হারের বৃত্তে আটকা চ্যাম্পিয়ন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স। যাদের কাছে জয় এখনো সোনার হরিণ। একমাত্র দল যারা চার ম্যাচের সবটায় হেরে পয়েন্ট টেবিলে তলানিতে। প্রিয় দলের এ পরিণতি দেখে ভক্তদের মন খারাপ। অধিনায়ক মাশরাফি আশা ভঙ্গের বেদনায় নীল। ফ্র্যাঞ্চাইজিও হতাশ। সব মিলে আগেরবারের চ্যাম্পিয়ন শিবিরে একটা গুমোট পরিবেশ। কিন্তু কেন ভাঙা-চোরা অবস্থা? কি কারণে চ্যাম্পিয়নরা এখন পর্যন্ত সবার পেছনে? বিপিএলের প্রথম সাতদিনের খেলা শেষে এবং চট্টগ্রাম পর্ব শুরুর আগে কম বেশি সবার মুখে এ প্রশ্ন? এরই মধ্যে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজার রাগ করে টিম হোটেল ছেড়ে মিরপুরে বাসায় চলে আসা জন্ম দিয়েছে অনেক প্রশ্নের- শুধুই কি মাঠের অনুজ্জ্বল পারফরম্যান্সের কারণেই কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পাচ্ছে না? নাকি আরো কোনো কারণ আছে? অভ্যন্তরীণ কোন্দল-ফোন্দল নেই তো? নাকি ফ্র্যাঞ্চাইজি কিংবা কোচ মিজানুর রহমান বাবুল বা ম্যানেজার খালেদ মাসুদ পাইলটের সঙ্গে অধিনায়কের কোন মতপার্থক্য কিংবা মতভেদ? প্রশ্নগুলো গুঞ্জনে পরিণত হয়েছে রোববার ঢাকা ডায়নামাইটসের সঙ্গে খেলার দিন দুপুরে মাশরাফির ক্ষোভে-অভিমানে হোটেল ছেড়ে মিরপুর চলে যাওয়ায়। সবার জানা শুধু ইনজুরিকে জয় করা আর ছোটবড় মিলে ৮/১০টি অপারেশনের ধকল কাটিয়ে বারবার মাঠে ফেরাই শুধু নয়, মাশরাফি মানেই প্রতিকূলতাকে জয় করা। দলের প্রতি ভালবাসা যার সর্বোচ্চ। যিনি দলের প্রয়োজনে নিজেকে নিংড়ে দেন। যে মাশরাফির পিঠের ব্যথায় কুকরে গিয়েও রণে ভঙ্গ দেয়ার রেকর্ড নেই, সেই সাহসী ও ক্রিকেট অান্তপ্রাণ যোদ্ধা হোটেল ছেড়ে বাসায় ফিরে যাওয়ার ঘটনা কৌতূহলী প্রশ্নের উদ্রেক ঘটায় বৈকি। খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। বছর ছয়েক আগে ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে আবাহনীকে চ্যাম্পিয়ন করাতে ৫০% ফিটনেস নিয়েও খেলেছেন মাশরাফি। পিঠ ও কোমড়ের মাঝামাঝি অংশের প্রচণ্ড ব্যথাও তাকে দমাতে পারেনি। সুপার লিগের গুরুত্বপূর্ণ অংশে কোমড়ে বেল্ট বেঁধে কয়েক পা দৌড়ে মিডিয়াম পেস বোলিং করার পর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মোহামেডানের সঙ্গেসহ একাধিক লিগ নির্ধারণী ম্যাচে রীতিমতো অফস্পিন বোলিং করেও দল জিতিয়েছেন। অনেক বাঘা বাঘা বোলারের মুখে হাসি কেড়ে নেয়া সনাথ জয়সুরিাকে সাজঘরে ফিরিয়ে আবাহনীকে লিগ চ্যাম্পিয়ন করানোর রেকর্ড আছে