের জাত্যাভিমানের শেষ নেই। কিছু ঘোর সওয়ার নিয়ে ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজি বঙ্গ দখল করেছিলেন- এই ইতিহাস বলে শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানও জিহাদি জোশে ফুঁসে ওঠেন। কিন্তু যে মুহূর্তে তাকে প্রশ্ন করা হয়, তার আগে এই দেশে কারা সংখ্যাগুরু ছিল? তিনি মিউ মিউ করে উত্তর করেন। যদিও তারপর তিনি শুরু করেন যে, ইসলামের মহিমায় উজ্জীবিত হয়ে দলে দলে হিন্দুরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল এ দেশে। স্বাভাবিকভাবেই পরবর্তী প্রশ্ন হওয়া উচিত, আপনার পরিবারও তাহলে এভাবেই হিন্দু থেকে মুসলমান হয়েছিল, তাই না? সঙ্গে সঙ্গে উত্তরদাতার চেহারা উগ্র হয়ে উঠবে, কী বলেন এসব, আমরা হিন্দু হবো কেন? আমার দাদা-পর দাদা এসেছিলেন ইরান-তুরান থেকে মাছের পিঠে চড়ে!! প্রশ্নকারীর তখন অবাক হওয়ার পালা কারণ উত্তরদাতার গাত্রবর্ণ যদিও ভিন্ন সাক্ষ্য দিচ্ছে। এই তো এই ভূখণ্ডের ধর্মভিত্তিক পরিচয়ের ইতিহাস। এর বাইরে যে ইতিহাস রয়েছে, তা কেউ স্বীকার করেন না, কেউ মানেনও না বড় একটা। এ দেশের মুসলিম ঐতিহাসিকও বাঙালির ইতিহাস শুরু করেন ১৪০০ সালে বঙ্গ দখলের কাল থেকে, যেন এর আগে এই ভূখণ্ডে কেবল ঘাস আর বনজঙ্গল ছিল, বাঙালি বলে কোনো কিছুরই অস্তিত্ব ছিল না। অবশ্য সে অস্তিত্ব স্বীকার করলে তো নিজের অমুসলিম অতীতকে স্বীকৃতি দিতে হয়, সেটা তো সম্ভব নয়। পাকিস্তান যেমন নিজেদের অমুসলিম অতীতকে অগ্রাহ্য করে, আরব যেমন তার পৌত্তলিক অতীত অগ্রাহ্য করে তেমনই বাঙালি মুসলমানও তার অমুসলিম অতীতকে জোর করে অগ্রাহ্য করে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, কোনো বাঙালি মুসলমানের মনেই এ প্রশ্ন উদয় হয় না যে, মাত্র কয়েক শত বছরেই কী করে একটি ভূখণ্ডে তারা ‘ক্ষুদ্র ধর্মগোষ্ঠী’ থেকে সংখ্যাগুরু ও নিপীড়ক ধর্মগোষ্ঠীতে পরিণত হলো? সে ইতিহাসের কী বা প্রয়োজন, ইসলাম নিজের ছাড়া অন্য কোনো ইতিহাসকে গ্রাহ্য করে না, স্বীকৃতি দেয় না। মজার ব্যাপার হলো, এই রাষ্ট্র যখন স্বাধীনতা লাভ করে তখন দখলদার হিসেবে কিন্তু আর কেউ নয় মুসলমানরাই ছিল। পাকিস্তানিদের সঙ্গে বাঙালি যুদ্ধরত তখন পাকিস্তানিদের মূল শত্রু ও টার্গেট ছিল এ দেশর হিন্দু সম্প্রদায়। যদিও বিজয় লাভের পর আহত-নিহত-বিতাড়িতদের তালিকায় কোনো এক দৈববলে হিন্দুদের নাম বাদ যেতে শুরু করে, মুসলমান নামের তালিকাই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। এখন তো প্রকাশ্যেই প্রশ্ন ওঠে, কই হিন্দু মুক্তিযোদ্ধার তালিকা কই? কিংবা দেশছাড়া হওয়া হিন্দুরা ফিরে এসে যে এ দেশে তাদের ভিটেমাটি দখল হওয়া অবস্থায় পেয়েছিল তা তো আর পাকিস্তানিদের দ্বারা দখলকৃত হয়নি, হয়েছিল বাঙালি মুসলমানের দ্বারাই। সেখানেও ক’জন হিন্দু স্বাধীন দেশে ফিরে স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছিল সে প্রশ্ন তোলারও অবকাশ নেই। আর স্বাধীন দেশে বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর থেকে এ দেশ সাংবিধানিকভাবেই মুসলিম রাষ্ট্র, অমুসলিমদের জন্য এ দেশে থাকতে হলে গরিষ্ঠর দয়া-দাক্ষিণ্য নিয়েই টিকে থাকতে হবে। না