সাহিত্য

নবান্ন যেন হৃদয়ের বন্ধন

আমার শৈশব-কৈশোরের যতটুকু মনে পড়ে- তাতে নবান্নের স্মৃতি এখনো হৃদয়ে নাড়া দেয়। প্রতিবেশী-আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সম্প্রীতির এক নির্মল আনন্দস্নাত ছবি ভেসে ওঠে চোখের কোণে। কী মমতায় ঘেরা সে দৃশ্যপট! দৃশ্যপটে নতুন চালের পিঠা বানানোর ধুম পড়ে যায় চারিদিকে। অঘোষিত এক বর্ণিল উৎসবের আমেজ লক্ষ্য করা যায় গ্রামজুড়ে। আর তাতে নেই কোনো আনুষ্ঠানিকতা। নেই কোনো আড়ম্বরতা। তাতে আছে অসীম আন্তরিকতা ও সীমাহীন আবেগ। ক্লান্ত রাতের নিদ্রা শেষে চোখ মেললেই ধানে আর গানে ভরে ওঠে প্রাণ।সেখানে নতুন ধানের মৌ মৌ গন্ধে মাতোয়ারা কৃষাণ-কৃষাণির মুখে লেগে থাকে গান। কাজের মধ্যেই তারা গেয়ে ওঠেন গ্রামবাংলার চিরায়ত গীত। বাড়িজুড়ে ব্যস্ততা আর খুশির ঝিলিক। শিশুদের কলকাকলিতে মুখরিত হয় আঙিনা। ধান ভানার গান ভেসে বেড়ায় বাতাসে, ঢেঁকির তালে তালে মুখর হয় বাড়ির রসুইঘর।অগ্রহায়ণের প্রথম দিন থেকে ধান কাটার মৌসুম শুরু হয়। গ্রামের ঘরে ঘরে ফসল তোলার আনন্দ। নতুন ধানের গন্ধে অন্যরকম একটি আবহ বিরাজ করতে থাকে। নবান্ন আর পিঠাপুলির আনন্দে মাতোয়ারা হয় সবাই। মনে পড়ে- নবান্নে আমরা সবাই নানা বাড়িতে মিলিত হতাম। বড় খালা, ছোট খালারা আসতেন। খালাতো ভাই-বোনের সীমাহীন হৈচৈ, হৈ-হুল্লোড় মাতিয়ে রাখত সারা বাড়ি। গল্প-আড্ডায় ভরে উঠত আঙিনা। চলত নানাবিধ আয়োজন। নিম্নবিত্ত প্রতিবেশীরাও যুক্ত হতেন সে আনন্দযজ্ঞে। ঘোড়ার দৌড়, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগযুদ্ধ ছিল উৎসবের অন্যতম অনুষঙ্গ। এবার মূল কথায় আসি, বছর ঘুরে আসে অগ্রহায়ণ। স্মরণাতীতকাল থেকে বাঙালির জীবনে পহেলা অগ্রহায়ণকে বলা হয় নবান্ন। নবান্ন হেমন্তের প্রাণ। ‘নবান্ন’ শব্দের অর্থ ‘নতুন অন্ন’। নবান্ন ঋতুকেন্দ্রিক একটি উৎসব। হেমন্তে নতুন ফসল ঘরে তোলার সময় এই উৎসব পালন করা হয়। এই উৎসব পালিত হয় অগ্রহায়ণ মাসে। ‘অগ্র’ অর্থ ‘প্রথম’। আর ‘হায়ণ’ অর্থ ‘মাস’। এ থেকে সহজেই ধারণা করা হয়, এক সময় অগ্রহায়ণ মাসই ছিল বাংলা বছরের প্রথম মাস।এ মাসে কৃষকের মাঠে সোনারঙা ধানের ছড়াছড়ি। সারা দেশে আমন ধান কাটার উৎসব। কৃষক সোনার ধান কেটে নিয়ে আসে। বাড়ির আঙিনা ভরে ওঠে নতুন ধানের ম-ম গন্ধে। নতুন চাল দিয়ে তৈরি হয় পিঠা, পায়েস, ক্ষীরসহ হরেকরকমের মজাদার খাবার। নতুন চালের ভাত নানা ব্যঞ্জনে মুখে দেওয়া হয় আনন্দঘন পরিবেশে।নবান্ন উৎসবের সঙ্গে মিশে আছে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি। অগ্রহায়ণের শুরুতেই সারা দেশে চলে উৎসবের নানা আয়োজন। নতুন ধান কাটা আর সেই ধানের প্রথম অন্ন খাওয়াকে কেন্দ্র করে পালিত হয় নবান্ন উৎসব। এ যেন হৃদয়ের বন্ধনকে আরো দৃঢ় করার উৎসব। কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, ‘চারিদিকে নুয়ে পড়ে ফলেছে ফসল/ তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল,/ প্রচুর শস্যের গন্ধ থেকে-থেকে আসিতেছে ভেসে/ পেঁচা আর ইঁদুরের ঘ্রাণে ভরা আমাদের ভাড়ারের দেশে।’ সোনালি ধানের প্রাচুর্য আর বাঙালি সংস্কৃতির বিশেষ অংশ নবান্ন নিঃসর্গের কবি জীবনানন্দের কবিতায় ধরা পড়েছে প্রবলভাবে।অন্য কবিতায় তিনি আকুতি জানান, ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়/ হয়তো মানুষ নয় হয়তোবা শঙ্খচিল শালিখের বেশে;/ হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে’। প্রকৃতির বিচিত্র এ রূপের বর্ণনা দিয়েছেন এ দেশের প্রায় সব কবি-সাহিত্যিক। ‘গোয়াল ভরা গরু, গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ আর গলা ভরা গান’ই যেন বাঙালির মহামূল্যবান সম্পদ। তাই তো বাউল মন গেয়ে ওঠে- ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’। কেননা গ্রামবাংলার নবান্ন উৎসবে বাড়ির জামাইকে নিমন্ত্রণ করা হয়। মেয়েকেও বাপেরবাড়িতে ‘নাইয়র’ আনা হয়। নবান্ন আর পিঠে-পুলির উৎসবের আনন্দে মাতোয়ারা হয় সবাই। ‘আজ নতুন ধানে হবে রে নবান্ন সবার ঘরে ঘরে’- স্লোগানে সবাই মিলিত হয় প্রাণের আবেগে, হৃদয়ের উচ্ছ্বাসে, মনের টানে। নবান্নকে ঘিরে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে নতুন ধানের ভাত মুখে দেয়ার আগে মিলাদ ও দোয়া পাঠ করতে দেখা যায়। মসজিদে মসজিদে শিরনি দেয়ার প্রচলনও আছে কোথাও কোথাও। আর হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরে ঘরে চলে পূজার আয়োজন। তবুও মনে হয়- এ যেন এক সম্মিলিত উৎসব।নবান্নে প্রিয়জনকে নতুন কিছু উপহার দেওয়ার প্রচলন সেই প্রাচীনকাল থেকেই ছিলো। তাই তো কবি পথিক বাঙালি বলতে পারেন, ‘কথা দিয়েছি- এবার নবান্নে হবে সব/ ফিরিয়ে দেব পাখির কলরব/ ডাহুকের ডাক- ঘুঘুর আহ্বান/ জাগিয়ে দিও ফজরের আজান।’ কবি আরো বলেছেন, ‘ধানের হলুদ রঙ তুলে দেব শাড়িতে/ হাতের বালায় সোনালি আঁচড়/ হিজলের তলায় পুরাতন প্রেম যদি জেগে ওঠে?’কিন্তু ক্রমান্বয়েই যেন সেই আনন্দ ম্লান হয়ে যাচ্ছে আজকাল। সম্প্রতি দু’টি ঘটনায় নবান্ন যেন বিমর্ষ হয়ে পড়েছে। সাঁওতালদের আর্তনাদ আর নাসিরনগরের কান্না সেই নবান্নকে ম্লান করে দিচ্ছে। তবুও বুকে বিশ্বাস নিয়ে বলতে চাই- ‘আবার জমবে মেলা, বটতলা হাটখোলা।/ অঘ্রাণে নবান্নে উৎসবে,/ সোনার বাংলা ভরে উঠবে সোনায়,/ বিশ্ববাসী চেয়ে রবে।।’ হাজার বছরের পুরনো এই উৎসব হোক অসাম্প্রদায়িক, ঐতিহ্যবাহী এবং প্রাচীনতম মাটির সঙ্গে মানুষের চিরবন্ধনযুক্ত। আসুক অগ্রহায়ণ। আসুক নবান্ন বারে বারে। ঈশ্বরী পাটনির ভাষায় বলতে চাই, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’। দুধে-ভাতে বাঙালির জীবনে ফিরে আসুক সুখ ও সমৃদ্ধি। জাগ্রত হোক বাঙালির চেতনা। এসইউ/আরআইপি

Advertisement