তার। সেই মাশরাফি বিনা কারণে হোটেল ছেড়ে বাসায় চলে এসেছিলেন, এটা বিশ্বাস করা কঠিন। গত কদিন শেরেবাংলার আকাশে-বাতাসে যে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল আসলে মাশরাফির আবেগতাড়িত কথাবার্তা এবং হোটেল ত্যাগ ছিল তারই ফলশ্রুতি। অবশ্যই ঘণ্টা খানেকের মধ্যে উত্তেজনা প্রশমিত হয়। অধিনায়ক ও মালিক পক্ষের দূরত্বও কমে যায়। এ পর্যায়ে মাশরাফিই জাগো নিউজকে জানান, ‘হ্যাঁ, দল সাজানো নিয়ে কিছু মতো পার্থক্য তৈরি হয়েছিল। তবে সেটা মিটে গেছে। আমি হোটেলে ফিরে যাচ্ছি। খেলবোও।` মাশরাফি তার বাসায় বসে সাংবাদিকদের আরো বলেন, ‘ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টে ক্রিকেটার ও অধিনায়কদের সাথে মালিকপক্ষের এমন মতের অমিল হয়। আবার তা মিটেও যায়। আমারটাও মিটে গেছে।’এর বাইরে দলে একজন কার্যকর পেস বোলিং অলরাউন্ডারের অভাব- এ আফসোস এবার শুরু থেকেই কুমিল্লা অধিনায়কের কণ্ঠে। তবে এটা সত্য যে, মাঠের পারফরম্যান্সে ঠিক থাকতো যত কথা বার্তা শোনা যাচ্ছে এবং অভ্যন্তরে যত অমত ও দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে তার কিছুই হতো না। কিন্তু তা তো হয়নি। অধিনায়ক যাদের ওপর আস্থা রেখে দল সাজিয়েছেন, তারা ক্রমাগত ব্যর্থতার ঘানি টানছেন। আর সে কারণেই মাঠে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের পারফরম্যান্স বেশ খারাপ। ২৪ ঘণ্টা আগে ঢাকার বিপক্ষে শেষ ম্যাচে অধিনায়ক মাশরাফির ব্যাটে (৩৫ বলে ৪৭) ভর করে প্রথমবার ১৬০-এর ( ১৬১) ঘরে। অথচ তার আগের তিন ম্যাচে ১৪০ রানও করা সম্ভব হয়নি। আসুন, এক নজরে কুমিল্লার চার ম্যাচের স্কোরলাইন দেখা যাক; প্রথম ম্যাচে চিটাগাং কিংসের কাছে ২৯ রানে হার। ১৬১ রানের জবাবে ১৩১-এ গিয়ে আটকে থাকা। দ্বিতীয় ম্যাচে বরিশাল বুলসের বিপক্ষে ১২৯ রান করে ৬ উইকেটে হার। তৃতীয় ম্যাচে খুলনা টাইটান্সকে ১৪৪ রানে আটকে রেখেও ১৩ রানে পরাজয়। আবারো ১৩১-এ গিয়ে থেমে যাওয়া। আর শেষ ম্যাচে ঢাকার ১৯৪ রানের জবাবে ১৬১ রানে ইনিংস শেষ করে ৩৩ রানে হার। বলার অপেক্ষা রাখে না, ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের যোগফলই দলগত পারফরম্যান্স। তার অবস্থা আরো জীর্ণ-শীর্ণ। একজন পারফরমারও নেই যার ব্যাট ধারাবাহিকভাবে কথা বলেছে। যিনি রান করেছেন। সবার জানা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের দৈর্ঘ্য এত ছোট যে, প্রথম তিন-চার ব্যাটসম্যানের অন্তত এক বা দুজনর ভালো না খেললে কিংবা দীর্ঘ ইনিংস সাজাতে না পারলে স্কোরলাইন