পারলে চলে যাও, সীমান্ত উন্মুক্ত যাওয়ার জন্য, ফেরার জন্য নয়। না হলে এতো দিনেও শত্রু সম্পত্তি আইন কেন বাতিল ঘোষণা করা গেলো না, চিৎকার করে করে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তর মতো নেতারা প্রায় বিলুপ্ত হতে বসেছেন, কই একজন মুসলিম নেতাও কি আওয়ামী লীগ এতো দিনে তৈরি করতে পারলো না, যারা এই বৈষম্যমূলক ভয়ঙ্কর আইনটির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পারেন? না পারেন না, কারণ, অমুসলিমদের পক্ষে দাঁড়ানোর মতো ঈমানি জোর কী আওয়ামী লীগ, কী বিএনপি, কী জাতীয়পার্টি কোনো দলের নেতারই ঠিক নেই। কারণ তাতে ভোটের রাজনীতিতে ভোট হারানোর আশঙ্কা, কিংবা এমনও হতে পারে নিজেরই ধর্মভাইদের হাতে মাথা ফাটার আশঙ্কা রয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন করেন, শেখ হাসিনা কেন সংখ্যালঘু অমুসলিমদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন না? প্রশ্নটি সঙ্গত ও যৌক্তিক। কারণ এই মহামারীর দেশে এখনও আশার প্রদীপটি  জ্বালিয়ে রেখেছেন তিনিই। এখনও পর্যন্ত বাঙালি কী হিন্দু, কী মুসলমান, সবাই আশা করেন, শেখ হাসিনা কিছু একটা করবেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেন একা শেখ হাসিনাকেই সবকিছু করতে হবে? ২০০১ সালে যখন দেশব্যাপী অমুসলিম নাগরিকের ওপর নেমে এসেছিল নিপীড়ন-নির্যাতনের ভয়ঙ্কর তাণ্ডব তখনও শেখ হাসিনাকে নেমে আসতে হয়েছিল প্রতিবাদে, এখন যখন তার দল রাষ্ট্রক্ষমতায় এখনও কেন তাকেই নামতে হয় কিছু একটা করতে? কেন এই প্রতিবাদ কিংবা প্রতিকার আসে না অন্য কোনো রাজনৈতিক নেতার কাছ থেকে? আমি কোনোভাবেই বিশ্বাস করি না, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হিন্দু নির্যাতন কিংবা গাইবান্ধায় সাঁওতালদের ওপর গুলিবর্ষণের কোনোটিই শেখ হাসিনার নির্দেশে হয়েছে। হ্যাঁ, তার দলের কর্মী-সমর্থকেরা এই ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটিয়েছে, আগেই বলেছি এরা সেই ধর্মাশ্রয়ী বাঙালি মুসলমান, যারা মনে করে, এ দেশ তাদের, অন্য কোনো ধর্মের মানুষের এ দেশে বসবাসের যোগ্যতা নেই। প্রশ্ন করুন, আপনার পরিবারের একমাত্র সংবেদনশীল ব্যক্তিটি আপনি, আপনার বিশাল পরিবারের সবাই আপনার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে এ দেশ থেকে অমুসলিম বিতাড়নে বদ্ধ পরিকর, কতো দিন আপনার জ্যেষ্ঠত্ব কিংবা ক্ষমতা দিয়ে আপনি সেটি ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হবেন? শেখ হাসিনা যাদের নির্দেশ দেবেন, যাদের দিয়ে সমস্যা নিরসন করবেন, তারা তো সংখ্যাগুরু মুসলমান, বিশ্বাসে ও ক্ষমতায় – দু’ক্ষেত্রেই তারা নিজেদের ধর্মবিশ্বাসকে প্রাধান্য দিতে প্রস্তুত, প্রয়োজনে, মানে যখন প্রয়োজন পড়বে তখন তারা দরকার হলে শেখ হাসিনাকে ‘মাইনাস’ করতেও রাজি আছে, কিন্তু তাদের ধর্ম, ধর্মের বড়াই, বাড়াবাড়ি কোনোটিই ত্যাগে প্রস্তুত কি? সে কারণেই প্রশ্নটি আগে নিজেকে না করে শেখ হাসিনা কেন করেন না, সেটা জিজ্ঞেস করাটা এক ধরনের বোকামিই আমার কাছে। অন্তত আমি নিজেকে আগে শোধরানোর পক্ষপাতি, তারপর অন্য কাউকে। দলের কর্মী-সমর্থকেরা দেশব্যাপী তাণ্ডব চালাবে