বড় করা সম্ভব নয়। কুমিল্লার একজন টপঅর্ডারও সে অর্থে ওই কাজ করে দিতে পারেননি। একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়, এবারের বিপিএলে এখন পর্যন্ত সেই দল ভালো করেছে, যাদের ফ্রন্টলাইন ব্যাটিং বেশি ক্লিক করেছে। সবার ওপরে থাকা বরিশাল বুলসের কথাই ধরা যাক। দলটির তিন টপ অর্ডার নিয়মিত ভালো খেলছেন। রানও করছেন। বাঁ-হাতি শাহরিয়ার নাফীস (৪ খেলায় তিন ফিফটিসহ ১৮৪) ও অধিনায়ক মুশফিকুর রহীম (চার খেলায় দুই ফিফটিসহ ১৭৪) রান তোলায় সবার ওপরে। এছাড়া ডেভিড মালানও চার ম্যাচে করেছেন ১৩৩। ঢাকা ডায়নামাইটসের সাফল্যের অন্যতম রূপকার ওপেনার মেহেদী মারুফ (চার খেলায় দুই অর্ধশতকসহ ১৭০)। রাজশাহীর সাব্বির রহমান রুম্মন ( ৪ খেলায় এক সেঞ্চুরিসহ ১৫৭) ও চিটাগাং কিংসের তামিম ইকবাল (৪ খেলায় একজোড়া হাফ সেঞ্চুরিতে ১৪৩) করে দলকে টেনে নিচ্ছেন। আর সেখানে কুমিল্লার চার টপঅর্ডারের অবস্থা দেখুন। ওপেনার ইমরুল কায়েস চার ম্যাচে ( ৬+০+২১+১৯ )= ৪৬, লিটন দাস তিন খেলায় (১৩+৪+৮)= ২৫। শেষ ম্যাচে ড্রপ মারলন স্যামুয়েলস তিন খেলায় (২৩+৪৮+৩০ )= ১০১ এবং তরুণ নাজমুল হোসেন শান্ত চার ম্যাচে (৫৪*+১৬+১০+১৬ )= ৯৬। এখানেই আসলে পার্থক্য গড়ে উঠেছে।এখন পর্যন্ত কুমিল্লার প্রথম তিনজনের কেউ পঞ্চাশের ঘরে যেতে পারেননি। একমাত্র ফিফটি (চিটাগাং কিংসের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে (৫৪*) করেছেন প্রথমবার খেলা নাজমুল হোসেন শান্ত। শুরুর দিকে কেউ রান করতে পারছেন না। লম্বা ইনিংস সাজানোর প্রশ্নই ওঠে না। আর মাঝে হাল ধরার সে অর্থে বড় কোনো পারফরমারও নেই। এখানে বড় মার খেয়েছে কুমিল্লা। আগেরবার পাঁচ-ছয় নম্বরে আসহার জাইদি দারুণ সার্ভিস দিয়েছেন। প্রতি ম্যাচে বাঁহাতি স্পিন দিয়ে মাপা বোলিংয়ের পাশাপাশি ব্যাট হাতে ধারাবাহিকভাবে রান করে দলের অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন জাইদি। এবার তার অবস্থা খুব খারাপ; দুই ম্যাচে করেছেন মোটে (২+১০) = ১২। আর বল হাতে আরও (০/১০+ ০/ ১৮ ) অনুজ্জ্বল। অকার্যকর। আসহার জাইদি জ্বলে না ওঠা দলের ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। সে ঘাটতি দূর করার মতো আরো একজন পারফরমার আছেন। তিনি ইমাদ ওয়াসিম। পাকিস্তানের পক্ষে এ নবীন বাঁহাতি স্পিনার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বল ও ব্যাট হাতে সমান পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। কিন্তু এবার বিপিএলে তার ছিটেফোটাও নেই। দু ম্যাচ খেলে