তার খেসারত দিতে হবে শেখ হাসিনাকে, দেশের সুশীল সমাজ বিদেশিদের নিয়ে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে অর্থনীতি ধ্বংস করতে চাইবে মেরামত করতে হবে শেখ হাসিনাকে, দেশব্যাপী সংখ্যালঘু অমুসলিমদের নিয়ে রাজনীতি হবে, তাদের মেরে-ধরে খেদিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলবে দেখতে হবে শেখ হাসিনাকে- ভাগ্যিস এখন কলি যুগ, সত্য যুগ হলে এতো দিনে শেখ হাসিনার ওপর দেবিত্ব আরোপ করতে হতো আমাদের!!আমাদের ধর্মাশ্রয়ী জাতীয়তাবাদী চেতনা বিগলিত হয়ে মরাকান্নার রোল তোলে যখন গাজায় ইসরাইলি বাহিনী ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেয়, কিংবা সেখানে শিশু হত্যা করে। হওয়ারই কথা, মানবতা সেখানে সত্যিই ভূলুন্ঠিত হচ্ছে। কিন্তু এ দেশের মুসলমান বিবেক একবারও নাসিরনগর কিংবা গোবিন্দগঞ্জ নিয়ে কেঁপে ওঠে না, কারণ এখানে শোষিত আসলে বি-ধর্মীরা। কিংবা যারা প্রতিবাদী হয়েছেন দুর্ভাগ্যক্রমে তারা এই সংখ্যালঘু অমুসলিম নির্যাতনের বিরুদ্ধে নয়, কেবল শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় বলে মাঠে নেমেছেন, কারণ তাদের আমরা ২০০১ সালে রাস্তায় দেখিনি কিংবা তাদের মুখ দিয়ে সে বিষয়ে কোনো শব্দও শুনিনি কোনোদিন। সুতরাং, তাদের মায়াকান্নার আড়ালেও রাজনীতি আছে। তারা সুন্দরবন আর রামপাল নিয়ে যেমন কাঁদেন তেমনই নাসিরনগর কিংবা গোবিন্দগঞ্জ নিয়েও একটু কাঁদেন- তবু তাদের এই কান্নাকে আমি অগ্রাহ্য করিনে, কেউ তো একটু কাঁদছেন। কিন্তু কান্নাটা আরো কার্যকর হতো যদি তারা তাদেরই ধর্মভাইদের ধর্মোন্মাদনার বিরুদ্ধে কিছু বলতেন, কেবল সরকারি বাহিনীর সমালোচনা না করতেন, কারণ এরা কিন্তু তারাই যারা হোলি আর্টিজানের ঘটনাকেও মনে করেন সরকারের বাক্ স্বাধীনতা হরণের প্রত্যক্ষ ফল!! তাই এই চিহ্নিত চেহারাদের অপরাজনৈতিক কৌশলকে আমি কোনোভাবেই সাম্প্রদায়িক দানবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে দেখতে পারিনে। মজার ব্যাপার হলো, তারা নিউ ইয়র্কে একজন মুসলিম মারা গেলে কিংবা মিয়ানমারের সেনাবাহিনী যখন রোহিঙ্গা মুসলিমকে হত্যা করে তখন যেভাবে তাড়িত হয়ে ফুঁসে ওঠেন ঠিক সেভাবে এ দেশে যখন হিন্দু কিংবা সাঁওতাল নির্যাতিত হন তখন ফুঁসে দাঁড়ান না, বরং তারা এ দেশের এই নির্যাতনকেও আওয়ামী লীগের দায় বলে রাজনীতি করতে চান। তারা ভুলে যান, নিউ ইয়র্কে কিংবা মিয়ানমারে যারা (মানে যে সংখ্যালঘু মুসলিম) পড়ে পড়ে মার খাচ্ছে আর এ দেশে যারা (সংখ্যালঘু হিন্দু কিংবা সাঁওতাল) তারা একই পরিচয়ে পরিচিত, তাদের একমাত্র পরিচয় তারা সংখ্যালঘু। সংখ্যাগুরুর এই উল্লম্ফন পৃথিবীময় চলমান, তাই যতো দিন না সংখ্যাগুরুর এই উল্লম্ফন বন্ধ হবে ততো দিন কোনো দেশেই সংখ্যালঘুর ওপর নেমে আসা এই নির্যাতন বন্ধ হবে না। সংখ্যালঘুর জীবন আসলে সংখ্যাগুরুর হাতের মুঠোয়- রাষ্ট্র এখানে কেবল আইন প্রণয়নের ভূমিকায় কিন্তু আইন লঙ্ঘনকারী কিংবা প্রতিপালনের দায় তো নাগরিকের কিংবা বলা ভালো সংখ্যাগুরুর, তাই নয়? ঢাকা, ১৬ নভেম্বর, বুধবার, ২০১৬লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।এইচআর/এমএস

Advertisement