করেছেন মাত্র (৪+১ ) ৫। আর উইকেট পেয়েছেন দুটি (১/২২+১/৩৮)। এর বাইরে এক থেকে সাত নম্বর পর্যন্ত আরও দুজন দুটি করে ম্যাচ খেলেছেন। কিন্তু তারাও চরম ব্যর্থ। প্রথমজন সম্ভাবনাময় তরুণ আল-আমিন ( দুই খেলায় ১৪+০ = ১৪)। আর অন্যজন পাকিস্তানের টি-টোয়েন্টি স্কোয়াডের খালেদ লতিফ (এক ম্যাচে ১২)। যেহেতু চারজনের বেশি বিদেশি খেলানোর সুযোগ নেই, তা সোহেল তানভিরকে রেখে আর বাকিদের ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খেলানো হয়েছে। কিন্তু কেউই দল টেনে নেয়ার মতো পারফরম্যান্স দেখাতে পারেননি। এই না পারার চরম মাশুল গুণতে হচ্ছে। অধিনায়ক মাশরাফি আর সোহেল তানভিরই বলতে গেলে ব্যাট ও বলে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। মাশরাফি (১+২+৫+৪৭ = ৫৫ ) প্রথম তিন ম্যাচে ডাবল ফিগারে পৌঁছাতে না পারলেও শেষ ম্যাচের সাকিব আল হাসানের এক ওভারে চার ছক্কা হাকিয়ে মাঠ গরম করেছেন। পাশাপাশি ৩ উইকেটও পেয়েছেন। অন্যদিকে সোহেল তানভির (০+৩০+২১+২০ = ৭১ ) ও ৪ উইকেট শিকারী। শেষ দুটি ম্যাচে বরং বল হাতে ভালো করেছেন রশিদ খান। আফগানিস্তানের এ লেগস্পিনার দুই ম্যাচ খেলে পতন ঘটিয়েছেন ৪ উইকেটের। টপঅর্ডারে আরও একজন ভালো ব্যাটসম্যান আছেন। কিন্তু তার আবার বোলিং নেই। তাই মারলন স্যামুয়েলসকে তিন ম্যাচ খেলানো হয়েছে। কিন্তু এই ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানও এখন পর্যন্ত নিজের মানে পৌঁছাতে পারেননি। তাই তাকে বাইরে রেখে ঢাকার সাথে শেষ ম্যাচে পাকিস্তানি ওপেনার আহমেদ শেজাদকে খেলানো হয়েছে। তিনিই মাত্র ১৫ রানে আউট হয়ে গেছেন। মোদ্দাকথা, টপঅর্ডারে চার-ছক্কার ফুলঝুড়ি ছুটিয়ে প্রতিপক্ষকে বোলিংকে শুরুতে এলোমেলো করে দেয়া এবং প্রথম ৬ ওভারে ফিল্ডিং বিধিবদ্ধতা কাজে লাগিয়ে ফিল্ডারদের মাথার ওপর দিয়ে শটস খেলে রান চাঁকা সচল করার কাজ হচ্ছে না। উল্টো ইনিংস শুরুর পর হুড়মুরড় করে ভেঙ্গে যাচ্ছে। মাঝখানে ক্ষত সাড়াতে অমন বড় মাপের ও অভিজ্ঞ কেউ নেই। আর যারা আছেন, তারাও ব্যর্থ। তাই ব্যাটিংয়ের হতশ্রী অবস্থা। ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতায়ই আসলে কুমিল্লা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। চ্যাম্পিয়নদের সম্ভাবনার প্রদীপ তাই বলে নিভে যায়নি। এখনো আটটি ম্যাচ বাকি। অবস্থার উন্নতি ঘটানোর পর্যাপ্ত সুযোগ ও সম্ভাবনা আছে। তবে ব্যাটিং দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা ছাড়া বিকল্প পথ নেই।এআরবি/এনইউ/এবিএস
Advertisement